দেশের জাতীয় আয় বৃদ্ধি তথা অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য বিনিয়োগের (অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক) ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। মূলত অভ্যন্তরীণ ভোগ চাহিদা, বিনিয়োগ ও সরকারি খরচের সমন্বয়েই জিডিপি গড়ে ওঠে। বৈদেশিক বাণিজ্যের ব্যালান্সও জাতীয় আয়ের একটি উপাদান।
বাংলাদেশের বিনিয়োগ ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, ষাটের দশকে তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানে বৃহৎ শিল্পে বিনিয়োগের মাধ্যমে অর্থনৈতিক উন্নয়নের প্রচেষ্টা নেয়া হয়। দেশে সোনালি আঁশ পাটের উৎপাদন ও ফলন পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশি হওয়ায় এবং চট, বস্তা, ব্যাগ প্রভৃতি পাটজাত দ্রব্যের বিশ্বব্যাপী চাহিদার ফলে অসংখ্য পাটকল গড়ে ওঠে। এছাড়া পশ্চিম পাকিস্তানে উৎপাদিত তুলা ও বিদেশী তুলা আমদানির মাধ্যমে ব্যবহার করে বস্ত্রকলেরও বিস্তার ঘটে। পাশাপাশি কুটির শিল্পের মাধ্যমে দেশে তৈরি কাপড় যেমন শাড়ি, লুঙ্গি, গামছা, বিছানা ও গায়ে দেয়ার চাদর, শতরঞ্জি প্রভৃতির চাহিদা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে কুটির শিল্পও বিকাশ লাভ করে।
স্বাধীনতার পর পাট ও বস্ত্রকলের মতো বৃহৎ শিল্পগুলো ১৯৭২ সালে জাতীয়করণ করা হয়। বিশ্বব্যাপী পাটের তৈরি দ্রব্যাদির বিকল্প সিনথেটিক ব্যবহার জনপ্রিয় হওয়ায় আমাদের বড় শিল্পগুলো অলাভজনক হয়ে পড়ে। স্বাভাবিকভাবেই বিকল্প হিসেবে ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পের বিকাশ ঘটতে থাকে। শুধু বস্ত্র তৈরির ক্ষেত্রেই নয়, ক্রমান্বয়ে কৃষি যন্ত্রপাতি, দৈনন্দিন ব্যবহার্য জিনিস তথা লাইট ইঞ্জিনিয়ারিং দ্রব্যাদিও এসএমইর মাধ্যমে উৎপাদিত হতে থাকে। আশির দশকে তৈরি পোশাক দেশে একটি উল্লেখযোগ্য শিল্প হিসেবে পরিগণিত হয়, যা ক্রমে বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ রফতানি পণ্য হিসেবে পরিগণিত হয়। শিল্পের বিকাশের ফলে কৃষির ওপর নির্ভরশীলতা কমে গেলেও আধুনিক পদ্ধতি, যন্ত্রপাতি ও সার ব্যবহার করে সরকারি-বেসরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় কৃষিরও ব্যাপক উন্নয়ন হয়। শিল্প ও কৃষির যুগপৎ উন্নয়নের ফলে জনবহুল একটি দেশের খাদ্য ও কর্মসংস্থানে কোনো অসুবিধা হয়নি। মানুষ অধিক হারে কাজ পাওয়ার কারণে অভ্যন্তরীণ ভোগ চাহিদা বাড়তে থাকে। সংগঠিত ব্যবসাসহ স্ব-উদ্যোগে পরিচালিত ক্ষুদ্র ব্যবসার প্রসার লাভের ফলে দেশের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে গতিসঞ্চার হয়। সংগত কারণে প্রায় তিন দশক দেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধিতে ইতিবাচক ধারা অব্যাহত থাকে এবং বিশ্বে বাংলাদেশ একটি উদীয়মান দেশ তথা ‘এ কান্ট্রি অব মিরাকল’ হিসেবে পরিগণিত হয়।
