আজ থেকে ত্রিশ পঁয়ত্রিশ বছর আগে ঈদ আসছে এটাই ছিল আনন্দের। কেউ নতুন জামা পেল কি পেল না সেটা নিয়ে তেমন ভ্রুক্ষেপ চোখে পড়েনি। বছরের নির্ধারিত দুটো জমার মধ্যে উৎকৃষ্টটি ১৯৪৭ সাবানের ঘষাতে চকচকে হয়ে উঠতো। এটাই ছিল আনন্দ, একেবারে খাঁটি আনন্দ।
ঈদের দিন গ্রামের প্রতিটি মাঠে ইস্কুলইল্লা-লাঙাইল্লা, বিয়াতা-আবিয়াতা (বিবাহিত), উত্তর পাড়া-দক্ষিণ পাড়া প্রভৃতি দলে খেলা হতো।
কাল ক্রমে গার্মেন্টস এলো। ঢাকায় মানুষের ঢল নামল। বেসরকারি ব্যাংক, কর্পোরেট জব, চাকচিক্য ও মোটা বেতন। বিবিএ-এমবিএতে ভরে গেল দেশ।
কর্পোরেট জগত বানী শুনাল, বাবা অসুস্থ আপনি গিয়ে কি করবেন? টাকা পাঠিয়ে দিন এক গাঁদা। গাড়িতে জ্যামে দু ঘন্টা বসে থাকুন সমস্যা কি, এসিটা ছেড়ে দিন! তাছাড়া একটা গাড়ি না থাকলে কিসের স্ট্যাটাস! ঈদে শপিং এ ব্যাঙ্কক সিঙ্গাপুরে না যেতে পারলে এট লিষ্ট কলকাতা যান!!
অপরদিকে গ্রামের যুবক ছেলে আতর আলী বিদেশ গেল, তাঁর ছেলের ভাল লেখাপড়ার জন্য এন্ড্রয়েড ফোন এলো। তাছাড়া অমুকের ছেলের একটি মোটর সাইকেল থাকবে না, তা কি হয়? এদিকে ছেলের লেখাপড়া চুলায় যাক, তাতে কি! ঈদে দামী জুতো, দামী পেন্ট না হলে কেমন ক্ষেত ক্ষেত লাগে।
অপরদিকে ছেলের মা রাত জেগে ফেসবুকে মেতে না থাকলে কি আধুনিকতা কিছু থাকে? চোখে কালি আর রাজ্যের ক্লান্তি! সেই কালী ঢাকতে দামী ব্যান্ডের মেক আপ বক্স মগা পাঠায় বিদেশ থেকে!
বৃদ্ধ শাশুড়ি জীর্ণ শীর্ণ হয়ে পড়ে থাকে চোকিতে কাত হয়ে। সে বাঁচলেই কি মরলেই কি! শীর্ণ দেহে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে বুড়ি "কি যে দিন কাল পড়ছে!"
শাশুড়ির দীর্ঘ শ্বাস যেমন বউয়ের কিছু যায় আসে না, তেমনি সমাজ পতিদের সমাজের অসঙ্গতি কিছুই করার থাকে না।
পড়বেই বা কেন? বিশ্ব যেভাবে ভোগবাদী সমাজের বিস্তারে উৎসাহিত তথা সহযোগিতা করছে, সেখানে আমাদের সমাজের কি বা করার আছে। তাই সবাই মিলে খাও দাও ফুর্তি করো, নতুবা পদদলিত হয়ে মরে যাও!
কিন্তু এই ফুর্তিতে ছেদ ঘটিয়ে দিল বে-রসিক করোনা! সব কিছু কেমন গোলমালে করে দিল!!! এটা কি মানা যায়?
না মেনে উপায় কি? যে গার্মেন্টস মালিক ২০টি মেশিন থেকে ২০টি কারখানার মালিক হয়েছেন, তিনি করোনার দুর্যোগে নিজের মুনাফা থেকে শ্রমিকদেরকে এক মাসের বেতন দিতে পারবেন না, এটাই বাস্তবতা! যে ব্যাংক ব্যবসায়ীরা ব্যাংক কর্মীদের ব্যাঙ্কক সিঙ্গাপুরে ঈদ শপিং এ উৎসাহিত করত, ট্রেনিং এর নামে কর্মীদের বিদেশে পাঠাতো মোজ মাস্তি করতে, তারাই মুখের উপর বেতন কমানোর ঘোষণা দিয়ে দিলেন। এরূপ নানবিদ বাস্তবতায় ঢাকা শহর থেকে লোটা ঘটি ঘুচিয়ে গ্রামে ছুটছে মধ্যবিত্ত।
তিনি এখন গ্রামের কৃষিতে এডজাষ্ট হতে পারবেন কি না, সেটাই প্রশ্ন!
