বিপথগামী, শব্দটার সাথে আমরা কম বেশি সবাই পরিচিত। বিশেষ করে যুবসমাজের প্রতি এর ব্যবহার বেশি পরিলক্ষিত হয়। সমাজের মুরব্বীরা যখন দেখে চায়ের দোকানে, পাড়ার মোড়ে, রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে একদল যুবক আড্ডা দিচ্ছে, তখনই মূলত শব্দটার বেশি প্রয়োগ হয়। সমাজে তরুনরা মোটামুটি দুইটি ভাগে বিভক্ত বলা যায়, একভাগ পড়াশোনায় বেশি মনোযোগী, বাবা মায়ের আজ্ঞাবহ। সমাজ এদেরকেই দেশের ভবিষ্যৎ বলে চিন্তা করে ও মানে। অপরদিকে, কিছু তরুণ আছে যারা পড়াশোনায় অতটা মনোযোগী নয়, বাবা মায়ের অবাধ্য সন্তানও বটে। সমাজে এদেরকেই বখে যাওয়া বা বিপথগামী বলে আখ্যায়িত করে। এদের কেউ কেউ আবার বিভিন্ন অপরাধমূলক কাজ কর্মেও জড়িয়ে পড়ে। ইভটিজিং, নেশা, ছিনতাই ইত্যাদির সাথে যুক্ত হয়। এদিক থেকে এদের বিপথগামী বলা একেবারে অযৌক্তিক নয়। সমাজ এদের কাছ থেকে কখনোই ভালো কিছু আশা করেনা। বিশ্বব্যাপী চলছে করোনা ভাইরাসের ভয়াল থাবা। করোনা ভাইরাসের মাধ্যমে আক্রান্ত হচ্ছে কোভিড-১৯ নামে ব্যাধীতে, যার কোনো কার্যকর টিকা এখন পর্যন্ত আবিষ্কার হয়নি। ২০১৯ সালের ৩১ ডিসেম্বরে প্রথম চীনের উহানে এটি ধরা পড়ে। তারপর এখন বিশ্বের প্রায় প্রতিটা দেশে ছড়িয়ে পড়েছে। দেখা দিয়েছে ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয়। বাংলাদেশও এর ভয়াল থাবা থেকে রক্ষা পায়নি। মার্চ মাসের ৮ তারিখে প্রধান করোনা আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হয়। এখন দুই হাজারেরও উপরে রোগী শনাক্ত হয়েছে। বিশ্বব্যাপী ভয়াবহ এই করোনা ভাইরাসের থাবায় যখন বিপর্যস্ত, প্রতিনিয়ত মৃত্যুর মিছিলে যোগ দিচ্ছে হাজার হাজার মানুষ, সেখানে একটি আশার বাণী দেখা দিয়েছে আমাদের দেশে। সেটা হচ্ছে আমাদের তরুণ সমাজ। ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয়ের মধ্যেও এগিয়ে এসেছে আমাদের তরুণ সমাজ। যে ছেলে চায়ের দোকানে আড্ডা দিতো, সেই ছেলেই আজ খোঁজ নিচ্ছে কে না খেয়ে আছে। যে ছেলে রাস্তার মোড়ে দাঁড়িয়ে একসময় মেয়েদের দেখে শিস দিতো, সেই ছেলেই এখন কারো না কারো বাড়িতে বাজার পৌঁছে দিচ্ছে, যাতে সবাই ঘরে থাকতে পারে। যেসব ছেলেদের একসময় কোনো কাজ করতে দেখা যায়নি, তারাই এখন একত্রিত হয়ে করোনা মোকাবেলায় কাজ করছে, সাহায্য করছে স্থানীয় প্রশাসনকে। প্রতিটা খারাপ মানুষের ভিতরেও যে একটা ভালো দিক লুকিয়ে থাকে, সেটা তখনই বেড়িয়ে আসে যখন সমাজের সামনে উপস্থিত হয় ভীষণ বিপদ। শুনেছি ৭১ সালের যুদ্ধে জয়ী হতে শুধু ভালো ছেলেরা, মায়ের বাধ্য ছেলেরাই অস্ত্র হাতে ঝাঁপিয়ে পড়েনি, মায়ের অবাধ্য সন্তানরাও অস্ত্র হাতে ঝাঁপিয়ে পড়েছে দেশমাতৃকাকে রক্ষা করতে। আমারই এক বন্ধুকে দেখেছি অভাবের মধ্যে থাকতে, ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তা করতে। কিন্তু এই বিপদের মুহূর্তে নিজের সামর্থ্য না থাকা সত্ত্বেও অন্যের কাছ থেকে সাহায্য নিয়ে পৌঁছে দিচ্ছে অসহায় দরিদ্রদের কাছে। অন্য মানুষের হয়ে হাত পাতছে সমাজের বিত্তবানদের কাছে। দেশের এই ক্রান্তিলগ্নে বিভিন্ন সংগঠন তাদের সাধ্যমতো কাজ করে যাচ্ছে, যাদের প্রায় সব সদস্যই বয়সে তরুণ। ছেলে মেয়ে নির্বিশেষে কাজ করে যাচ্ছে মানুষের তরে। যে ছেলেটাকে বখাটে বলে জানতাম, সেই ছেলেটাও কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করে যাচ্ছে। এখন আমরা আমাদের তরুণ সমাজকে দুটো ভাগে ভাগ না করে একত্রে বলতেই পারি, "মানবিক তরুণ সমাজ "। যাদের নিয়ে গর্ব করতে পারি। বিশ্বের আকাশে জমে থাকা এই কালো মেঘ থাকবে না, সূর্যের আলোয় দূর হবে সব অন্ধকার। পৃথিবী আবার ভরে উঠবে মানুষের পদচারণায়। দুঃসহ বিপদের মুখেও করোনা আমাদের একটি জিনিস চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়ে গেলো যে, আমরা এখনো স্বপ্ন দেখতে পারি আমাদের এই তরুণসমাজকে নিয়ে, যারা আগামী দিনে দেশের হাল ধরবে। নিঃসন্দেহে বলতে পারি, ভবিষ্যতে যত সংকটই আসুক, আমাদের তরুণ সমাজ কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে সেই সংকটের মোকাবেলা করবে। এমন মানবিক তরুণ সমাজ থাকতে বাংলাদেশের কোনো চিন্তা নেই। পথে পথে থাকবে না আর কোনো ইভটিজিং, বন্ধ হয়ে যাবে ছিনতাই রাহাজানি, আর কোনো মায়ের বুক খালি হবেনা নেশার কালো থাবায়। আমরা স্বপ্ন দেখতেই পারি, নতুন একটা বাংলাদেশের। যে স্বপ্ন দেখতেন আমাদের স্বপ্নদ্রষ্টা জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান। আমরা স্বপ্ন দেখি অন্ধকার কেটে যাবে, গড়ে উঠবে নতুন এক সোনার বাংলা। যেখানে থাকবে না কোনো ভেদাভেদ। কেউ আর উচ্চারণ করবে না "বিপথগামী " শব্দটা।
মোঃ আইনাল হোসেন
শিক্ষার্থী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।