বাংলাদেশে বীমা শিল্পের সূত্রপাত স্বাধীনতা-পরবর্তী ১৯৭৩ সালে সাধারণ বীমা ও জীবন বীমা করপোরেশন প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে। বীমা করপোরেশন আইন (ষষ্ঠ) অনুসরণে ১৯৭৩ সালের ১৪ মে এ দুটি করপোরেশন প্রতিষ্ঠা করা হয়। ১৯৮৪ সালে সরকার প্রথমবারের মতো ব্যক্তি খাতকে বীমার সব ক্ষেত্রে ব্যবসার অনুমতি দেয়। এখন বীমা বাজার ৭৮টি কোম্পানির মধ্যে সীমাবদ্ধ। এর মধ্যে রাষ্ট্রায়ত্ত দুটি (সাধারণ বীমা ও জীবন বীমা করপোরেশন) আর ব্যক্তি খাতে ৪৬টি সাধারণ ও ৩২টি জীবন বীমা রয়েছে। ৪৭টি বীমা কোম্পানি শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত এবং এর মধ্যে ১২টি জীবন বীমা কোম্পানিও রয়েছে। নিয়ন্ত্রক সংস্থার কিছু প্রাথমিক আপত্তি সত্ত্বেও সরকার ভারতের রাষ্ট্রায়ত্ত লাইফ ইন্স্যুরেন্স করপোরেশনকে এখানে ব্যবসা করার লাইসেন্স দিয়েছে। জাপানের তাইও লাইফ ইন্স্যুরেন্সকে লাইসেন্স দেয়া হলেও তারা শেষ পর্যন্ত আসেনি। যুক্তরাজ্যের প্রুডেনশিয়াল লাইফ ইন্স্যুরেন্স প্রাথমিকভাবে উৎসাহ দেখালেও পরবর্তীকালে অনুমোদন চায়নি। গ্রীন ডেল্টা জেনারেল ইন্স্যুরেন্সের সম্পৃক্ততায় অর্থ মন্ত্রণালয় একটি সুনির্দিষ্ট জেলায় মানুষকে হেলথ কার্ডের আওতায় আনতে একটি পাইলট কর্মসূচি শুরু করেছে। মাইক্রো-ইন্স্যুরেন্স বিষয়েও আলোচনা সরব আছে। কিন্তু আলোচ্য বিষয়টি এখনো তেমন একটা এগোয়নি।
জীবন ও সাধারণ বীমা মিলিয়ে এখনো বাংলাদেশের বীমা বাজারের পরিসর তেমন বড় নয়, সর্বসাকল্যে প্রিমিয়াম আয় ১২ হাজার ৮৫৬ কোটি টাকা। বিশ্বে বীমা শিল্পে আমাদের অবস্থান ৬৬তম। বলতে গেলে, বৈশ্বিক বীমা শিল্পের তুলনায় বাংলাদেশের বীমা শিল্প খুবই নগণ্য—দশমিক শূন্য ৩ শতাংশ মাত্র। এখানে মাথাপিছু বীমা ব্যয় কেবল ২ দশমিক ৬ মার্কিন ডলার। জিডিপি অনুপাতে বীমা প্রিমিয়াম রয়ে গেছে মাত্র দশমিক ৯ শতাংশে। এর মধ্যে দশমিক ৭ শতাংশ জীবন বীমা এবং বাকি দশমিক ২ শতাংশ সাধারণ বীমা। গত কয়েক বছরে সাধারণ বীমার গড় প্রবৃদ্ধি ছিল ১২ শতাংশ।
আর জীবন বীমার গড় প্রবৃদ্ধি ছিল ২৬ শতাংশ। সাধারণ বীমার ৩৬ শতাংশই শীর্ষ চার কোম্পানি বা করপোরেশনের দখলে। জীবন বীমার ২৯ দশমিক ৬৪ শতাংশই বিদেশী কোম্পানি মেটলাইফের দখলে। দেশে ৫৯টি বাণিজ্যিক ব্যাংক থাকলেও তাদের এখনো ব্যাংক-ইন্স্যুরেন্স (ব্যাংক ও বীমা কোম্পানি অংশীদারিত্বের মাধ্যমে কোনো বীমা প্রডাক্ট বিক্রি) বিক্রির অনুমতি দেয়া হয়নি। সম্প্রতি বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের গবেষণা শাখা ব্যাংক-ইন্স্যুরেন্সের একটি খসড়া গাইডলাইন প্রকাশ করে। ব্যাংক-ইন্স্যুরেন্সের বিভিন্ন দিক ও দায়বদ্ধতা খসড়া আকারে এতে প্রকাশ করা হয়। ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি একাধিক ব্যাংককে এজেন্ট হিসেবে নিয়োগ দিতে পারলেও একটি ব্যাংক কেবল একটি ইন্স্যুরেন্স কোম্পানির এজেন্ট হতে পারবে। ব্যাংক-ইন্স্যুরেন্সের কার্যকারিতা বা সুফল পাওয়ার জন্য একটি ব্যাংকের একাধিক ইন্স্যুরেন্স কোম্পানির এজেন্ট হওয়ার সুযোগ থাকা প্রয়োজন। কেন্দ্রীয় ব্যাংক সতর্কতার সঙ্গে ব্যাংক-ইন্স্যুরেন্স চালুর পরিকল্পনা করছে, যাতে ব্যাংকগুলো অতিরিক্ত ঝুঁকির মুখে না পড়ে। প্রথম পর্যায়ে প্রতিষ্ঠিত ব্যাংক ও ইন্স্যুরেন্স কোম্পানির মাধ্যমে চালুর চিন্তাভাবনাও রয়েছে।
বৈশ্বিক বীমা বাজারে মন্দাবস্থা দেখা দিলেও বাংলাদেশে গত কয়েক বছরে এর দৃশ্যমান প্রবৃদ্ধি লক্ষ করা গেছে। শিল্পায়িত দেশে জীবন বীমায় ৩ দশমিক ৫ ও সাধারণ বীমায় ৬ দশমিক ২ শতাংশ প্রবৃদ্ধি ছিল। অবশ্য বাংলাদেশে জীবন বীমায় ৭ দশমিক ৯ এবং সাধারণ বীমায় প্রবৃদ্ধি ছিল ১২ দশমিক ৮ শতাংশ।
গেল বছরগুলোয় ব্যক্তি খাতের জীবন বীমায় প্রিমিয়াম আয় বৃদ্ধি ও নবায়ন সম্ভব হয়েছে দেশে সুজন, গৃহ সঞ্চয়, গণ, গ্রামীণ, লোক, জন, পল্লী, ইসলামী, ক্ষুদ্র, গ্রুপ ও ওয়েজ আর্নারস গ্রুপ বীমার মতো ক্ষুদ্র বীমা প্রবর্তনে জীবন বীমা ব্যবসা বৃদ্ধির মাধ্যমে। ২০১৪ সালের ডিসেম্বরে লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানির মোট সম্পদের পরিমাণ ছিল ২৬ হাজার ৭৫০ কোটি টাকা। ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানির মোট সম্পদের পরিমাণ দাঁড়ায় ৩৮ হাজার ৭১০ কোটি টাকা। একই সময়ের নন-লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানির মোট সম্পদের পরিমাণ দাঁড়ায় ১১ হাজার ২৯৩ কোটি টাকা।
২০১৪ সালে লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানির মোট বিনিয়োগের পরিমাণ ছিল ১৮ হাজার ৪১১ কোটি টাকা। ২০১৮ সালে এটি দাঁড়ায় ৩১ হাজার ৮১ কোটি টাকা। একই সময়ে নন-লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানির মোট বিনিয়োগের পরিমাণ দাঁড়ায় ৫ হাজার ৯৮৯ কোটি টাকা।
২০১৮ সালের লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানির মোট প্রিমিয়াম আয় দাঁড়ায় ৮ হাজার ৯৯২ কোটি টাকা। একই সময়ে নন-লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানির মোট প্রিমিয়াম আয় দাঁড়ায় ৩ হাজার ৩৯১ কোটি টাকা।
