সময়ের ভাবনা

জুতসই নীতি জাগাতে পারে পুঁজিবাজার

:: আপডেট: ২০২০-০৬-১৭ ২১:২৪:২৮


স্বাধীনতা-পরবর্তী বাংলাদেশে পুঁজিবাজারের যাত্রা শুরু ১৯৭৬ সালে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ বা ডিএসই নামে। প্রায় ৪৪ বছরের এই সময়কালের মধ্যে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের স্বার্থ সমুন্নত রাখার জন্য সরকারগুলোর পক্ষ থেকে নানা পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে, কিন্তু এর সিংহভাগই ছিল সমস্যা থেকে উত্তরণের জন্য অ্যাডহক বা স্বল্পমেয়াদি ব্যবস্থাপনার অংশবিশেষ মাত্র।

প্রসঙ্গত উল্লেখ করা বাঞ্ছনীয়, ১৯৯৬ ও ২০১০ সালের ধস এই বাজারসংশ্লিষ্ট গুরুত্বপূর্ণ নীতি প্রণয়ন ও অত্যাবশ্যকীয় সংস্কারগুলোকে ত্বরান্বিত করেছে। এরই ধারাবাহিকতায় সাম্প্রতিককালে পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) আইনের উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন বা সংস্কার আমাদের দৃষ্টিগোচরে এসেছে। নিয়ন্ত্রক সংস্থার প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য নতুন জনবল নিয়োগ, আইনি সংস্কার, লেনদেন ব্যবস্থা তদারকির জন্য অত্যাধুনিক সফটওয়্যারের ব্যবহার শুরুসহ বেশকিছু কাঙ্ক্ষিত পরিবর্তন বহু বিলম্বে হলেও দৃশ্যমান হয়েছে। একই উদ্দেশ্য সামনে রেখে বাজারের স্বচ্ছতা ও সুশাসন নিশ্চিতকল্পে ডিএসইকে ডিমিউচুয়ালাইজড এক্সচেঞ্জে রূপান্তর করা হয়েছে ২০১৩ সালে। বাজারের গভীরতা বাড়ানোসহ বিদেশী বিনিয়োগ আকৃষ্ট করার প্রয়াস নিয়ে চীনা শেনজেন স্টক এক্সচেঞ্জের কাছে ডিএসই ২৫ শতাংশ শেয়ার বিক্রয় করে। এর মধ্য দিয়ে চায়না কনসোর্টিয়াম ডিএসইর কৌশলগত অংশীদার হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে।

বিনিয়োগকারীদের স্বার্থ রক্ষায় নিবন্ধিত কোম্পানিগুলোর আর্থিক প্রতিবেদন নিয়ে কোনো ধরনের অপ্রত্যাশিত কারসাজি রোধে নিরীক্ষকদের জবাবদিহিতার আওতায় আনার জন্য নতুন আইন প্রণয়ন করেছে বিএসইসি। বাজারে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগ বৃদ্ধির জন্য মার্চেন্ট ব্যাংকগুলোর এক্সপোজার ক্যালকুলেশনের সংজ্ঞা পরিবর্তন করা হয়েছে, অতিসম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ন্যূনতম সুদে পুঁজিবাজারে দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগের জন্য আলাদা তহবিলের অনুমোদনও দেয়া হয়। সব মিলিয়ে নির্দ্বিধায় বলা যায়, স্মরণকালের মধ্যে সবচেয়ে বেশি আইনগত ও কাঠামোগত সংস্কারের সঙ্গে সঙ্গে কিছু নীতিগত সহায়তাকে সঙ্গী করে বিনিয়োগকারীদের সামনে নতুন রূপে আবির্ভূত হওয়ার চেষ্টা করেছে বাংলাদেশের পুঁজিবাজার।

এত সব পদক্ষেপের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য ছিল একটাই, দেশের প্রায় থমকে যাওয়া পুঁজিবাজারকে গতিশীল করা, ক্রমাগত পতনের বৃত্ত থেকে বের করে আনার চেষ্টা করা। কিন্তু এসব গৃহীত পদক্ষেপের কোনোটিই আপাতদৃষ্টিতে তার উদ্দেশ্য পূরণ করতে পারেনি। ২০১০ সালের ধসের পরবর্তী গত পাঁচ বছরের বাজারের চিত্র প্রকৃত অর্থে আরো ভয়াবহ, অবস্থাটা অনেকটা বেশির ভাগ ক্যান্সার রোগীর প্রথম দফায় কেমোথেরাপি চিকিৎসায় সাময়িক উপশম লাভের মতো, যাদের দ্বিতীয় দফায় সাধারণ উপসর্গেই অবধারিত মৃত্যু।

