করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকাতে দেশে আনুষ্ঠানিকভাবে লকডাউন না ঘোষণা করলেও বারবার বারবার সাধারণ ছুটি বাড়িয়েছে সরকার।গার্মেন্টস কারখানাগুলো খোলার পর সেই অঘোষিত লকডাউন ভেঙে পড়েছে। আর এতে সংক্রমণের ঝুঁকি বাড়বে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। ‘লকডাউন’ শিথিল করার ফলে সরকারের সামনেও এসেছে বেশকিছু চ্যালেঞ্জ।
বিবিসি বাংলার প্রতিবেদনে বলা হয়, সরকার সীমিত পরিসরে গার্মেন্টস কারখানা খুলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিলে দেশের নানা প্রান্ত থেকে হাজার হাজার শ্রমিক ঢাকায় ছুটে আসেন। গাদাগাদি করে তাদের আসার সেই অভাবনীয় দৃশ্য নিয়ে অনেক আলোচনা-সমালোচনা হয়েছে। দেশে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ যখন বাড়ছে, তখন গার্মেন্টস কারখানা চালু করার পর বিভিন্ন ক্ষেত্রে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়ায় লকডাউনের কার্যকারিতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
অর্থনীতিকে চাঙ্গা রাখার জন্যই সরকার সীমিত পরিসরে গার্মেন্টস কারখানা, শিল্প কারখানা বা ব্যবসা চালু করার কথা বলা হলেও তা সীমিত রাখা সম্ভব হচ্ছে না। অনেক কারখানার মালিকই আগের মতো করে পুরো তাদের কারখানা চালু করছেন, ফলে শ্রমিকের সমাগমও বেশি হচ্ছে। আবার অনেক কারখানায় শ্রমিকের করোনাভাইরাস সংক্রমণের ঝুঁকির প্রশ্ন উঠেছে।
‘লকডাউন’ শিথিল শুধু গার্মেন্টস খোলার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকেনি। একের পর এক শিল্পকারখানা এবং দোকান বা ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান খুলে দিয়ে দ্রুততার সঙ্গে নানামুখী অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড শুরু করার একটা চেষ্টা দেখা যাচ্ছে।
স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, লকডাউন ভেঙে পড়ায় হাজার হাজার মানুষের সংক্রমণের ঝুঁকি তৈরি হয়েছে। সেই পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার জন্য চিকিৎসার পর্যাপ্ত ব্যবস্থা করাও সম্ভব হয়নি বলেও তারা মনে করেন।
তাহলে এই ‘লকডাউন’ ভেঙে পড়ায় বাংলাদেশের সামনে এখন কোন পথ খোলা আছে, কী করণীয় আছে তা নিয়ে চলছে বিস্তর আলোচনা।
সরকারি গবেষণা সংস্থা বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা কেন্দ্রের (বিআইডিএস) সিনিয়র গবেষক নাজনীন আহমেদ বলেন, ‘এখন অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড শুরু করা ছাড়া বিকল্প নেই।’ তবে তাড়াহুড়ো না করে পরিকল্পনার প্রয়োজন ছিল বলে তিনি মনে করেন।
তিনি বলেন, ‘এখন কোনো অবস্থাতেই জীবন আর জীবিকাকে আলাদা করে দেখার উপায় নাই। আমি যদি বলি শুধু জীবন রক্ষা করবো, কি করে করবো-কোটি কোটি মানুষ, এত মানুষের খাবারের সংস্থান আমি কি করে করবো? সুতরাং সেই জায়গাটাতে চিন্তা করলে আমাকে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে যেতে হবে।’
নাজনীন আহমেদ বলেন, ‘লকডাউন অবস্থা থেকে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে কতটা যাবো, সেটা নির্ভর করবে আমি অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড শুরু করার ফলে বাড়তি যে স্বাস্থ্য ঝুঁকিটা তৈরি হলো বা সহজ কথায় বললে বাড়তি যে করোনা রোগী আসার সম্ভাবনা তৈরি হলো, সেটা সামাল দেওয়ার মতো স্বাস্থ্য সুবিধা আমার আছে কি না-এটা দৃষ্টিভঙ্গি হওয়ার দরকার ছিল।’