দেশের কর্মসংস্থান, অর্থনৈতিক উন্নয়ন, অবকাঠামো উন্নয়ন, ভোগ চাহিদা বৃদ্ধি প্রভৃতির ফলে অভ্যন্তরীণ বিনিয়োগের পাশাপাশি বাংলাদেশে বৈদেশিক বিনিয়োগও উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে। বলতে গেলে ভোগ্যপণ্যের বহুজাতিক কোম্পানিগুলো এ দেশে ভালো ব্যবসা করছে।
বিশ্বমন্দা, যুদ্ধ, মহামারী প্রভৃতি কারণে বিশ্ব অর্থনীতির গতি পরিবর্তনের ফলাফল বাংলাদেশকেও ছুঁয়ে যায়, কখনো কখনো আমদানি-রফতানি, ব্যবসা ও বিনিয়োগে পড়ে নেতিবাচক প্রভাব। প্রায় ছয় মাস ধরে সারা বিশ্বে নভেল করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব ও সংক্রমণের ফলে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড প্রায় স্থবির হয়ে আছে। পৃথিবীর অন্যান্য দেশের মতো মহামারীতে বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত পরিবহন, ভ্রমণ, পর্যটন ও হোটেল-রেস্তোরাঁ, পোশাক, ফ্যাশন, রফতানি পণ্য, রড সিমেন্ট ও স্টিল খাতে উৎপাদন আগের তুলনায় কমে ৩০-৩৫ শতাংশে নেমেছে। পণ্যের বিক্রয় কমেছে ৭০ শতাংশ। ২০১৯-২০ অর্থবছরের জুলাই-এপ্রিল সময়ে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য রফতানি আয় কমেছে ৩৮ শতাংশ, শুধু এপ্রিলে কমেছে ৮০ শতাংশ। মহামারী বিস্তারের পর থেকে এ পর্যন্ত প্রায় ৩০০ কোটি ডলার তৈরি পোশাক রফতানি আদেশ বাতিল হয়েছে। গত এপ্রিলে ৩৬০ মিলিয়ন ডলারের তৈরি পোশাক রফতানি হয়েছে। ২০১৯ সালের এপ্রিলে রফতানি হয়েছিল ২ দশমিক ৪২ বিলিয়ন ডলার মূল্যের তৈরি পোশাক। গত বছরের তুলনায় এ বছর এপ্রিলে রফতানি কমেছে ৮৪ শতাংশ। পরবর্তী মাসগুলোর অবস্থা আরো খারাপ হওয়ায় আশঙ্কা করা হচ্ছে। ২০১৯ সালে প্রায় ছয় লাখ লোক চাকরি নিয়ে প্রবাসে গিয়েছে। এ বছর বিদেশ যাওয়া দূরে থাক, লাখ লাখ শ্রমিক বেকার হয়ে দেশে ফিরেছেন কিংবা দেশে ফেরার অপেক্ষায় রয়েছেন। সংগত কারণে রেমিট্যান্স আসাও কমে গিয়েছে। তবে বাংলাদেশ ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বেড়ে জুনে ৩৫ বিলিয়ন ডলারে দাঁড়িয়েছে। এর কারণ রেমিট্যান্সের পাশাপাশি বৈদেশিক ঋণ ও অনুদানপ্রাপ্তি এবং আমদানিতে বৈদেশিক মুদ্রার ব্যবহার কম হয়েছে।
সংক্রমণের শুরুর দিকে আইএমএফ ঘোষিত ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক আউটলুক ২০২০ অনুযায়ী, ২০২০ সালে বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি হতে পারে ২ শতাংশ; যা ২০২১ সালে বেড়ে ৯ দশমিক ৫ শতাংশ হতে পারে বলে ভবিষ্যদ্বাণী করা হয়েছে। কিন্তু জুনে বিশ্বব্যাংক যে গ্লোবাল ইকোনমিক প্রসপেক্টাস প্রকাশ করেছে, তাতে বাংলাদেশের ২০২০ সালের প্রবৃদ্ধি ১ দশমিক ৬ শতাংশ এবং ২০২০-২১ সালের প্রবৃদ্ধি আরো কমে ১ শতাংশ হওয়ার আশঙ্কা করা হয়েছে। তবে আগামী বছর বৈশ্বিক গড় প্রবৃদ্ধি ধরা হয়েছে ৪ শতাংশ। তাদের ভাষায়, ৮০ বছরের মধ্যে সবচেয়ে বড় মন্দায় পড়বে বিশ্ব।