২০১০ সালের ধসের সময় সাধারণ বিনিয়োগকারীদের প্রায় সবারই পোর্টফোলিওর ইকুইটি ঋণ অনুপাত ছিল কমপক্ষে ১ অনুপাত ১ বা তারও বেশি। সেই বিবেচনায় গত পাঁচ বছর সময়কালে পোর্টফোলিওতে ইকুইটি ঋণের সর্বোচ্চ এই অনুপাত শূন্য দশমিক ৫ নির্ধারণ করে দেয়া হয়েছিল নিয়ন্ত্রক সংস্থা থেকে, যার ফলে বাজারে ঋণ দেয়া প্রতিষ্ঠানগুলোর ঝুঁকি ২০১০-এর তুলনায় অনেক কমে গিয়েছিল।

উল্লেখ্য, ২০১০ সালের অভিজ্ঞতা মাথায় রেখে মার্চেন্ট ব্যাংক বা ব্রোকারেজ হাউজগুলো ইকুইটি-ঋণ অনুপাত নির্ধারিত সীমায় রাখা এবং প্রয়োজনে সমন্বয়ের জন্য ফোর্স দেয়ার ক্ষেত্রে এবার ছিল অনেক বেশি সিদ্ধহস্ত। তথাপি ২০১০ সালের ধসের তুলনায় গত কয়েক বছরে অনেক বেশি বিনিয়োগকারী নিঃস্ব হয়েছেন, তার বাস্তবতায় বাজারও প্রায় থমকে গেছে। করোনা মহামারীতে অর্থনৈতিক কার্যক্রম স্থবির হয়ে পড়ার বহু সময় আগে থেকেই আমাদের পুঁজিবাজার স্থবির হয়ে আছে, এটাই বাস্তবতা।  নীতিনির্ধারণী মহলের বিগত বছরগুলোয় নেয়া সিদ্ধান্ত ও বাজারে বিনিয়োগসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের প্রত্যাশার মধ্যে তফাত ছিল বিস্তর।

প্রেক্ষাপট বিবেচনায় মনে হয়েছে, সরকার একটি ‘টেইলর, মেড’ স্থিতিশীল পুঁজিবাজার প্রত্যাশা করে, যার মূল্যসূচক একটি নির্দিষ্ট সীমার মধ্যে ওঠানামা করবে, লেনদেন সীমা একটা কাঙ্ক্ষিত পর্যায়ে থাকবে, এতে সব প্রকার বিনিয়োগকারী কমবেশি লাভবান হবে, ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীরা কোনো কারণে বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠবে না, একই সঙ্গে এটি ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের বাইরে পুঁজি উত্তোলনের জন্য ক্ষেত্রবিশেষে বিকল্প উৎস হিসেবে কাজ করবে। কিন্তু বাস্তবিক অর্থে এটি একটি কল্পনাপ্রসূত নিয়ন্ত্রিত পুঁজিবাজারের রূপ। অর্থনৈতিক বাস্তবতার সঙ্গে সঙ্গে ব্যক্তির মনস্তত্ত্বও বিনিয়োগ সিদ্ধান্ত গ্রহণে বড় ভূমিকা পালন করে, সে কারণে এ রকম একটি নিয়ন্ত্রিত পুঁজিবাজারকে বাস্তবিক রূপ দেয়া সম্ভব নয়। প্রকৃত অর্থে ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীর স্বার্থ সুরক্ষিত রাখার জন্য বাজার নিয়ন্ত্রণের চেয়ে বাজারের গভীরতা বৃদ্ধি ও সুশাসন নিশ্চিত করার দিকে মনোযোগী হওয়া বাঞ্ছনীয়।

