করোনাভাইরাস সংক্রমণে মানুষের স্বাস্থ্যঝুঁকি এখন চরম পর্যায়ে। ঠিক এই মুহূর্তে গার্মেন্টসহ বিভিন্ন কলকারখানা খুলে দেয়া হয়েছে। যা নিয়ে বিতর্ক আছে। অনেকে লকডাউন অব্যাহত রেখে আগে মানুষের জীবন বাচাঁনোর কথা বলেছেন। কিন্তু এতকিছুর পরেও মুখে মাস্ক পরা ও সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে দেশের অভ্যন্তরীণ অর্থনীতির চাকা সচল রাখার সুযোগ রয়েছে। এক্ষেত্রে সরকারকে উদ্যোগ নিতে হবে। দেশের অর্থনীতির চাকা ও সব শ্রেণী-পেশার মানুষের জীবন-জীবিকা সচল রাখার জন্য আপাতত স্বাস্থ্যবিধি মানা ও সতর্কতা অবলম্বনের কোনো বিকল্প নেই।
বাংলাদেশের অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি শ্রমিকশ্রেণি। এরা স্বল্প বেতনে আমাদের দেশের শিল্পোন্নয়নের পথে সবচেয়ে বড় ভূমিকা পালন করে। আর মধ্যবিত্ত শ্রেণি এই সমাজকে টিকিয়ে রাখতে একটা বড় ভূমিকা পালন করে। বর্তমানে মধ্যবিত্ত ও শ্রমিক শ্রেণি আর্থিক সংকটে রয়েছে। যদি আমরা অর্থনীতির গতিকে সঙ্কট-পরবর্তীতে আবার ত্বরান্বিত করতে চাই তাহলে এই মধ্যবিত্তকে ও শ্রমিক শ্রেণিকে আর্থিক বিপদ থেকে বাঁচাতে হবে।
আমাদের প্রথম টার্গেট হওয়া উচিত, মানুষকেও বাঁচাতে হবে, অর্থনীতির চাকাও সচল রাখতে হবে। ঈদ পরবর্তী সময়ে যদি সাধারণ ছুটি যদি আরো দীর্ঘ হয় তাহলে অর্থনীতির ওপর ব্যাপক প্রভাব পড়বে।
বিশ্বের বিভিন্ন দেশ এখন করোনা মোকাবেলায় লকডাউনের বিকল্প ভাবতে শুরু করেছে। ইতালি, স্পেনসহ কিছু দেশ লকডাউন শিথিল করেছে। একই সঙ্গে অর্থনীতিকে কীভাবে সচল করা যায় সেই পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে। বিজ্ঞানীরা এখনো করোনাভাইরাস মোকাবেলায় ভ্যাকসিন আবিষ্কার করতে পারেনি। ফলে এ দুর্যোগ আমাদের আরো ভোগাবে। এজন্য মানুষকে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে অভ্যস্ত হতে হবে। সচেতন ও সতর্কভাবে স্বাভাবিক কাজে ফিরতে হবে। তবে আমাদের মনে রাখতে হবে জীবনের মূল্য সবকিছুর চেয়ে বেশি। আবার এটাও চিন্তা করতে হবে যে, অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বন্ধ রাখার মানে হলো দেশের আয়ের উৎসও বন্ধ করে দেয়া। এ ক্ষেত্রে আমরা চীন থেকে শিখতে পারি কীভাবে এত বড় এবং এত জনবহুল একটি দেশ করোনাভাইরাসের ঝুঁকি এত কম সময়ে নিয়ন্ত্রণে আনতে পেরেছে। চীনের সরকারি উদ্যোগ, কঠোর শৃঙ্খলা ও সুচারু ব্যবস্থাপনা একটি সফল দৃষ্টান্ত।
এখন আমাদের কাছে এটা পরিষ্কার যে, স্বল্প আয়ের দেশগুলোর জন্য অর্থনৈতিক কার্যক্রম বন্ধ করে দেয়া কোনো দীর্ঘমেয়াদি সমাধান হতে পারে না। বিশ্বের অনেক দেশ বর্তমানে লকডাউন শিথিল করার কথা বিবেচনা করছে। তবে এই সিদ্ধান্ত অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। আামাদের দেশে সুস্পষ্ট পরিকল্পনা ছাড়া যদি লকডাউন তুলে দেয়া হয় তবে এ মহামারী প্রকট রূপ ধারণ করতে পারে। আমাদের মনে রাখা উচিত, বিশ শতকের গোড়ার দিকে স্প্যানিশ ফ্লর কথা যেটির দ্বিতীয় আঘাত প্রথমটির তুলনায় অধিক বিভিষীকাময় ছিল। আশঙ্কার জায়গা হলো, দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোতে যখন করোনার সংক্রমণ কমতে শুরু করেছে, সেখানে বাংলাদেশে আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে। এখন সামাজিক দূরত্ব বজায় না রাখলে ও মানুষ স্বাস্থ্যবিধি না মানলে বিশেষজ্ঞদের পূর্ব সতর্কতাই বাস্তবে রূপ নিতে পারে।
