করোনায় ঘরবন্দী অবস্থায় বিপাকে রয়েছেন শিক্ষার্থীরা। ইতোমধ্যে বিভিন্ন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে অনলাইন পদ্ধতিতে শ্রেণীকার্যক্রম চালু হয়েছে, এমনকি অনলাইন পদ্ধতিতে সেমিস্টার ফাইনাল পরীক্ষাতেও অংশ নিয়েছেন শিক্ষার্থীরা। ৩০ এপ্রিল ইউজিসি থেকে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে অনলাইনে পাঠদান, পরীক্ষা গ্রহণ, মূল্যায়ন এবং শিক্ষার্থী ভর্তি বিষয়ে একটি গাইডলাইন প্রকাশ করেছে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন (ইউজিসি)। যে সব বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় চলমান সেমিস্টারের শিক্ষা কার্যক্রম অনলাইনে সন্তোষজনকভাবে পরিচালনা করছে, তাদের জন্য দু’টি বিকল্প প্রস্তাব দেওয়া হয়।
ক. কমিশনের নির্দেশনা অনুযায়ী আগের মতো চলতি সেমিস্টারেও কোর্সগুলোর অসমাপ্ত পাঠ্যসূচির ওপর অনলাইনে ক্লাস চলমান থাকবে, তবে ল্যাবরেটরিভিত্তিক সব কোর্সের ব্যবহারিক ক্লাস করোনা ভাইরাস পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ার পর শ্রেণিকক্ষে সম্পন্ন করতে হবে। অনলাইনে ক্লাসের বিষয়ে স্ব স্ব বিশ্ববিদ্যালয় নিজস্ব সক্ষমতা অনুযায়ী শিক্ষার্থীদের উপযোগী ডিজিটাল পদ্ধতিতে যে কোনো অনলাইন প্লাটফর্মের সহায়তা নিয়ে প্রয়োজনীয় কার্যকরী ব্যবস্থা নেবে। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ার পর বিশ্ববিদ্যালয় সব পর্যায়ের পরীক্ষা ও মূল্যায়ন চলমান নিয়ম অনুযায়ী গ্রহণ করবে।
খ. কমিশনের নির্দেশনা অনুযায়ী আগের মতো চলতি সেমিস্টারে কোর্সগুলোর অসমাপ্ত পাঠ্যসূচির ওপর অনলাইনে ক্লাস চলমান থাকবে। এ বিষয়ে স্ব স্ব বিশ্ববিদ্যালয় নিজস্ব সক্ষমতা অনুযায়ী শিক্ষার্থীদের উপযোগী ডিজিটাল পদ্ধতিতে যে কোনো অনলাইন প্লাটফর্মের সহায়তা নিয়ে প্রয়োজনীয় কার্যকরী ব্যবস্থা নেবে।
১৬ মে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন (ইউজিসি)
অনলাইনে শিক্ষা কার্যক্রমের ভূমিকা ও কার্যকারিতা নিয়ে সরকারি ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য বরাবর মেইলে দিয়ে তথ্য চাওয়া হয়। সরকারী বিশ্ববিদ্যালয় গুলোতে অনলাইনে শ্রেণীকার্যক্রম চালু করার কথা থাকলেও বিভিন্ন কারণে এখন অবধি পুরোদমে শুরু হয়নি। নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু কিছু বিভাগে অনলাইন পদ্ধতিতে শ্রেণীকার্যক্রম শুরু করলেও দুই তৃতীয়াংশের বেশি শিক্ষার্থী উপস্থিত করা যাচ্ছে না বলে অভিযোগ রয়েছে।
তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির যুগে অনলাইনে শ্রেণীকার্যক্রম চালানো অবশ্যই সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত। এতে করে হয়তো সেশনজট নামক অভিশাপ থেকে মুক্তি পাবে শিক্ষার্থীরা। অবসর সময়গুলো সঠিকভাবে কাজে লাগানো সম্ভব। বর্তমানে শিক্ষাক্ষেত্র এক অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ এর মাঝে আছে। সকল কার্যক্রম কবে স্বাভাবিক হবে এই নিয়ে নিশ্চিত করে কিছুই বলা যাচ্ছে না। এরুপ পরিস্থিতিতে শিক্ষা ব্যবস্থা সচল রাখতে অনলাইন পদ্ধতির কথাই ভাবতে হচ্ছে সবাইকে। এতে করে হয়তো কিছুটা হলেও ক্ষতি পুষিয়ে নিয়ে সামনে এগোনোর পথ খুঁজছেন শিক্ষার্থীরা।
কিন্তু বিভিন্ন কারণে বেশিরভাগ শিক্ষার্থীরাই স্রোতের বিপরীত টান টানছেন। কেননা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুরা বেশিরভাগ শিক্ষার্থীরাই মধ্যবিত্ত কিংবা নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান। অনলাইন ক্লাস করার জন্য যে পরিমাণ মেগাবাইট প্রয়োজন তার যোগান দেয়া অনেকেরই সামর্থ্যের বাইরে। আবার, অনলাইন ক্লাস করার মত সেরকম ডিভাইসও অনেকের সংগ্রহে নেই। এছাড়াও সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও নিম্নগতির নেট স্পিডের জন্য ক্লাশ করাটা অসম্ভব গ্রামে অবস্থানরত শিক্ষার্থীদের।
বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবসায় প্রশাসন বিভাগের শিক্ষার্থী বায়েজীদুল ইসলাম মজুমদার বলেন, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন অনলাইন ক্লাসের সিদ্ধান্ত অবশ্যই শিক্ষার্থীদের ভালোর কথা ভেবে নিচ্ছে। কিন্তু এই অনলাইন ক্লাসে কতজন শিক্ষার্থীর ভালো হচ্ছে সেদিকটা অবশ্যই খেয়াল রাখা উচিত প্রশাসনের। একটা ক্লাসের ৫০% শিক্ষার্থী উপস্থিতি দিয়ে কোন ক্লাস চলতে পারে না। ইন্টারেনেট সংযোগের দুরবস্থা আর আর্থিক অসচ্ছলতার জন্য পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অধিকাংশ শিক্ষার্থী এই অনলাইন ক্লাসের সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। শিক্ষা সবার মৌলিক অধিকার। এভাবে কাউকে মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করাটা সঠিক সিদ্ধান্ত হবে না প্রশাসনের। যদি অনলাইন ক্লাস শুরু করতেই হয় তবে সবার আগে শিক্ষার্থীদের বিনামূল্যে অথবা স্বল্পমূল্যে গতিসম্পূর্ণ ইন্টারনেট সেবার নিশ্চয়তা দেওয়া হোক।
অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষার্থী তানজীদুল ইসলাম শান্ত বলেন, অনলাইনে পাঠদানের অভিজ্ঞতা আমাদের কারোর নেই। আমরা এই সময়ে পিছিয়ে যাচ্ছি তা যেমন সত্য আবার, অনলাইন ক্লাসে অংশ নিতে গিয়ে নেটওয়ার্ক, ডাটা মূল্য, ডিভাইস না থাকা এ বিষয়গুলো শিক্ষার্থীদের পিছিয়ে দিচ্ছে। অনলাইন শিখন পদ্ধতিতে সুবিধার চেয়ে অসুবিধা বেশি। কোনরকম যাচাই বাছাই বা শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণ ছাড়া এধরনের কার্যক্রম একটি বিরাট অংশকে পিছনে ফেলে দিচ্ছে। আমার নিজের আর্থিক অবস্থা অনুযায়ী অনলাইনে ক্লাস করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। এরকম হাজারো ভূক্তভোগী ছড়িয়ে আছে যারা কিছু বলছেনা। আমি আশা করব কাউকে পিছনে ফেলে নয়, সবাইকে সাথে নিয়ে আমরা এগিয়ে যাবো।
অনলাইন পদ্ধতিতে শিক্ষা কার্যক্রমের বিষয়ে জানতে চাইলে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতির সভাপতি ও শিক্ষা বিজ্ঞান অনুষদের ডীন ড. নেওয়াজ মোহাম্মদ বাহাদুর বলেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে শিক্ষা কার্যক্রম সচল রাখতে অনলাইন পদ্ধতি অবলম্বন করা ছাড়া আমাদের অন্য কোন বিকল্প রাস্তা নেই। আমরা যদি বছরের পর বছর লকডাউনে থাকি তাহলে কি পড়াশোনা বাদ দিয়ে দিবো! বিশ্বের বড় বড় বিশ্ববিদ্যালয়গুলো অনলাইন পদ্ধতিতে তাদের সকল কার্যক্রম চালাচ্ছে। আমরা ২১ সালের মধ্যে ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে এগুচ্ছি। তাহলে কেন আমরা ডিজিটাল উপায়ে এগোতে পারবো না। কমপক্ষে ৮০% শিক্ষার্থীদের হাতে স্মার্টফোন আছে। প্রায় সবাই ফেসবুক চালাচ্ছে, তাহলে কেন শিক্ষার্থীরা অনলাইন ক্লাশে উপস্থিত হতে পারবে না। আর এমনিতেও শতভাগ শিক্ষার্থী ক্লাশে উপস্থিত থাকে না। আর যাদের সমস্যা আছে তাদের সমস্যার সমাধান খুজতে হবে। কোন না কোন উপায় বের করে অনলাইন ক্লাশে উপস্থিত হতে হবে। যেহেতু, অনলাইন পদ্ধতি ছাড়া আমাদের বিকল্প কোন রাস্তা নেই তাই আমাদের এই উপায়েই এগোতে হবে।
অনলাইন পদ্ধতিতে শিক্ষা কার্যক্রম শিক্ষার গুণগত মানকেও প্রশ্নবিদ্ধ করবে বলে মনে করেন সাধারণ শিক্ষার্থীরা। শতভাগ উপস্থিতি নিশ্চিত করা না গেলে শিক্ষাক্ষেত্র বিরাট বৈষম্য দেখা দিবে বলেও তারা আশংকা করেন। গুটিকয়েক শিক্ষার্থী নিয়ে অনলাইনে শ্রেণীকার্যক্রম চালালে পিছিয়ে পড়বে বেশিরভাগ শিক্ষার্থী। সেক্ষেত্রে কিভাবে সমতা বজায় রাখা সম্ভব এই নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন শিক্ষার্থীরা। তাই সকল দিক বিবেচনা করে অনলাইন পদ্ধতিতে শিক্ষা কার্যক্রম চালানোর ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিতে প্রশাসনের কাছে দাবী সাধারণ শিক্ষার্থীদের।