বহির্বিশ্বের দেশগুলো থেকে তৈরি পোশাকের রফতানি আদেশ বাতিলের ফলে পোশাক খাতে প্রায় ৫০০ কোটি ডলার ক্ষতির আশঙ্কা করছে বিজিএমইএ। এ পরিস্থিতিতে কারখানাগুলো ৫৫-৬০ শতাংশ সক্ষমতায় চালিয়ে শতভাগ শ্রমিক রাখা সম্ভব নয়। পোশাক শিল্পে প্রায় ৪০ শতাংশ শ্রমিক বেকার হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। অন্যান্য শিল্প-কারখানা থেকেও শ্রমিক ছাঁটাই হচ্ছে। এমনকি দেশের বেসরকারি ব্যাংক, বীমা ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো কর্মী ছাঁটাই ও বেতন কমানোর পদক্ষেপ নিচ্ছে, যা খুবই উদ্বেগজনক।
এদিকে রাজধানী শহরে স্ব-উদ্যোগী বহু পেশাজীবী কর্মহীন হয়ে গ্রামে ফিরে যাওয়ার খবর সংবাদপত্রে প্রকাশিত হচ্ছে। দেশের প্রায় চার কোটি দরিদ্র লোকের সঙ্গে এরই মধ্যে আরো প্রায় দেড়-দুই কোটি লোক যুক্ত হয়েছে মর্মে অভিজ্ঞ মহলের ধারণা।
উপর্যুক্ত আলোচনার প্রেক্ষাপটে দেশের শিল্প-কারখানাগুলো চালু করা, ক্ষতিগ্রস্ত ও লোকসান হওয়া কারখানা পুনরুজ্জীবিত করা যেমন জরুরি, তেমনি অধিক সংখ্যায় কর্মসংস্থানের জন্য প্রয়োজন নতুন শিল্প-কারখানায় বিনিয়োগ। অর্থাৎ দেশে বিনিয়োগ প্রবৃদ্ধি ফিরিয়ে আনা এখন সময়ের দাবি। কভিড-১৯ মহামারী মোকাবেলা করে অর্থনীতি পুনর্গঠনের জন্য পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেছে। গত এপ্রিলে জাপান ১০৮ ট্রিলিয়ন ইয়েন অর্থাৎ ৯৯০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার অর্থনৈতিক প্যাকেজ ও প্রণোদনা ঘোষণা করেছে, যা তাদের জিডিপির প্রায় ২০ শতাংশ। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা ও ইউরোপের বিভিন্ন দেশও শিল্প-কারখানা চালুসহ দরিদ্র ও কর্মহীনদের বেঁচে থাকার জন্য নানা ধরনের প্রণোদনা দিয়ে যাচ্ছে। সিঙ্গাপুর ২৮৫ মিলিয়ন ডলার রেখেছে নতুন ব্যবসা ও বিনিয়োগ চালুকরণ, ঋণ সুবিধা ও চালু শিল্প-কারখানার অর্থায়ন গ্যাপ মেটানোর উদ্দেশ্যে। বাংলাদেশে ১৯টি প্যাকেজে ১ লাখ ৩ হাজার ১১৭ কোটি টাকার প্রণোদনা ঘোষণা করা হয়েছে। মোট প্রণোদনার পরিমাণ জিডিপির ৩ দশমিক ৭ শতাংশ। ব্যাংকের মাধ্যমে হ্রাসকৃত হারে ঋণ হিসাবে এ টাকা দেয়া হবে। এর মধ্যে ৩০ হাজার কোটি টাকা বৃহৎ শিল্পের পুনর্বাসনের জন্য এবং ২০ হাজার কোটি টাকা ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের জন্য।
