হাওড় অঞ্চল হিসেবে খ্যাত দেশের সাত জেলা।এসব জেলায় দুই ধরনের জমিতে বোরো আবাদ হয়ে থাকে। এক ধরনের জমি হচ্ছে মূল হাওড়, অন্যগুলো অপেক্ষাকৃত উঁচু সমতল ভূমি। এরই মধ্যে মূল হাওড়ের ৯০ শতাংশ ধান কাটা হয়ে গেলেও বিপত্তি বেধেছে সমতলের ধান কাটায়। পাকতে বেশি সময় লেগে যাওয়ায় সেখানে এখন পর্যন্ত মাত্র ২৫ শতাংশ ধান কাটা হয়েছে, যা উদ্বেগ বাড়াচ্ছে কৃষকের।
এ ব্যাপারে কৃষকরা জানান, হাওড়াঞ্চলের সমতল ভূমির অধিকাংশ জমিতে আবাদ হয়েছে নাবি জাতের ব্রি ধান-২৯। এগুলো পরিপক্ব হতে এখনো দুই সপ্তাহ লাগতে পারে। এদিকে রয়েছে আগাম বৃষ্টিপাতের পূর্বাভাস। এ কারণে ধান ঘরে তোলা নিয়ে শঙ্কায় আছেন কৃষক।
বোরো মৌসুমে মেগা জাত হিসেবে অনেক আগেই স্বীকৃতি পেয়েছে ব্রি ধান-২৯। হেক্টরপ্রতি সাড়ে সাত টনের বেশি ফলন এবং সেই সঙ্গে পাতা পড়া ও খোল পোড়া রোগ প্রতিরোধী হওয়া জাতটি বোরো মৌসুমে সবচেয়ে বেশি আবাদ হয়ে থাকে। নাবি জাতের ধানটি ১৯৯৪ সালে বাংলাদেশ ধান গবেষণা প্রতিষ্ঠান (ব্রি) কর্তৃক উদ্ভাবনের পর অবমুক্ত করা হয়। তবে জাতটি হেক্টরপ্রতি ভালো ফলন দিলেও পরিপক্ব হতে ১৬০ দিনের মতো সময় নেয়। ১৭ কার্তিক থেকে ১৭ অগ্রহায়ণের সময় বীজতলায় বীজ বপন করা গেলে ২৫ বৈশাখের পর থেকে জ্যৈষ্ঠ মাসের ৬ তারিখে ধান ঘরে ওঠানো সম্ভব হয়। অর্থাৎ যদি কেউ নভেম্বর মাসের শুরুতে বীজ বপন করে, তাহলে সেই ধান কাটতে এখনো চার-পাঁচদিন লাগার কথা। তবে হাওড় অঞ্চলের কৃষকরা জানিয়েছেন, তারা একটু দেরিতেই আবাদ করেছেন এবার। ফলে ধান পরিপক্ব হতে আরো সময় লাগতে পারে।
সুনামগঞ্জের দিরাই উপজেলার বরাম হাওড়ের কৃষক আমিন উদ্দিন চৌধুরী তপু বলেন, তিনি হাওড়সহ ২৮ হেক্টর জমিতে ব্রি ধান-২৯ জাতের ধান চাষ করেছেন। কিছু জমিতে ধান পাকতে শুরু করেছে, যা ১০ থেকে ১২ দিন পর কাটা সম্ভব হবে, তার আগে নয়।
এ কৃষক আরো জানান, এ বছর ব্রি ধান-২৯ জাতের ধানের ফলন কম হয়েছে। সময়মতো বৃষ্টিপাত হয়নি। তাই ধানের ছড়ায় চুচা বেশি। আগাম বন্যা হলে অপরিপক্ব ধান কেটে আনা ছাড়া কোনো উপায় থাকবে না।
