করোনা করুণা করছে না, আপনি কী করছেন?

সান বিডি ডেস্ক প্রকাশ: ২০২০-০৪-২২ ১৫:২৪:৪৪


‘আব্বা, ওই করোনার ঐষোদ (ওষুধ) নাকি পাওয়া যাচ্চে, আমি দুই হাজার টাকা দিলাম এক কবিরাজরে। সত্যি কি পাওয়া যাচ্চে? ঐ বিটা তো দুই দিন ধইরে ফোনও ধত্তেছে না (ধরছে না)…’

যশোরের আঞ্চলিক ভাষায় আমার এক চাচি ফোনের অপর প্রান্তে বলে চলছিলেন, আমি শুনছিলাম শুধু, কারণ বলার মতো কোনো ভাষা পাচ্ছিলাম না। গণমাধ্যমকর্মী হওয়ায় করোনায় স্থবির গোটা দেশের মতো সাধারণ ছুটি নেই, তবে সপ্তাহে দুদিন ছুটি আছে আমার। শনিবার ছুটির দিন অলস দুপুরে, খেয়ে একটু বিশ্রাম নিচ্ছি, তখনই ফোন দিলেন উনি। আর তখন থেকেই ভেবে কূল পাচ্ছি না, এই রকম মহাসংকটকে পুঁজি করে দু পয়সা কামিয়ে নেয়ার মতো নেতিবাচক চিন্তা দুনিয়ার আর কোনো জাতি করতে পারে কি না?

দেশে করোনাভাইরাসের আগমণের পর থেকেই সতর্কতার জন্য সরকার বহু পদক্ষেপ নিয়েছে। অতীত অভিজ্ঞতা বলে, রাষ্ট্রে যেকোনো দুর্যোগ নিয়ন্ত্রণ কিংবা মোকাবিলায় দুটি পক্ষ কাজ করে, একটি সরকার অন্যটি তার নাগরিক। এ দু পক্ষের কার্যকর সমন্বয় ছাড়া সফলতার স্বপ্ন দেখা নিছক বোকামি ছাড়া কিছুই নয়। এই বাস্তবতায় করোনা দুর্যোগে বস্তুত, এখন পর্যন্ত সফলতা খুব বেশি নেই সরকার কিংবা নাগরিক কারোর-ই। সাধারণ ছুটি, আংশিক লকডাউন, কিংবা লকডাউনের মতো, এ ধরনের শব্দগুলো ব্যবহারের মাধ্যমে কার্যত মানুষকে ঘরে রাখার কৌশল কাজে আসেনি। ফলে, করোনা ডেথ টোল শতকের ঘরে পৌঁছানোর পরও বাজারগুলো এখনও রয়ে গেছে ভিড়ে ঠাসা-ই।

এই সংকট মোকাবিলায় সারাবিশ্বই যখন একবাক্যে বলছে ঘরে থাকতে, সেখানে বাংলাদেশের নাগরিক পর্যায়ে তা মানতে এতো অনীহা কেন? একটু ভাবলেই কারণ খুঁজে পেতে খুব একটা বেগ পেতে হবে না কাউকেই। এই মূহুর্তে বাংলাদেশের ১০ শতাংশ জনগোষ্ঠী অতি দরিদ্র, সঞ্চয় বলতে প্রায় কিছুই নেই তাদের। তার অর্থ হলো, বিশ্বব্যাংকের হিসেব মতে এই সোয়া এক কোটি জনগণ, তাদের দৈনিক আয় মাত্র এক ডলার ৯০ সেন্ট-ই উপার্জন করতে পারছে না এখন। আবার দেশে দারিদ্র্যসীমার নিচে প্রায় সাড়ে তিন কোটি মানুষ, যারা আয়ের অর্ধেকের বেশি খরচ করে শুধু খাদ্যগ্রহণ বাবদ। এই শ্রেণির সঞ্চয় নেই তা না, কিন্তু ইকোনমিক্যাল ভ্যালু হিসেবে যা খুবই সামান্য। ফলে দীর্ঘদিন আয় রোজগারের পথ বন্ধ থাকায় তাদের দৈনন্দিন জীবনযাত্রায় এরই মধ্যে মারাত্মক নেতিবাচক প্রভাব পড়তে শুরু করেছে, কিংবা কোনো কোনো ক্ষেত্রে পড়েছেও।