সার্বিকভাবে বাংলাদেশে বিনিয়োগ পরিবেশ সন্তোষজনক। অভ্যন্তরীণ বিনিয়োগ বা শিল্প স্থাপনে শুল্ককর প্রণোদনা, কাঁচামাল আমদানিতে শুল্ককর ছাড় বা ১ শতাংশ হারে শুল্কারোপ, রফতানিমুখী শিল্প স্থাপন ও পরিচালনায় বন্ড সুবিধায় শূন্য হারে নির্মাণসামগ্রী ও কাঁচামাল আমদানির সুবিধা ইত্যাদি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এছাড়া স্থানীয় শিল্পকে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার সুবিধা দেয়ার জন্য তাদের উৎপাদিত দ্রব্যসামগ্রীর বাণিজ্যিক আমদানির ওপর শুল্কারোপ করা হয়। বাংলাদেশে শিল্প স্থাপন ও বিনিয়োগ লাভজনক হওয়ার আরেকটি অন্যতম কারণ হলো, একটি বিরাট জনগোষ্ঠীর ভোগ চাহিদা বা খরচ করার প্রবণতা। কর্মে নিয়োজিত মানুষের হাতে টাকা থাকলেই খরচের প্রবণতা বাড়ে। ভোগ চাহিদা মেটানোর জন্য সরবরাহ চেইন ঠিক রাখা এবং মুনাফার স্বার্থে শিল্পোৎপাদনও বৃদ্ধি পায়।
এ অবস্থায় দেশের বর্তমান নভেল করোনাভাইরাস সংক্রমণ পরিস্থিতির আশু উন্নতির জন্য জনসচেতনতার পাশাপাশি দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার উন্নয়ন জরুরি। পাশাপাশি দেশে কৃষি, পোলট্রি, ডেইরি, নির্মাণসামগ্রী যেমন স্টিল, রড, সিমেন্ট ও ফার্মাসিউটিক্যালস, সেলফোন, আইসিটি সামগ্রী, ল্যাপটপ, কম্পিউটার, লাইট ইঞ্জিনিয়ারিং এবং খাদ্যসামগ্রী উৎপাদন শিল্পে বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। সরকার ঘোষিত প্রণোদনার অর্থ দ্রুত ছাড়করণের প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে। প্রণোদনা ছাড়করণের বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর অসহযোগিতা ও অনীহার কথা শোনা যাচ্ছে। এসএমই শিল্পের জন্য ঘোষিত ২০ হাজার কোটি টাকার মধ্যে জুন পর্যন্ত মাত্র ৫০ কোটি টাকা ছাড় হয়েছে। বৃহৎ শিল্পের ক্ষেত্রেও অংকটি আশানুরূপ নয়। এ ব্যাপারে সরকার ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের আশু পদক্ষেপ গ্রহণ জরুরি।
এবার বৈদেশিক বিনিয়োগ (ফরেন ডাইরেক্ট ইনভেস্টমেন্ট) বিষয়ে আলোচনায় আসা যাক। বিদেশী পুঁজি বিনিয়োগের সরাসরি সুবিধাগুলো হলো শিল্পায়নের মাধ্যমে কর্মসংস্থান, প্রযুক্তি হস্তান্তর এবং বাজার সুবিধা ও দক্ষতার সম্প্রসারণ। বাংলাদেশে বৈদেশিক বিনিয়োগ আকর্ষণের জন্য নানা সুবিধা বর্তমান। কেন্দ্রীয় ব্যাংকে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ যেমন পর্যাপ্ত, বৈদেশিক মুদ্রার ওঠানামাও কম। মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের মধ্যে (মাত্র ৫-৬ শতাংশ) রয়েছে। শ্রমিক সস্তা এবং ইলেকট্রিসিটি সরবরাহ ৯০ শতাংশের ঊর্ধ্বে। শুল্ককর অব্যাহতি ও নিম্নহার যেকোনো দেশের তুলনায় ভালো। অর্থনৈতিক অঞ্চল, হাইটেক পার্ক ও রফতানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চলে বিনিয়োগ, আইসিটি, কৃষি উপকরণ শিল্প ও পোলট্রি খাতে বিনিয়োগ এবং জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খাতে ১০-১৫ বছরের জন্য ১০০ শতাংশ শুল্ক-কর ছাড়ের ব্যবস্থা রয়েছে। রফতানিযোগ্য শিল্পে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে রয়েছে শুল্কমুক্ত বন্ডেড ওয়্যারহাউজ সুবিধা। আরো আছে মূলধন লাভ ও লভ্যাংশ বিদেশে পাঠানোর অবারিত সুযোগ এবং ২০২৪ সাল পর্যন্ত এলডিসি সুবিধা।