তিনি বলেন, ‘মুশকিলটা হচ্ছে, দেড়মাস পর এখন যে গতিতে আমরা সবকিছু খুলে দিতে চাচ্ছি, সেই অবস্থায় কিন্তু আমাদের স্বাস্থ্য ঝুঁকি সামাল দেওয়ার ক্ষমতা আমরা বাড়াইনি।’
বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব হেলথ সাইন্সের শিক্ষক নাদিরা পারভিন বলেন, ‘এখন দিন দিন সংক্রমণ যখন বাড়ছে, তখন আরেকটু সময় নেওয়া উচিত ছিল। এখনই সময় হয়নি সবকিছু খুলে দেওয়ার।’
যখন লকডাউন ভেঙে পড়েছে তখন সংক্রমণ বেশি হচ্ছে। লকডাউন ভেঙে পড়ায় সংক্রমণে বিপর্যয় দেখা দিতে পারেও বলে মনে করছেন অনেকে।
করোনাভাইরাস প্রতিরোধ সংক্রান্ত জাতীয় কমিটির উপদেষ্টা অধ্যাপক এবিএম আব্দুল্লাহ বলেন, ‘যেহেতু অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড সচল করা হয়েছে। এখন এর প্রভাবে সংক্রমণ বেড়ে গেলে আবারও কঠোর লকডাউন এমনকি প্রয়োজনে কারফিউ দেওয়া ছাড়া অন্য উপায় থাকবে না।’
তিনি বলেন, ‘এখন করোনার ঝুঁকি প্রতিদিনই বাড়ছে। এই অবস্থায় লকডাউন শিথিল করা হয়েছে। এখন সরকারের প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত এটা। তারা হয়তো অর্থনৈতিক দিকটা বেশি বিবেচনা করেই লকডাউন শিথিল করেছে। তবে শর্ত দিয়ে দিয়েছে। কিন্তু ভয় হলো যদি আক্রান্তের সংখ্যা বেড়ে যায়, তাহলে ঝুঁকির মধ্যে পড়বো আর কি।’
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক আবুল কালাম আজাদও সংক্রমণ বাড়লে সরকার লকডাউন কঠোর করবে বলে জানিয়েছেন।
তিনি বলেন, ‘লকডাউনের কারণে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড যেহেতু বন্ধ, বিশেষ করে নিম্ন আয়ের মানুষ যারা দিন আনে দিন খায়, তাদের কাজ বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। কতদিন আর এভাবে সবকিছু বন্ধ করা যাবে। কাজেই সরকারের সকল মহলে একসঙ্গে আলোচনা করে মনে করা হয়েছে যে, আমরা কিছুটা শিথিল করি। অবশ্যই এই শিথিলের সঙ্গে সঙ্গে মানুষকে সতর্ক হতে হবে এবং মানুষকে আমরা সেই পরামর্শ দিচ্ছি।’
তিনি বলেন, ‘লকডাউন শিথিল করার পাশাপাশি আমরা পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করবো। যদি সংক্রমণের সংখ্যাটা খুব বেশি বেড়ে যায়, তাহলে অবশ্যই আবার লকডাউন কঠোর করতে হবে। সে ব্যাপারে সরকার সজাগ রয়েছে বলে আমরা মনে করি।’
অধ্যাপক আবুল কালাম আজাদ জানিয়েছেন, বাংলাদেশে যদি করোনাভাইরাস সংক্রমণের পরিস্থিতি খুব খারাপ হয় তবে একদিনে ৬৫ হাজার করে আক্রান্ত হতে পারেন। তাদের কাছে এমন একটি বিশ্লেষণ রয়েছে বলে তিনি জানান।
তিনি বলেন, ‘আমাদের জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা আমাদের কাছে দুই ধরনের বিশ্লেষণ দিয়েছেন। তাদের বিশ্লেষণ হচ্ছে, যদি খুব খারাপ পরিস্থিতি হয়, তাহলে একদিনে সর্বোচ্চ ৬৫ হাজারের মতো মানুষ সংক্রমিত হতে পারে। যদি আমরা সেটাও মাথায় রাখি, তাহলে কিন্তু তার পাঁচ ভাগের এক ভাগকে হাসপাতালে ভর্তি করার প্রয়োজন হতে পারে। এটা যদি হয়, তাহলে আমাদের ১২ থেকে ১৩ হাজারের মতো মানুষকে হাসপাতালে ভর্তি করতে হতে পারে।’
সানবিডি/ঢাকা/এসএস