সারাবিশ্বের ন্যায় বাংলাদেশেও ছড়িয়ে পড়েছে করোনাভাইরাসে। এই ভাইরাসের প্রকোপ থেকে রক্ষা পেতে দেশব্যাপী চলা লকডাউন কর্মসূচির কারণে চায়ের আন্তর্জাতিক নিলাম বন্ধ রয়েছে। এ অবস্থায় সর্বশেষ তিন নিলামের চা আউটলট পদ্ধতিতে বিক্রি হবে। ব্রোকার প্রতিষ্ঠানগুলোই চায়ের দাম নির্ধারণ করে ক্রেতাদের কাছে বিক্রি করে চা বোর্ডকে অবহিত করবে। এরই মধ্যে বিগত নিলামবর্ষের অবিক্রীত ১০ লাখ কেজি চা আউটলটে বিক্রি শুরু করেছে ব্রোকার্স প্রতিষ্ঠানগুলো।
নভেল করোনাভাইরাসের সংক্রমণ কমাতে সারা দেশে ২৬ মার্চ থেকে সাধারণ ছুটি শুরু হয়, যা এখনো চলছে। যদিও ছুটি শুরুর আগেই ২৪ মার্চ চায়ের বর্ধিত ৪৬তম নিলাম স্থগিত করে চা বোর্ড। ৩১ মার্চের ৪৭তম নিলামও অনুষ্ঠিত হয়নি জরুরি পরিস্থিতির কারণে। পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হওয়ায় দেশের বাগানগুলোর অবিক্রীত চা (৪৫ থেকে ৪৭ নিলাম পর্যন্ত) আউটলট পদ্ধতিতে বিক্রি করতে পারবে ব্রোকাররা। লকডাউন কর্মসূচি চলতে থাকলে নতুন মৌসুমের অনুষ্ঠিতব্য নিলামের চা-ও একই নিয়মে বিক্রি হবে কিনা সে বিষয়ে বৈঠকের মাধ্যমে সিদ্ধান্ত নেয়া হতে পারে বলে জানিয়েছেন চা বোর্ড কর্মকর্তারা।
জানতে চাইলে চা বোর্ডের উপপরিচালক (পরিকল্পনা) মুনির আহমেদ বলেন, উদ্ভূত পরিস্থিতির কারণে শেষ দুটি নিলাম অনুষ্ঠিত হয়নি। এ কারণে ক্যাটালগভুক্ত চা ব্রোকারদের নিজ উদ্যোগে বিক্রির নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। চা বাগানগুলোতে উৎপাদন ধরে রাখতে সার বিতরণ ছাড়াও বিভিন্ন কর্মসূচি চালু রাখা হয়েছে। আশা করছি, মে মাসের মধ্যে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে এলে নতুন মৌসুমের নিলামও শুরু হবে। এরই মধ্যে আউটলটে পুরনো চাগুলো বিক্রি হয়ে গেলে বাগান মালিকরা লোকসানের হাত থেকেও রক্ষা পাবেন বলে আশা করছেন তিনি।
দেশে প্রতি বছর এপ্রিলের শেষ দিকে কিংবা মে মাসের শুরুতে নতুন মৌসুমের নিলাম কার্যক্রম শুরু হয়। প্রতি মাসে চারটি নিলাম অনুষ্ঠিত হয় চট্টগ্রাম ও শ্রীমঙ্গলে (মৌলভীবাজার)। এর আগে জানুয়ারির মাঝামাঝি থেকে প্রায় দুই মাসের জন্য চায়ের উৎপাদন বন্ধ থাকে। বাগান মালিকরা পুরনো চা ও বাগানের অবশিষ্ট চা কুঁড়ি উত্তোলন করে উৎপাদনের মাধ্যমে নিলামে বিক্রির জন্য পাঠান। প্রতি বছর সর্বমোট ৪৫টি নিলাম অনুষ্ঠিত হলেও চায়ের পর্যাপ্ত উৎপাদন ও মজুদ চায়ের পরিমাণ বেশি হলে নিলাম সংখ্যা বাড়িয়ে দেয় চা বোর্ড। চলতি মৌসুমের শেষার্ধে প্রায় ১০ লাখ কেজি চা অবিক্রীত থাকায় বাড়তি দুটি নিলাম আয়োজনের ঘোষণা দেয়া হয়েছিল। কিন্তু নভেল করোনাভাইরাসের কারণে যানবাহন চলাচল বন্ধ হয়ে যাওয়ায় অবিক্রীত এসব চা আউটলট পদ্ধতিতে বিক্রির সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। সাধারণ ছুটির পরিধি বাড়লে নতুন মৌসুমের নিলাম কার্যক্রম শুরু হতেও বিলম্ব হতে পারে। এতে বাগানে চায়ের মজুদ বেড়ে গুণগত মান কমে যাওয়ার ঝুঁকি রয়েছে বলে আশঙ্কা করছেন বাগানসংশ্লিষ্টরা।