ব্যবসা সহজ সূচকে ১৯০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১৬৮তম। জমি রেজিস্ট্রেশন সহজীকরণ, বিদ্যুতের প্রাপ্যতা ও কিছু প্রাতিষ্ঠানিক সুবিধা বাড়ানোর দিকে দৃষ্টি দেয়া হলে ব্যবসা সহজীকরণ সূচকে (ইজ অব ডুয়িং বিজনেস) আরো উন্নতি করা সম্ভব।
নভেল করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব শুরু হয় গত জানুয়ারিতে চীনের উহান প্রদেশে। ক্রমান্বয়ে মার্চের মধ্যে এ ভাইরাসের সংক্রমণ ইউরোপ, আমেরিকাসহ সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে। আমেরিকা, ইউরোপ ও জাপানের মতো উন্নত দেশগুলো কভিড-১৯ সংক্রমণ ছড়িয়ে দেয়ার জন্য চীনকে দায়ী করছে। গণপ্রজাতন্ত্রী চীনে এসব দেশের বহু শিল্পপ্রতিষ্ঠান রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ও জাপানের প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবে এপ্রিলের প্রথম দিকেই ঘোষণা করেছেন যে তারা চীন থেকে তাদের শিল্পপ্রতিষ্ঠান অন্যত্র সরিয়ে নেবেন। সেজন্য তারা শিল্প মালিকদের জন্য ক্ষতিপূরণ প্যাকেজ ও স্থানান্তর খরচ বহনের ঘোষণাও দিয়েছেন।
গত ৩০ মে ইন্দোনেশিয়ার সিএনবিসি টেলিভিশনের খবরে জানা গেছে যে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প তার দেশের ২৭টি শিল্প চীন থেকে ইন্দোনেশিয়ায় স্থানান্তর করবেন। ইন্দোনেশিয়ার প্রেসিডেন্ট জোকো উইদোদো এ ব্যাপারে সরাসরি প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ও ওইসব আমেরিকান কোম্পানির কর্তাব্যক্তিদের সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন। বিভিন্ন ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্কে এসব শিল্পপ্রতিষ্ঠানকে পাঁচ বছরের জন্য বিনা মূল্যে পর্যাপ্ত জমি দেয়া হবে। ইন্দোনেশিয়ায় আরো রয়েছে প্রচুর উৎপাদনশীল দক্ষ শ্রমিক ও অবকাঠামোগত সুবিধা।
জাপানের শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলোর স্থানান্তর গ্রহণের জন্য ভিয়েতনাম, ভারত, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, থাইল্যান্ড ও বাংলাদেশের সম্ভাবনা বেশি। এরই মধ্যে ভারত সরকার গুজরাট, মহারাষ্ট্র, তামিলনাড়ু ও অন্ধ্র প্রদেশে ৪ লাখ ৬১ হাজার ৫৮৯ হেক্টর জমি অর্থনৈতিক অঞ্চল ঘোষণা করে জাপান, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ উন্নত দেশগুলোর শিল্প স্থাপনের জন্য