ফেসবুক খুললেই ছবিতে দেখা যায় বিভিন্ন স্থানে রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মী এমপিরা বোরো ও ইরি ধান কেটে দিচ্ছেন কৃষকের। তাদের অনেকের পরনে দামি প্যান্ট, ঘড়ি, জুতা ,শার্ট কিংবা টি-শার্ট। এ কাজে নেমেছেন মহিলা সংরক্ষিত আসনের এমপিরাও। এক জন নেতা ধান কাটতে গেলে সাথে ১০ জন যাচ্ছেন ছবি তুলতে। কৃষকের ক্ষেতে বসেই মোবাইলে লাইভ দিতে ও ছবি তুলতে গিয়ে নষ্ট করছেন কৃষকের কষ্টার্জিত ফসল। আবার অনেকে কাটছেন কাঁচা ধান। সস্তা বাহবা নেওয়ার জন্য কেউ কেউ সংবাদ মাধ্যমেও এসব ছবি ও নিউজ পাঠাচ্ছেন। আমরা সংবাদকর্মীরাও অনেকে তা প্রচার করছি।
প্রশ্ন হচ্ছে – এই পোশাক পরিধান করে তারা কৃষকের জমির কতটুকু ধান কেটেছেন কিংবা মাড়াই করেছেন? এ ধরণের পোশাক পরে সত্যিই কি ধান কাটা সম্ভব? এতে কৃষকের আদৌ কোন লাভ হয়েছে?
সচেতন নাগরিকরা এসব প্রশ্ন তুলছেন অনেকে।
আক্ষেপ করে মঙ্গলবার (২৮ এপ্রিল) বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের কোষাধ্যক্ষ দীপ আজাদ তার ব্যক্তিগত ফেসবুকে লেখেন, একজনের ধান কাটার ছবি তুলতে গেলেন ১০ জন। ধানক্ষেতের যে বারোটা বাজালেন, এই ক্ষতিপূরণ করবে কে?
খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-পরিচালক গাজী আলাউদ্দিন আহমদ তার ফেসবুকে লিখেছেন, ধান কাটা, একটি উদ্যোগকে যেভাবে বিতর্কিত করে ‘উৎসবপ্রিয়’ বাঙালি!
তবে কেউ কেউ ঠিকই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আহবানে সাড়া দিয়ে বিনা পারিশ্রমিকে জমিতে থাকা কৃষকের পাকা ধান কেটে বাড়ি পৌঁছে দিচ্ছেন সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে। এর সংখ্যা অতি নগণ্য। তারা সাধুবাদও পাচ্ছেন মানুষের।
করোনাভাইরাসে কৃষি খাতের ক্ষতি মোকাবেলায় কৃষকের জন্য ৫০০০ কোটি টাকার বিশেষ প্রণোদনা ঘোষণা করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এ তহবিল থেকে সহজ শর্তে মাত্র ৪ শতাংশ সুদে ঋণ নিতে পারবেন কৃষক। কৃষক বাঁচানোর জন্য সরকারের আন্তরিকতার কোন ঘাটতি না থাকলেও সরকার দলের কিছু কান্ডজ্ঞানহীন নেতাকর্মী ও এমপির ফটোসেশনে নষ্ট হচ্ছে সরকারের ইমেজ।
কষ্টার্জিত ধানগুলো গোলায় তোলার স্বপ্ন যারা দেখছেন তাদের সাথে মশকরা না করাই ভালো। তারা রয়েছেন চরম অনিশ্চয়তায়। বৈশ্বিক মহামারি করোনাভাইরাসের কারণে ধান কাটা-মাড়াইয়ের শ্রমিক সঙ্কটে পড়েছেন তারা।
দেশ, মাটি, মানুষ আর গ্রামকে সুন্দর ও সঠিকভাবে ধরে রাখতে হলে অবশ্যই কৃষি ও কৃষকদের অধিকার মর্যাদা রক্ষা করতে হবে। সমাজের অন্য শ্রেণি-পেশার মানুষের মতো তাদের সম্মান দিতে হবে। কৃষিকে উৎসাহিত ও উৎপাদন দ্বিগুণ এবং স্বয়ংসম্পূর্ণ করতে হলে কৃষকের অধিকার প্রতিষ্ঠার বিকল্প নেই।
বাংলাদেশ কৃষিপ্রধান দেশ। আমাদের দেশের ৮৫ ভাগ মানুষ কৃষি কাজের উপর নির্ভরশীল। দেশের সরকার ও বিরোধীদলীয় নেতা থেকে প্রশাসনের বিভিন্ন সেক্টরে যারা আজকে প্রতিষ্ঠিত নেতা ও কর্মকর্তা সবাই এক সময় কৃষি ও কৃষকের পরিবারে জন্ম নিয়েছিল। দেশের প্রত্যন্ত জমিতে এখনো কৃষকরা মাথার ঘাম পায়ে ফেলে কৃষিপণ্য উৎপাদন করে দেশ জাতিকে সচল রাখছে। আমি ও আমরা কৃষকের সন্তান, কৃষি কৃষকের পরিবার থেকে আমাদের জন্ম ও বেড়ে ওঠা হলেও সেই ইতিহাস আমরা অনেকেই ভুলে যেতে বসেছি।
যে কৃষক বাংলাদেশকে ‘খাদ্যে’ স্বনির্ভর করেছেন, তার দারিদ্র্যদশা কখনোই দূর হয় না। অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি বাড়ে, মাথাপিছু আয় বাড়ে, বৈদেশিক মুদ্রার মজুত বাড়ে, কিন্তু কৃষকের কোনো উন্নতি হয় না। কৃষিতে বিপ্লব ঘটে গেছে, ফলন বেড়ে বহুগুণে। কিন্তু কৃষকের অবস্থার উন্নতি ঘটেনি।
কারণ, কৃষক তার উৎপন্ন ফসলের এমন দাম পান না, যা দিয়ে তার সারা বছরের সাংসারিক ব্যয় নির্বাহের পর কিছু টাকা তিনি জমাতে পারেন। যখন ফসলের ফলন খুব ভালো হয়, যাকে বলে বাম্পার ফলন, তখন সেই ফসলের দাম পড়ে যায়। কখনো কখনো এমন অবস্থাও হয় যে ফসল বিক্রি করে উৎপাদন খরচও ওঠে না। তাই বাম্পার ফলন সরকারের জন্য সুসংবাদ বয়ে আনলেও কৃষকদের দুশ্চিন্তার কারণ হয়।
আধুনিক কৃষির প্রয়োজনীয় প্রায় সব যন্ত্রই দেশের ছোট কৃষক ও বর্গাচাষিদের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে। আসুন কৃষকের এই দুরবস্থায় সেচ পাম্প ছাড়াও থ্রেসার, কম্বাইন্ড হারভেস্টারের মতো আধুনিক কৃষি যন্ত্রগুলো যেন বর্গাচাষিসহ প্রকৃত কৃষকরা কিনতে পারে সে জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহন করি। কৃষকের ক্ষেতে শুধু ফটোসেশন না করে তাদের এসব প্রয়োজনী জিনিসের ব্যবস্থা করুন।
লেখক: মাহবুবুর রহমান মুন্না
খুলনা ব্যুরো এডিটর, বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
ও সহকারী সম্পাদক, খুলনা প্রেসক্লাব