বৈশ্বিক  আঞ্চলিক প্রেক্ষাপটে আমাদের পুঁজিবাজার

ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীরা সমন্বিতভাবে বাজারের প্রাণ বৃহৎ বিনিয়োগকারী, মিউচুয়াল ফান্ড বা মার্চেন্ট ব্যাংকের মতো প্রতিষ্ঠান সমন্বিতভাবে পুঁজিবাজারে একটা দেহের মতো, যা প্রাণকে ধারণ করে। তাই প্রাণহীন দেহ যেমন অসার, তেমনি দেহহীন প্রাণের অস্তিত্ব অকল্পনীয়। বর্তমান সরকারের গতিশীল নেতৃত্বে দায়িত্ব গ্রহণের পর হাজার কোটি টাকার ঘরে থাকা এ দেশের বাজেট এখন কয়েক লাখ কোটি টাকা, জিডিপিও অতিক্রম করেছে ৮ শতাংশের ঘর; যা এখন আর স্বপ্ন নয়, বাস্তবতা। কিন্তু ২০০৭ সালে বিশ্বব্যাপী ইকুইটি মার্কেট ইনডেক্স প্রোভাইডার প্রতিষ্ঠান এমএসসিআই-এর তালিকাভুক্ত হয়ে ‘ফ্রন্টিয়ার’ মার্কেট শ্রেণীতে যাত্রা শুরু করে ডিএসই। অদ্যাবধি আমাদের পুঁজিবাজার ডিএসই উপরের ক্যাটাগরিতে (ইমার্জিং  মার্কেট) যাওয়ার যোগ্যতা অর্জন করতে পারেনি। তাই বিশ্বের স্বনামধন্য তিনটি ইকুইটি মার্কেট ইনডেক্স প্রোভাইডারের (এমএসসিআই, এফটিএসই এবং এস অ্যান্ড পি ডিওডব্লিউ জেওএনইএস) তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান এখনো ফ্রন্টিয়ার ক্যাটাগরিতে। বাজার মূলধন ও জিডিপি অনুপাতের শতকরা হার বিবেচনায় আমাদের অবস্থান যুদ্ধ-বিগ্রহে ভরা দেশ পাকিস্তানের নিচে তো বটেই, এ অঞ্চলেই তলানিতে। মার্কেট ক্যাটাগরি বিবেচনায়ও আমাদের অবস্থান ভারত, পাকিস্তানের (ইমার্জিং মার্কেট) নিচের শ্রেণীতে। বাফেট রেশিও বিবেচনায় তাই আমাদের অবস্থানও তলানিতে, যা পুঁজিবাজারে দীর্ঘমেয়াদি বিদেশী বিনিয়োগ আকর্ষণের জন্য মোটেও সহায়ক নয়।