যদিও গত কয়েক বছরে বীমা কোম্পানির সংখ্যা বেড়েছে, তবে অধিকাংশ কোম্পানিই এখনো টিকে থাকার লড়াই করছে। কিছু জীবন বীমা কোম্পানি পল্লী বা মফস্বল এলাকায় নিজেদের অনেক শাখা বন্ধ করে দিয়েছে এবং নতুন প্রতিষ্ঠিত অধিকাংশ শাখা এখন প্রায় নিবু নিবু। এটা নিশ্চিত যে ভবিষ্যতে বৈশ্বিকভাবে প্রতিষ্ঠিত বীমা কোম্পানির সঙ্গে প্রতিযোগিতায় টিকতে না পেরে অধিকাংশ ছোট ও অসংগঠিত কোম্পানির পরিচালনা ক্রমেই কঠিন হবে। বহির্বিশ্ব বিশেষ করে প্রতিবেশী দেশ কিংবা অন্য একই ধরনের দেশে যা ঘটছে, তা বিবেচনায় নিলে আমাদের বীমা খাতের আরো দীর্ঘ পথ পাড়ি দিতে হবে। প্রিমিয়াম সংগ্রহ, পুনর্বীমা, দাবি নিষ্পত্তিসহ কিছু বিষয়ে বড় দুর্নীতির অভিযোগ আছে। অনেক মালিকই মিথ্যা দাবি সাজিয়ে পূর্বতন তারিখে কাভার নোট ইস্যু এবং অন্য অন্যায্য প্রভাবের মাধ্যমে সুনির্দিষ্ট বীমা গ্রাহকের অর্থ আত্মসাৎ করছে। সেখানে অভ্যন্তরীণ বাণিজ্য, পরিচালক কর্তৃক ম্যানিপুলেশন এবং নিয়ন্ত্রণহীনতার অনেক দৃষ্টান্ত রয়েছে। বীমা শিল্পে জনশক্তির মান খুবই দুর্বল এবং তাদের উন্নয়নে তেমন বিনিয়োগ কিংবা সংশ্লিষ্ট মহলের নজর দৃশ্যমান নয়। এমনকি কিছু কোম্পানির কর্তারা তাদের ইচ্ছানুযায়ী কাজ না করায় রাজনৈতিক মহলের যোগসাজশে নিয়ন্ত্রকদের হয়রানি বা বিব্রত করারও চেষ্টা করেছেন। গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদন অনুযায়ী জীবন বীমা ও সাধারণ বীমা কোম্পানির পরিচালনায় ব্যাপক অনিয়ম পাওয়া গেছে। প্রবাসী শ্রমিক-রেমিট্যান্স প্রেরণকারী থেকে কৃষিজীবীসহ বিপুলসংখ্যক জনগোষ্ঠী এখনো বীমার আওতার বাইরে রয়ে গেছে।
সময় এসেছে ঘুরে দাঁড়ানোর এবং সামনে এগিয়ে যাওয়ার। সঠিক ও যুগোপযোগী নীতি প্রণয়ন, আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার, সঠিক পরিচালনা পদ্ধতি ইত্যাদির মাধ্যমে বীমা শিল্প এগিয়ে যেতে পারে বহুদূর। ব্যাংক, মোবাইল ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস এবং অন্যান্য বিতরণ ব্যবস্থার মাধ্যমে দেশের সব শ্রেণীর মানুষের মাঝে বীমা সেবা পৌঁছে দেয়াও সম্ভব। কৃষি ও গবাদি পশু বীমা কৃষিনির্ভর বাংলাদেশে তৈরি করতে পারে অপার সম্ভাবনার। বীমা সম্পর্কে জনসচেতনতা সৃষ্টির জন্য একযোগে সবার কাজ করতে হবে। সম্মিলিত প্রচেষ্টার মাধ্যমেই কেবল সম্ভব বীমা শিল্পের উন্নয়ন, তথা দেশের উন্নয়ন।
সানবিডি/এসকেএস