চলতি ফলের মৌসুমে সারাদেশে প্রায় ৪৮ লাখ ৫০ হাজার টন ফল উৎপাদনের আশা করছে কৃষি মন্ত্রণালয়। উৎপাদন আশানুরূপ হলেও করোনা পরিস্থিতিতে এসব ফলের বিপণন নিয়ে বাড়ছে দুশ্চিন্তা। চাষীদের সেই চিন্তা দূর করতে আট দফা কর্মসূচি বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিয়েছে মন্ত্রণালয়।
এ ব্যাপারে কৃষি মন্ত্রণালয়ের প্রক্ষেপণ বলছে, চলতি মৌসুমে ২২ লাখ ৩২ হাজার টন আম, ২ লাখ ৩২ হাজার টন লিচু, ১৮ লাখ ৮৯ হাজার টন কাঁঠাল ও ৪ লাখ ৯৭ হাজার টন আনারস উৎপাদন হবে। কিন্তু চলমান করোনা পরিস্থিতিতে দেশব্যাপী যানবাহন চলাচল বন্ধ থাকায় মাঠ পর্যায়ে ফল ব্যবসায়ী ও আড়তদারদের আনাগোনা নেই বললেই চলে, যার কারণে উৎপাদিত ফল বিক্রি করতে পারছেন না তিন পার্বত্য জেলাসহ দেশের অন্যান্য অঞ্চলের ফলচাষীরা। এ অবস্থায় বিপণন বাধাহীন করতে আট দফা উদ্যোগ নেয়ার কথা জানিয়েছেন কৃষিমন্ত্রী ড. মো. আবদুর রাজ্জাক।
মৌসুমি ফল এবং কৃষিপণ্য বাজারজাতের বিষয়ে সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে শনিবার অনলাইনে (জুম প্লাটফর্ম) মতবিনিময় সভায় মন্ত্রী বলেন, করোনার প্রভাবে বাংলাদেশের শাকসবজি ও মৌসুমি ফলসহ কৃষিপণ্যের পরিবহন এবং বাজারজাতে বিরূপ প্রভাব পড়ছে। কৃষকরা তাদের উৎপাদিত কৃষিপণ্য বিক্রি করতে পারছেন না। কৃষিপণ্যের চাহিদা হ্রাস পেয়েছে, ফলে পাইকার ও আড়তদাররা কৃষিপণ্য ক্রয়ে আগ্রহ হারাচ্ছেন। কৃষিপণ্য পরিবহন শেষে ট্রাক খালি ফেরার আশঙ্কায় ভাড়া দ্বিগুণ হয়ে যাচ্ছে। এসব কারণে ক্ষেতেই নষ্ট হচ্ছে বেশির ভাগ উৎপাদিত ফল ও সবজি। করোনা উদ্ভূত পরিস্থিতিতে কৃষিপণ্যের বিপণন এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
করোনার কারণে তরমুজ চাষরা উৎপাদিত তরমুজের অধিকাংশই বিক্রি করতে পারেননি জানিয়ে ড. মো. আবদুর রাজ্জাক বলেন, কিছু বিক্রি করেছেন, তবে তার ভালো দাম পাননি কৃষক।
এরই মধ্যে আম, লিচু, আনারস, কাঁঠালসহ মৌসুমি ফল বাজারে আসতে শুরু করেছে। এসব মৌসুমি ফল সঠিকভাবে বাজারজাত না করা গেলে চাষীরা আর্থিকভাবে চরম ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। দেশের অধিকাংশ মানুষ সুস্বাদু ও পুষ্টিকর মৌসুমি ফল খাওয়া থেকে বঞ্চিত হবে। অথচ এ সময়ে করোনা মোকাবেলায় দৈহিক রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধিতে পুষ্টিকর মৌসুমি ফল গ্রহণ করা অত্যন্ত জরুরি। তাই কৃষি মন্ত্রণালয় ভোক্তাদের কাছে সরাসরি ফল পৌঁছে দেয়া, প্রক্রিয়াকরণে ফলগুলোকে নিরাপদ রাখা, পরিবহন ব্যয় কমানো ছাড়াও কৃষকের ন্যায্য দাম নিশ্চিত করতে কাজ করবে।
শনিবারের অনলাইন মতবিনিময় সভায় সাবেক ও বর্তমান মিলে সাতজন মন্ত্রী ও প্রতিমন্ত্রী যুক্ত ছিলেন। জাতীয় সংসদের হুইপ ইকবালুর রহিম, সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির সভাপতি ডা. আ ফ ম রুহুল হক ছাড়াও বিভিন্ন এলাকার সংসদ সদস্য, বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. আতিউর রহমান, কৃষি ও গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব শাইখ সিরাজ, জাতিসংঘের কৃষি ও খাদ্য সংস্থার বাংলাদেশ প্রতিনিধি রবার্ট সিম্পসন সংযুক্ত ছিলেন। সভাটি সঞ্চালনা করেন কৃষি মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. নাসিরুজ্জামান।