যে কারণে পুঁজিবাজারকে অগ্রাধিকার খাতের তালিকায় নিয়ে আসা উচিত

বর্তমান করোনা মহামারীর বাস্তবতায় সরকারের অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত খাতের তালিকায় পুঁজিবাজারকেও অন্তর্ভুক্ত করা অর্থনীতি ও সামাজিক স্থিতিশীলতার স্বার্থেই অতি জরুরি। বেশির ভাগ ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান কয়েক বছর ধরেই খেলাপি ঋণের ভারে ভারাক্রান্ত হয়ে আছে। মহামারীর প্রভাবে দেশের সর্ববৃহৎ শিল্প পোশাক খাত চাপের মুখে পড়ায় আগামী দিনগুলোয় ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণের পরিমাণ বাড়বে বৈ কমবে না। ফলে নতুন ঋণপ্রবাহ আরো সংকুচিত হওয়ার শঙ্কা রয়েছে, নতুন উদ্যোক্তা তৈরি হওয়ার পথ বাধাগ্রস্ত হবে বিবেচনায় নিলে শিক্ষিত তরুণ জনগোষ্ঠীর জন্য নতুন কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরিও একটি বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াবে সরকারের জন্য। ফলে নতুন করে শিক্ষিত তরুণদের একটি বড় অংশ কর্মহীন থাকার আশঙ্কা বাস্তবে রূপ নেবে, যা সামাজিক স্থিতাবস্থার জন্য হয়ে উঠতে পারে হুমকিস্বরূপ। বৃহৎ উন্নয়ন প্রকল্পের অনেক কাজ প্রায় শেষ পর্যায়ে। এ অবস্থায় এসব প্রকল্প থেকে অর্থ বরাদ্দ একেবারে সরিয়ে নেয়া বাস্তবসম্মত নয়, কারণ এর মধ্য দিয়ে প্রকল্প ব্যয় অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হবে; যা অর্থনীতিতে ভিন্ন মাত্রার সুদূরপ্রসারী ঝুঁকি তৈরি করতে পারে। তাই রেশনিং ব্যবস্থার মতো করে হলেও সিংহভাগ শেষ হয়ে যাওয়া প্রকল্পে সরকারের অর্থায়ন অব্যাহত রাখার বাইরে কোনো বিকল্প নেই। শিল্প খাত টিকিয়ে রাখার জন্য এ খাতে ভবিষ্যৎ বিনিয়োগ যেমন অব্যাহত রাখতে হবে, পাশাপাশি সামাজিক নিরাপত্তাবেষ্টনীর আওতা বৃদ্ধিসহ গ্রামভিত্তিক উন্নয়ন প্রকল্প ও কৃষি খাতে সরকারের সরাসরি প্রণোদনা আগামী দিনগুলোয় গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে। কেননা নিকট অতীতে এ খাতে বেসরকারি ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর বিনিয়োগে বরাবরই অনীহা দেখা গেছে। একই সঙ্গে রাজস্ব আয় কমে যাওয়ার বাস্তবতা নিয়েই শুরু করতে হবে আগামী অর্থবছর। সে কারণে সরকারের জন্য স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে বড় অংকের বাজেট ঘাটতি মেটাতে অর্থের সংস্থান ও ব্যবস্থাপনা দুটোতেই চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হবে। এ পরিপ্রেক্ষিতে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ওপর চাপ না বাড়িয়ে  শিল্প খাতে ঋণপ্রবাহ সচল রাখতে পারলে তা সরকারের জন্য সার্বিক আর্থিক ব্যবস্থাপনায় ব্রিদিং স্পেস তৈরি করবে। বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহের জন্য পুঁজিবাজারকে প্রধান উৎস হিসেবে ব্যবহার নিশ্চিত করতে পারলে তা উদ্যোক্তাশ্রেণীর জন্য যেমন সাশ্রয়ী হবে, তেমনিভাবে এর ফলে ব্যাংক ব্যবস্থায় নগদ অর্থের প্রবাহে স্বস্তিদায়ক আবহ বিরাজ করবে, যার সরাসরি সুবিধা নিয়ে সরকার এ দেশের প্রান্তিক জনগোষ্ঠী ও কৃষি খাতের মতো অগ্রাধিকারভিত্তিক খাতে আর্থিক সহায়তার আওতা কাঙ্ক্ষিত হারে বৃদ্ধি করতে সক্ষম হবে।

পুঁজিবাজারের গতি ফেরাতে  মুহূর্তে যা বিবেচনা করা উচিত    

প্রথমত, দেশী-দেশী ব্যক্তি বা প্রাতিষ্ঠানিক যেকোনো বিনিয়োগকারীর জন্য পুঁজিবাজারে আগামী পাঁচ বছরের জন্য যেকোনো অংকের বিনিয়োগ থেকে অর্জিত লভ্যাংশ সম্পূর্ণ করমুক্ত ঘোষণা করা যেতে পারে। এতে বাজারে ব্যক্তি ও প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগ বাড়বে। এর মধ্য দিয়ে কম খরচে উদ্যোক্তাদের জন্য পুঁজির জোগান নিশ্চিত করা সম্ভব হবে। অন্যদিকে সরকার রাজস্ব আয়ের ঘাটতি মোকাবেলায় আগামী বছরগুলোয় বর্তমানে নিবন্ধিত বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের সরকারি কোম্পানিগুলোর শেয়ার ছেড়ে পুঁজি যেমন সংগ্রহ করতে পারবে, তেমনি এর ফলে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে বাজেট বরাদ্দের ক্ষেত্রে অর্থায়নের চাপ কমাতে এটি সহায়ক ভূমিকা পালন করবে। ব্যাংক ও আর্থিক খাতের ওপর থেকে শিল্প খাতে ঋণপ্রবাহের চাপ কমাতে পারলে  নতুন করে আর্থিক খাতে খেলাপি ঋণের হার বেড়ে যাওয়ার শঙ্কাও কমবে।