এমনিতেই জাতিসংঘের গ্লোবাল হাঙ্গার ইনডেক্স অনুযায়ী বাংলাদেশে দুই কোটি ৩০ লাখ মানুষ স্বাভাবিক সময়েই অপুষ্টিতে ভোগে। অর্থাৎ, রাস্তাঘাটে হয় খাবার না হয় কাজের সন্ধানে থাকা, সবচেয়ে ভোগান্তিতে পড়া, এই শ্রেণিকেই দৃশ্যমান বড় ঝুঁকিতে ফেলে দিয়েছে করোনা। তাদের জন্যই দরকার সামাজিক সুরক্ষা কার্যক্রমের পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন।

আমাদের ভাবতে হবে এ দেশের কয়েক কোটি মানুষের পেট চলে দৈনিক আয়ের ওপর। একটা কল্যাণ রাষ্ট্র তার নাগরিকরা কে কোথায় থাকেন, কী কাজ করেন, কার মাসিক আয় কত, স্বচ্ছতার সঙ্গেই সেই হিসাব রাখে। বড্ড পরিতাপের বিষয়, স্বাধীনতার ৫০ বছর পরেও বাংলাদেশের কাছে কাটায় কাটায় কোনো পরিসংখ্যান না থাকলেও, কোনো অভাব নেই এই শনৈ শনৈ উন্নয়নের ঘরে সিঁদ কাটার মতো ইঁদুরের। যার প্রমাণ ত্রাণ বিতরণে দেশজুড়ে নানা অনিয়মে যুক্ত হওয়া জনপ্রতিনিধি আর ওই চাচির কবিরাজরা।

ঠিক এই জায়গাটিতেই সবচেয়ে বড় ভূমিকা রাখতে পারতেন আমাদের জনপ্রতিনিধিরা। নিজ এলাকার প্রত্যেকটি মানুষের তালিকা করে কার অর্থনৈতিক অবস্থা কেমন, তা নির্ধারণ করতে পারতেন তারা। এইটা ই পরে ন্যাশনাল ডাটাবেইজকে সমৃদ্ধ করতে পারতো। কিন্তু তারা তা করেননি। ফলে যা হয়েছে, আচমকা ত্রাণ নিয়ে কেউ কেউ এলাকায় যাওয়া মাত্রই দলবেঁধে করোনা সংক্রমনের ঝুঁকি ভুলে পেট বাঁচাতে হুমড়ি খেয়ে পড়ছেন একজন আরেকজনের ওপর।

তাই, রাষ্ট্র হিসেবে সংকটে বাংলাদেশের যেমন দায় রয়েছে প্রত্যেকটি মানুষের ক্ষুধা নিবারণের, তেমনি নাগরিক হিসেবে ১৭ কোটি মানুষেরও দায় রয়েছে বাংলাদেশকে বাঁচিয়ে রাখার। আর তা সম্ভব হতে পারে, নিরাপদে ঘরে থাকার মাধ্যমেই। রাষ্ট্র দায়িত্ব নিক অন্ন সংস্থানের, নাগরিক দায়িত্ব নিক পাশেরজনকেও নিরাপদে রাখার। করোনা সংকট জয় করে সৃষ্টি হোক বিশুদ্ধ এক বাংলাদেশ। ভুলে গেলে চলবে না, দীর্ঘমেয়াদে এই স্থবিরতা, বড় ঝুঁকিতে ফেলে দিতে পারে রাষ্ট্রের পুরো অর্থনৈতিক কাঠামোকেই।

লেখক: গণমাধ্যমকর্মী

সূত্র-ঢাকা টাইমস