সভায় থেকে কৃষি মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে জানানো হয়, স্বাস্থ্যবিধি মেনে অন্যান্য জেলা থেকে ব্যবসায়ী, আড়তদার ও ফড়িয়াদের যাতায়াত নির্বিঘ্ন করা, স্বাস্থ্য পরীক্ষার প্রত্যয়নপত্র প্রদান ও নিরাপদ আবাসনের ব্যবস্থা নেয়া হবে। মৌসুমি ফল ও কৃষিপণ্য পরিবহনে দেশের বিভিন্ন এলাকায় ট্রাক ও অন্যান্য পরিবহনের অবাধে যাতায়াত নির্বিঘ্ন করা এবং পরিবহনের সময় যাতে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর মাধ্যমে কোনো রূপ হয়রানির শিকার না হয়, সে ব্যবস্থা করা হবে। ফল পরিবহনে বিআরটিসির ট্রাক ব্যবহার ও স্থানীয়ভাবে ব্যাংকের লেনদেনের সময়সীমা বাড়ানো হবে। পার্সেল ট্রেনে মৌসুমি ফল এবং কৃষিপণ্য পরিবহনের আওতা বাড়ানো ও হিমায়িত ওয়াগন ব্যবহার করা যায় কিনা ভাবা হবে। ফিরতি ট্রাকের বঙ্গবন্ধু সেতুতে টোল হ্রাস করা এবং ত্রাণ হিসেবে নিত্যপ্রয়োজনীয় সামগ্রীতে আম, লিচুসহ মৌসুমি ফল অন্তর্ভুক্ত করার জন্য দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্টদের কাছে অনুরোধ করা হবে। এছাড়া অনলাইনে ও ভ্যানযোগে ছোট ছোট পরিসরে কেনাবেচার জন্য উদ্যোগ গ্রহণ করা হবে। দেশীয় প্রক্রিয়াজাত কোম্পানিগুলো ও স্থানীয় প্রতিষ্ঠান যারা কৃষিপণ্য প্রক্রিয়াজাত করে জুস, ম্যাঙ্গোবার, আচার, চাটনি প্রভৃতি তৈরি করে, তাদের এ বছর বেশি বেশি আম-লিচু কেনার অনুরোধ জানানো হবে। মৌসুমি ফলে যেন কেমিক্যাল ব্যবহার করা না হয়, সেজন্য জেলা প্রশাসন সমন্বিতভাবে মনিটরিং কার্যক্রম জোরদার করবে। চলতি মৌসুমে সফলভাবে ফল বিপণন ও কৃষকের ন্যায্য দাম নিশ্চিত করতে পারলে মৌসুম শেষে বিশেষ প্রণোদনা পাবেন প্রক্রিয়াজাত কোম্পানি, অনলাইন মার্কেট, পরিবহন ও সুপারশপ এবং সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীরা।
কৃষি মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির সভাপতি ও সাবেক কৃষিমন্ত্রী বেগম মতিয়া চৌধুরী বলেন, ট্রাকসহ অন্যান্য পরিবহনের যাতায়াত নির্বিঘ্ন করতে হবে। ট্রাকের জ্বালানির ক্ষেত্রে ভর্তুকি দেয়া যেতে পারে, যাতে ট্রাকের ভাড়া কম হয়। পুলিশ ব্যারাক, সেনাবাহিনীর ব্যারাক, হাসপাতাল, জেলখানাসহ বিভিন্ন সরকারি অফিসে কৃষকের কাছ থেকে আম কিনে সরবরাহ করা গেলে আমের বাজারজাত কোনো সমস্যা হবে না। পাশাপাশি এ সংকটের সময় কৃষকের উৎপাদিত পণ্যের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করতে হবে।
খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার বলেন, ব্যবসায়ী, আড়তদার ও ফড়িয়াদের যাতায়াত নির্বিঘ্ন করতে পরিচয়পত্র ইস্যু করতে হবে। ব্যাংকের লেনদেনের সময়সীমা বাড়াতে হবে। এ মধু মাসে বিদেশী ফল আমদানি কমানোর পদক্ষেপ নেয়া যেতে পারে।
করোনার সময়ে সব ধরনের কার্গো লঞ্চ চালু আছে জানিয়ে নৌ-পরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী বলেন, শুধু আম-লিচু নয়, সব মৌসুমি ফলের বাজারজাতের ব্যবস্থা নিতে হবে। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে সম্পৃক্ত করে আন্তর্জাতিক বাজার ধরতে হবে।
পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী মো. শাহরিয়ার আলম বলেন, গত কয়েক বছরে আমের ভালো দাম না পাওয়ায় রাজশাহীতে আম চাষ কমে যাচ্ছে। ব্যবসায়ী ও ফড়িয়াদের যাতায়াতে হয়রানির কমানো, আমে ফরমালিন বা ক্ষতিকর কিছু নেই মর্মে জনগণকে সচেতন ও আশ্বস্ত করতে হবে বলেও জানান তিনি।
আইসিটি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক বলেন, আগামী তিন-চারদিনের মধ্যে প্রযুক্তিনির্ভর ‘এক শপ’ অ্যাপস চালু করা হবে, যার মাধ্যমে সারা দেশের চাষীরা পণ্য বেচাকেনা করতে পারবে। এর মাধ্যমে চাষীদের পণ্য এনে মেগাশপের পাশাপাশি ডোর টু ডোর গ্রাহকের কাছে পৌঁছে দেয়া যাবে।
সাবেক গভর্নর ড. আতিউর রহমান বলেন, স্থানীয় মার্কেটে আমের চাহিদা বাড়ানোর উদ্যোগ নিতে হবে। কৃষি খাতে অতিরিক্ত বাজেটের প্রয়োজন হলে এখনই ব্যবস্থা নিতে হবে।
বাংলাদেশ ট্রাক-কাভার্ড ভ্যান পণ্য পরিবহন মালিক-শ্রমিক ঐক্য পরিষদের সভাপতি তাজুল ইসলাম বলেন, এ সংকটের সময় তারা পাশে থেকে কাজ করবে। সরকারের সহযোগিতা নিয়ে আম-লিচু পরিবহনের কোনো সংকট হবে না বলেও তিনি আশ্বস্ত করেন।