দ্বিতীয়ত, পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসি কর্তৃক নিবন্ধিত কোম্পানিগুলোর ডিভিডেন্ড প্রদানের নির্দেশনাসংক্রান্ত ২৩ মে ২০১৯ সালের গৃহীত সিদ্ধান্তটি বর্তমান মহামারী বাস্তবতায় পুনরায় বিবেচনা করা উচিত। সার্বিকভাবে প্রতিটি শিল্পপ্রতিষ্ঠানের জন্যই বর্তমান বাস্তবতায় ব্যবসায়িক সক্ষমতা ধরে রাখা একটি বড় চ্যালেঞ্জ, অপারেটিং ক্যাপিটাল এই সক্ষমতা ধরে রাখার অন্যতম নিয়ামক শক্তি। সেই বিবেচনায় রিটেইনড আর্নিংয়ের থেকে কোম্পানির অভ্যন্তরে কোনো বিএমআরই কার্যক্রম না থাকলে ক্যাশ  ডিভিডেন্ড দেয়ার বাধ্যবাধকতা মেনে চলা কোম্পানিগুলোর জন্য ঝুঁকিপূর্ণ হতে পারে। কোম্পানিগুলো এ বাস্তবতায় ভবিষ্যৎ আর্থিক সক্ষমতা ধরে রাখতে ডিভিডেন্ডের পরিমাণ কমিয়ে দেয়ার সঙ্গে সঙ্গে দুর্বল কোম্পানিগুলো নো ডিভিডেন্ড দেয়ার মতো সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারে, যা বিনিয়োগকারীদের জন্য হিতে বিপরীত ফল বয়ে আনতে পারে। এক্ষেত্রে সক্ষম কোম্পানিগুলোকে ক্যাশ ডিভিডেন্ড দেয়ায় ক্ষেত্রে উৎসাহিত করতে করপোরেট ট্যাক্স হারে ছাড় দেয়ার কথা বিবেচনা করা যেতে পারে।

তৃতীয়ত, সব মিউচুয়াল ফান্ডকে তাদের সম্পদের ৭০ শতাংশ পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ বাধ্যতামূলক করতে হবে। একই সঙ্গে এ খাতে সম্পদ ব্যবস্থাপকদের কার্যক্রম ও জবাবদিহিতার আওতায় আনা জরুরি বিধায় নিয়ন্ত্রক সংস্থা, বাংলাদেশ সিকিউরিটি এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) অধীনে একটি তদারকি কমিটি করা উচিত। বিনিয়োগকারীদের স্বার্থে ফান্ডগুলোর রিপিট ইউনিট আকারে লভ্যাংশ প্রদান করার বিধান রহিত করতে হবে। কথিত আছে বিভিন্ন মিউচুয়াল ফান্ডের প্রভাবশালী উদ্যোক্তাদের চাপে এ ধরনের একটি অগ্রহণযোগ্য সিদ্ধান্ত ধস-পরবর্তী বাজারে অনুমোদন করানো হয়, যা এখনো বলবৎ আছে।

চতুর্থত, আইপিওর মাধ্যমে পুঁজিবাজারে কোনো প্রতিষ্ঠান নিবন্ধিত হলে সেই প্রতিষ্ঠানের শেয়ারের বাজারমূল্য তিন বছরের মধ্যে ফেস ভ্যালু বা ভিত্তি মূল্যের নিচে নেমে গেলে (ডিভিডেন্ড সমন্বয়ের পরও)  কোম্পানি তার শেয়ার ফেস ভ্যালুতে বাই- ব্যাক করতে বাধ্য থাকবে মর্মে বিধান রেখে দ্রুততম সময়ে শেয়ার বাই-ব্যাক আইন চালু করা উচিত। তার আগ পর্যন্ত নতুন আইপিও অনুমোদন স্থগিত রাখা উচিত।