বাংলাদেশ চা বোর্ড সূত্রে জানা গেছে, বাগান থেকে উৎপাদিত চা মালিকরা চা বোর্ডের নিবন্ধিত ব্রোকার্স প্রতিষ্ঠানের কাছে প্রেরণ করেন। এরপর চা বোর্ড এসব চায়ের মান যাচাই করে লট আকারে দাম ও গ্রেড নির্ধারণ করে। ব্রোকার্স প্রতিষ্ঠানের তৈরি ক্যাটালগে চায়ের গ্রেড ও প্রস্তাবিত দাম নির্ধারণ করে দেয়া থাকে। চা বোর্ডের সদস্য ক্রেতা প্রতিষ্ঠানগুলো প্রতি সপ্তাহে মঙ্গলবারের নিলামে গিয়ে ক্যাটালগ দেখে নিলামের নিয়ম অনুযায়ী বিডিংয়ের মাধ্যমে চা ক্রয় করে। এক্ষেত্রে ক্যাটালগের নির্ধারিত দামের চেয়ে বেশি বা কম দামে নিলামে বিক্রি হয় বাগান মালিকদের পাঠানো চা। তবে ৪৬ ও ৪৭তম নিলাম অনুষ্ঠিত না হওয়ায় ক্যাটালগভুক্ত চাগুলো নির্ধারিত দাম বা ব্রোকার্স প্রতিষ্ঠান নির্ধারিত দামের বেশি বা কম দামে ক্রেতাদের কাছে বিক্রি করতে পারবে। নতুন মৌসুমের নিলাম অনুষ্ঠিত না হলে এ পদ্ধতিতে দেশের প্রায় ১৬৬টি বাগানের উৎপাদিত চা বিক্রি করা যাবে বলে জানিয়েছেন চা বোর্ড কর্তৃপক্ষ।
চা বোর্ডের সর্বশেষ নির্দেশনা থেকে জানা গেছে, নভেল করোনাভাইরাস পরিস্থিতির কারণে ৪ এপ্রিলের পর ৪৬তম নিলামের চা ও আগের নিলামের অবিক্রীত চা আউটলট পদ্ধতিতে ক্রেতাদের কাছে বিক্রি করা যাবে। মুদ্রিত ক্যাটালগভুক্ত হওয়া এসব চা আউটলটে শুধু চলতি নিলামবর্ষের জন্যই বিক্রির উপযোগী হবে। এ ধরনের পদ্ধতি শুধু চলতি (২০১৯-২০) নিলামবর্ষের জন্য নেয়া হয়েছে বিধায় পরবর্তী সময়ে এ নিয়মটি উদাহরণ হিসেবেও ব্যবহার করা যাবে না বলে চা বোর্ড থেকে জানানো হয়েছে।
এ ব্যাপারে দেশের অন্যতম চা নিলামকারী প্রতিষ্ঠান প্রডিউস ব্রোকার্সের জ্যেষ্ঠ ব্যবস্থাপক সুজিত ভট্টাচার্য্য বলেন, নভেল করোনাভাইরাস পরিস্থিতির কারণে ৪৬ ও ৪৭তম নিলাম অনুষ্ঠিত হয়নি। তাছাড়া অনেক ব্রোকার্সের কাছে ৪৫তম নিলামের অবিক্রীত চা-ও আটকে আছে। চা বোর্ড থেকে ৪৫তম নিলাম ও পরবর্তী সময়ে অনুষ্ঠিতব্য দুটি অতিরিক্ত নিলামের চা আউটলট পদ্ধতিতে বিক্রির জন্য নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। তবে ৪৭তম নিলামের ক্যাটালগ না হওয়ায় ৪৭তম নিলামের জন্য প্রস্তুত চা ৪৬তম নিলামের ক্যাটালগভুক্ত করে বিক্রির অনুমতি দেয়া হয়েছে। নতুন মৌসুমের নিলাম কার্যক্রম শুরু না হওয়া পর্যন্ত এভাবেই অবিক্রীত চা বিক্রি হবে বলে জানিয়েছেন তিনি।
প্রসঙ্গত, চলতি নিলামবর্ষের প্রথম নিলাম অনুষ্ঠিত হয় ২০১৯ সালের ৩০ এপ্রিল। প্রথম নিলামে সারা দেশের বাগানগুলো থেকে ৩৯ হাজার ২২০ প্যাকেটে ২১ লাখ ৫১ হাজার কেজি চা বিক্রির জন্য প্রস্তাব করা হয়েছিল। প্রথম নিলামে বিক্রি হওয়া চায়ের গড় দাম ছিল কেজিপ্রতি প্রায় ২৫০ টাকা। তবে বর্তমান পরিস্থিতিতে দেশে চায়ের চাহিদা কমে যাওয়ায় নতুন নিলাম বর্ষে চায়ের গড় দাম আরো কমে কেজিপ্রতি ২০০ টাকার নিচে চলে আসতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন খাতসংশ্লিষ্টরা।