কৃষি মন্ত্রণালয় সূত্র জানিয়েছে, হাওড়ভুক্ত সাত জেলা কিশোরগঞ্জ, নেত্রকোনা, সুনামগঞ্জ, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, সিলেট ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় (হাওড় ও সমতল ভূমি) এবার মোট বোরো আবাদের পরিমাণ ৯ লাখ ৩৬ হাজার ৩২০ হেক্টর। এর মধ্যে মূল হাওড়ে বোরো আবাদ হয়েছে ৪ লাখ ৪৫ হাজার ৩৯৯ হেক্টর। গত ৪ মে সোমবার পর্যন্ত এসব অঞ্চলের ধান মোট কাটা হয়েছে ৪ লাখ ৯৬৪ হেক্টর, যা হাওড়ভুক্ত মোট আবাদের ৯০ দশমিক শূন্য ২ ভাগ।
চলতি সপ্তাহের শেষে ও আগামী সপ্তাহের শুরুতে হাওড়াঞ্চলে ১৫০ থেকে ২৫০ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হতে পারে বলে পূর্বাভাস রয়েছে। বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের সুনামগঞ্জের নির্বাহী প্রকৌশলী মোহাম্মদ সবিবুর রহমান বলেন, এই বৃষ্টিপাতে হাওড়ে জলাবদ্ধতা দেখা দেয়ার সম্ভাবনা আছে। বৃষ্টির আগে ব্রি ধান-২৯ কাটা নিয়ে সংশয়ে রয়েছেন কৃষিমন্ত্রী ড. মো আবদুর রাজ্জাকও। গতকাল সাংবাদিকদের সঙ্গে অনলাইনে মতবিনিময়কালে তিনি বলেন, হাওড়ভুক্ত এলাকাগুলোয় অধিক জীবত্কালসম্পন্ন ব্রি ধান-২৯ (জীবত্কাল ১৬৫ দিন) ধানের আবাদ থাকায় কর্তনে কিছুটা বিলম্বিত হচ্ছে। মূল হাওড়ে বা নিচু এলাকায় এরই মধ্যে ৯০ ভাগ ধান কর্তন শেষ হয়েছে। এখানকার অবশিষ্ট ১০ ভাগ এ সপ্তাহের মধ্যে কাটা সম্পন্ন হবে। তবে হাওড়বহির্ভূত এলাকায় কিছুটা ঝুঁকি থাকলেও যন্ত্র পৌঁছানো হয়েছে। পরিপক্বতার সঙ্গে সঙ্গেই ধান কাটার ব্যবস্থা রাখা হয়েছে।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের সূত্রে জানা গেছে, আবহাওয়া অনুকূল থাকায় হাওড়ে ধানের ফলন লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে যাবে। এবার জেলায় ৬৭ হাজার ৭৯১ হেক্টর জমিতে ব্রি ধান-২৯ জাতের ধানের আবাদ হয়েছে। এর মধ্যে হাওড়ে ৪২ হাজার ১৯০ হেক্টর এবং হাওড়ের বাইরে ২৫ হাজার ৬০১ হেক্টর জমিতে আবাদ হয়েছে। প্রতি হেক্টরে ধানের ফলন ধরা হয়েছে সাড়ে ৬ টন। হাওড়াঞ্চলে ব্রি ধান-২৯ জাতের ধান কাটতে সময় লাগতে পারে ১০ থেকে ৩০ মে পর্যন্ত।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক মোহাম্মদ সফর উদ্দিন এ বিষয়ে বলেন, মূল হাওড়ে ধান কাটা প্রায় শেষ পর্যায়ে। চেষ্টা করছি কৃষকদের সব ধরনের সহায়তা প্রদানের মাধ্যমে সময়মতো কৃষিযন্ত্র ও শ্রমিক পৌঁছানো। সব মিলিয়ে ৭০ ভাগ ধান কাটা শেষ। তবে জেলার কয়েক জায়গায় ব্রি ধান-২৯ জাতের ধান একটু দেরিতে পাকতে পারে। আগামী সপ্তাহের মধে হাওড়ে ধান কাটা শেষ করতে প্রচেষ্টা থাকবে।