শুধু তাই নয়, গ্রামের যে আটো/সিএনজি চালক যুবকটি ছয়/সাত শত টাকা কেজি নদীর মাছ খেয়ে অভ্যস্ত, যে কি না সারাদিনের রোজগার দুই হাজার টাকার পুরোটাই দিনে খরচ করে অভ্যস্ত! সে কি করে শহুরে মধ্যবিত্তকে গ্রামে বরণ করবে?
এখানে সিএনজি চালক, কর্পোরেট কেরানি, দোকানদার, প্রবাসীর পরিবার, গার্মেন্টস কর্মী কে নেই এই ভোগের দৌড়ে!
ভোগের নেশায় মত্ত মধ্যবিত্ত এখন কি করবে? তার তো কৃষি কাজে মন সহে না! তাছাড়া বাড়িয়ে ফেলা স্ট্যাটাস কি সহজেই কমানো যায়?
এতো মুশকিল হতো না যদি মধ্যবিত্তের সঞ্চয় থাকতো।
ভারতীয়দের ৩৫% সঞ্চয় প্রবণতা দেখে এ দেশীরা কতইনা কৃপন বলে টিটকেরি মারে।
আমার পরিচিত এক ছেলে (গার্মেন্টস চাকুরে) গত বছর ৯০,০০০ টাকা দিয়ে আস্ত গরু কোরবানি দিয়েছিল, সে কি না এবার সাত শরিকেও কোরবানি দিতে পারবে না! এটা কেমন কথা?
যে চাকুরে ঈদের ছুটিতে ব্যাঙ্কক, বালি, মালয়েশিয়ায় পরিবার সহ ঘুরতে যেত, সে কিনা তিন মাস বাড়ি ভাড়া দিতে পড়েছে না!
কই, এখন তো সপ্তাহে একদিন চাইনিজ, কথায় কথায় রেস্টুরেন্টে খাওয়া, এই পার্টি সেই পার্টিতে খাওয়া, মাস্তি করা, গাড়ীর কালো ধোঁয়া ছেড়ে ঢাকাকে বিষাক্ত করা এবং সেই বিষাক্ত পরিবেশে ঘন্টার পর ঘন্টা জ্যামে বসে থাকা ছাড়াও ঢাকার মধ্যবিত্তের চলছে!
তা হলে এসব কি অযথা বা আলগা ফুটানি ছিল?
আমি এক ব্যাংকার আত্মীয়ার বাসায় গিয়ে দেখলাম তার ১৫০ জোড়া জুতো!! এটাকে আপনারা কি বলবেন প্রয়োজন? নাকি অসুস্থতা!
আজকে কেন মধ্যবিত্ত মাত্র ছয়টি মাস সঞ্চয়ের টাকায় চলতে পারছে না, সেই প্রশ্ন রেখে গেলাম।
আমি গরিব ফাউন্ডেশনের ত্রাণ বিতরণ করতে গিয়ে বিড়াট ধাক্কা খেয়েছিলাম। লাইনে দাঁড়ানো বোরকা পড়া একটি মেয়ের হাতে আমার ফোনের চেয়েও দামী এনড্রয়েড ফোন দেখে! যাদের বাড়ি ঘর পাকা, বাজারে যাদের দাপটে ঘেঁষা যায় না, তাদের ত্রাণ পাওয়ার তৎপরতা দেখে আমি নিজেই লজ্জিত হয়েছিলাম সেদিন!
গ্রামের এক ভিখারী, যে কি না আমার কাছ থেকে ৫০০ টাকা দান হিসেবে নিল এবং পরে জেনেছিলাম সে কি না ৫০০০ টাকার এক ভাগ মহিষের মাংস কিনে রোজার ঈদ করেছে অথচ আমরা সাহস হয়নি ৫০০০ টাকার মাংসের একটি ভাগা কিনতে। এটাকে কি বলবেন?
এই অসঙ্গতি গুলোকে কি ভোগ বিলাস নাকি ভোগের অসুখ বলবেন?
করোনা যদি আমাদেরকে চোখে আঙুল দিয়ে না দেখাতে আমরা হয়তো এই ভোগের অস্থিরতাকে স্মার্টনেস বা আধুনিকতা বলে চালিয়ে যেতাম শত বছর।
এখনও যদি বাস্তব শিক্ষা নিতে না পারি, তবে আর কবে?
জি এম কিবরিয়া
প্রধান সমন্বয়কারী
ক্লিন গ্রিণ বাংলাদেশ।