প্রস্তুত করেছে এবং সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশ সরকারও বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ ও বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে জাপানি ও কয়েকটি ইউরোপীয় দেশের বিনিয়োগ লাভের আশায় আলোচনার উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। এজন্য প্রয়োজন হবে সরকারি অর্থনৈতিক অঞ্চলে একটি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য নামমাত্র মূল্যে জমি প্রদান। প্রয়োজনে নতুন অর্থনৈতিক অঞ্চলও প্রতিষ্ঠা করা যেতে পারে। এ লক্ষ্যে সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর সঙ্গে কূটনৈতিক পর্যায়েও জোর আলোচনা চালানো যেতে পারে। বর্তমান প্রেক্ষাপটে চীন থেকে শিল্প স্থানান্তর ছাড়াও বাংলাদেশে হেলথ কেয়ার, ফার্মাসিউটিক্যালস ও এর উপাদান তৈরি, খাদ্য ও কৃষি শিল্প, আইসিটি, গাড়ি ও মোটরসাইকেল নির্মাণ শিল্প, ইলেকট্রনিকস, মোবাইল ফোন সেট, ল্যাপটপ-কম্পিউটার, ইলেকট্রিক ট্রান্সফরমার, কম্প্রেসার তৈরির জন্য বিদেশী বিনিয়োগ আকর্ষণের সুযোগ রয়েছে। কোরিয়ান কোম্পানি স্যামসাং, জাপানের কয়েকটি ইলেকট্রনিকস প্রস্তুতকারক কোম্পানি, জাপানের মিত্সুবিশি, কোরিয়ান হুন্দাই বাংলাদেশে বিনিয়োগের জন্য আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে। জাপানের শিপ আইচি নামক একটি প্রতিষ্ঠান উত্তরায় ইস্ট-ওয়েস্ট জাপান মেডিকেল কলেজে প্রচুর বিনিয়োগ করছে। তাদের অনুসরণে স্বাস্থ্য খাতে আরো বিনিয়োগের সম্ভাবনা রয়েছে। চীন সে দেশে বাংলাদেশ থেকে ৯৭ শতাংশ পণ্য রফতানিতে শুল্কমুক্ত ও কোটামুক্ত সুবিধা দিয়ে একটি এমওইউ স্বাক্ষর করেছে, যা ১ জুলাই থেকে কার্যকর হবে। ফলে রফতানিমুখী শিল্প স্থাপনে চীনা বিনিয়োগ পাওয়ার সম্ভাবনা উন্মুক্ত হয়েছে। গত বছর (২০১৯) চীন থেকে বাংলাদেশে জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খাতে ১ দশমিক ১৬ বিলিয়ন ডলারের বিনিয়োগ হয়েছে, যা ওই বছরের সবচেয়ে বড় বিনিয়োগ। তবে বিদ্যুৎ খাতে আরো বিনিয়োগ নিরুৎসাহিত করা হচ্ছে।
বাংলাদেশ বিশ্বের ১১টি উদীয়মান অর্থনীতির মধ্যে নবম স্থানে রয়েছে। গত প্রায় তিন দশকের ক্রমবর্ধনশীল প্রবৃদ্ধি, স্বল্পোন্নত দেশ থেকে মধ্যম আয়ের দেশে উত্তরণ এবং স্থিতিশীল রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক পরিস্থিতির কারণে আশা করা যাচ্ছে যে শিগগিরই দেশটি করোনা মহামারীর অর্থনৈতিক সংকট কাটিয়ে বৈদেশিক বিনিয়োগ আকর্ষণ করতে পারবে এবং দেশীয় নতুন-পুরনো বিনিয়োগে গতিসঞ্চার হবে।
মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়া: সাবেক সিনিয়র সচিব ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের সাবেক চেয়ারম্যান