পঞ্চমত, এর আগে নিয়ন্ত্রক সংস্থা কর্তৃক উদ্যোক্তা পরিচালকদের জন্য ন্যূনতম ৩০ শতাংশ শেয়ার ধারণের আইন যথাসম্ভব দ্রুততম সময়ের মধ্যে বাস্তবায়ন করতে হবে।  একই সঙ্গে দ্রুততম সময়ের মধ্যে এ বাজারকে ফ্রন্টিয়ার মার্কেট ক্যাটাগরি থেকে ইমার্জিং মার্কেট ক্যাটাগরিতে উন্নীত করার জন্য পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থার (বিএসইসি) অধীনে সুনির্দিষ্ট কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন করা উচিত। কেননা এই ইমার্জিং  মার্কেটের যোগ্যতা অর্জনের শর্তাবলি পূরণের মধ্য দিয়ে বাজারের গভীরতা বৃদ্ধিসহ বিদেশী বিনিয়োগ আকর্ষণ, নিরীক্ষা প্রতিবেদনের মান এবং বিনিয়োগসংক্রান্ত তথ্যের অবাধ প্রবাহসহ অন্যান্য বহুল আলোচিত বিষয় স্বয়ংক্রিয়ভাবেই অর্জিত হয়ে যাবে। বিশ্বের প্রতিটি শক্তিশালী অর্থনীতির পেছনে সে দেশের পুঁজিবাজার ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে। গত এক দশকে আমাদের অর্থনৈতিক অগ্রগতির সঙ্গে পুঁজিবাজারের গতিপ্রকৃতির কোনো সংগতি খুঁজে পাওয়া যাবে না।

উদ্যোক্তা পর্যায়ে শিল্পের সম্প্রসারণ বা যেকোনো ধরনের স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি পুঁজির জন্য তাই ব্যাংক বা আর্থিক খাতই প্রধান নির্ভরতার জায়গা। বিকল্প উৎস না থাকার ফলে ঋণ পাওয়ার অসম প্রতিযোগিতা এ খাতে বিদ্যমান, যা এ খাতে সুশাসন প্রতিষ্ঠার পথেও অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ বৃত্ত থেকে বেরিয়ে আসা অতি জরুরি, অন্যথায় এই মহামারী পরিস্থিতিতে আগামী দিনগুলোয় পুঁজির সংকটে ব্যবসায়িক সক্ষমতা হারিয়ে ঝুঁকির মুখে পড়তে পারে শিল্প খাত, নতুন উদ্যোক্তা সংকটে অস্বাভাবিকভাবে সংকুচিত হয়ে পড়তে পারে শ্রমবাজার এবং প্রাসঙ্গিকভাবেই এর রেশে আর্থিক খাতের দুর্বল প্রতিষ্ঠানগুলো আরো দুর্বল হয়ে অস্তিত্ব হারিয়ে ফেলতে পারে। সঙ্গে যুক্ত হতে যাচ্ছে প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্সের প্রবাহের ঋণাত্মক গতির শঙ্কা। তাই সার্বিক আর্থিক ব্যবস্থাপনার স্বার্থেই পুঁজিবাজারে গতিশীলতা আনার কোনো বিকল্প নেই। পুঁজিবাজার বিশ্বব্যাপী ঝুঁকিপূর্ণ। কারণ এখানে বিনিয়োগকারীরা ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত সম্ভাবনাকে বিবেচনায় নিয়েই বিনিয়োগ করেন।

বাজারসংশ্লিষ্টরা তাই ঘন ঘন নীতিগত সিদ্ধান্তের পরিবর্তনকে দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগের জন্য অন্তরায় মনে করেন। এ কারণে শুধু অর্থের সরবরাহ বৃদ্ধির প্রয়াস বা বিনিয়োগের জন্য শর্তগুলো ক্ষেত্রবিশেষে সহজ করা হলেও প্রাতিষ্ঠানিক বা ব্যক্তি খাতের  বৃহৎ বিনিয়োগ সবসময় বাজারে দেখা যায় না, যার প্রমাণ আমাদের পুঁজিবাজারে গত কয়েক বছরে দেখা গেছে। তাই আর্থিক প্রণোদনা নয়, বরং মধ্যম ও দীর্ঘমেয়াদি জুতসই নীতি সহায়তা এবং বিদ্যমান আইনের নির্মোহ প্রয়োগই জাগিয়ে তুলতে পারে আমাদের থমকে যাওয়া পুঁজিবাজারকে, যা হয়ে উঠতে পারে মহামারীকালীন আমাদের অর্থনীতির লাইফ লাইন বা জিয়নকাঠি।

মাহফুজা খাতুন: সহকারী অধ্যাপক ও সভাপতি

ফিন্যান্স অ্যান্ড ব্যাংকিং বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়