এরই মধ্যে সরকার সীমিত আকারে বিভিন্ন শিল্পপ্রতিষ্ঠান, পোশাক কারখানা খুলে দিয়েছে। ঈদকে সামনে রেখে দোকানপাটও খোলা রাখার সিদ্ধান্ধ হয়েছে। এই সময়ে ক্রেতা-বিক্রেতা উভয়কেই সুরক্ষা ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। গত দেড় মাসের চিত্র অনুযায়ী, সাধারণ ছুটি বা লকডাউন দিয়ে মানুষেকে ঘরে আটকে রাখা যাচ্ছে না। আবার এই মহামারী বিশ্ব থেকে কখন বিদায় নেবে সেটাও ঠিক করে বলা যাচ্ছে না। এই সময়ে আমাদের জীবন তো আর থেমে থাকবে না। এজন্য সর্বক্ষেত্রে সকল শ্রেণীর মানুষকে মাস্ক ও হ্যান্ডগ্লভস ব্যবহার করতে হবে। সাধারণ মানুষের জন্য এটা সহজলভ্য করে দিতে হবে। শারীরিক দূরত্ব এবং স্বাস্থ্যসুরক্ষা বিষয়ক সচেতনতার জন্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ও গণমাধ্যম কাজে লাগাতে হবে। যেখানে জনসমগম তৈরি হয় সেই সব জায়গায় সুস্পষ্ট এবং সহজবোধ্য নির্দেশিকা প্রদান করতে হবে। তবে সব চেয়ে বড় সমস্যা হলো গার্মেন্টস কারখানায়। সেখানে সংক্রামণের ঝুঁকি অনেক বেশি। এজন্য এই জায়গায় সকল শ্রমিকের জন্য স্যানিটেশন সুবিধা নিশ্চিত করা এবং জীবাণুনাশক সরবরাহ করা। কেননা কর্মক্ষেত্রে ব্যক্তিগত সুরক্ষা নিশ্চিত করার বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। যা প্রতিটি শ্রমকিকে মেনে চলতে বাধ্য করতে হবে। সচেতন হয়ে সবাইকে নিজের কাজ করতে হবে। মানুষকে আটকে রেখে করোনাভাইরাস প্রতিরোধ কোনোভাবেই সম্ভব নয় বরং স্বাস্থ্যবিধি মেনে সচেতনতা ও সতর্কতা অবলম্বন করে মানুষকে আস্তে আস্তে স্বাভাবিক অবস্থায়, স্বাভাবিক পরিবেশে ফিরিয়ে আনতে হবে।
বর্তমানে বিশ্ব অর্থনীতির যে অবস্থা দাঁড়াচ্ছে, তাতে আগামী এক বছরে এর উল্লেখযোগ্য উন্নতি হবে বলে মনে হচ্ছে না। এ পরিপ্রেক্ষিতে মহামারীতে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর সঙ্গে আমাদের কূটনৈতিক সম্পর্ক বাড়াতে হবে। যাতে বেকার শ্রমিকরা দ্রুত কাজ পান। এছাড়া মধ্যপ্রাচ্যসহ অন্যান্য দেশের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক জোরদারের মাধ্যমে দেশের জনশক্তি বাজার এবং সেখানে কর্মরত প্রবাসীদের চাকরি সুরক্ষায় তৎপর চালাতে হবে। আমরা যদি চিন্তা করি, এখন করোনা মোকাবিলা করি, অর্থনীতি নিয়ে পরে ভাবা যাবে, তাহলে এমন ধারণা ভুল হবে। এখনই অর্থনীতি নিয়ে ভাবতে হবে। ডলারের তুলনায় টাকার দাম পড়তে থাকলে অর্থনীতিতে ধস নামবে। এটার প্রভাব সাধারণ মানুষের ওপরই পড়বে। এখন কোন অবস্থাতেই জীবন আর জীবিকাকে আলাদা করে দেখার সুযোগ নেই। কম করে হলেও আমাদেরকে নিয়ম মেনে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে যেতে হবে। তবে তাড়াহুড়ো না করে পরিকল্পনা অনুযায়ী সামনের দিকে যেতে হবে। এই সময়ে মানুষের জীবন রক্ষা করার পাশাপশি অর্থনীতির পুনর্বাসন ও পুনর্গঠন হবে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।
লেখক: তাহিন আক্তার, শিক্ষার্থী, ফিন্যান্স অ্যান্ড ব্যাংকিং বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
মেইল: tahinakterjufb364@gmail.com
সানবিডি/ঢাকা/এসএস