আমার প্রথম বিদেশ সফরের গল্প দিয়ে আলোচনাটি শুরু করা যাক। ইমিগ্রেশনে লাইনে দাঁড়িয়ে আছি। হঠাৎ একজন পুলিশের ইন্সপেকটর আমাকে একটি ফাঁকা কাউন্টারে আসার আমন্ত্রণ জানালে খুশি হয়েছিলাম যতটুকু তারচেয়ে বেশি আঘাত পেয়েছিলাম আমার পিছু পিছু আসতে চাওয়া দুজনকে তিনি তীব্র ভৎসনা করে পূর্বের দীর্ঘ লাইনে যেতে বাধ্য করেছিলেন বলে।
আমি সেদিন না বুঝলেও আজ বুঝতে কোন অসুবিধা নেই যে পাসপোর্টের রংয়ের কারনে এই অম্ল/মধুর আচরণটি ছিল তার।
গল্পটি আসলে এটি নয়। গল্পটি হলো, আমরা দুজন বাংলাদেশী যখন দেখলাম রাতের খাবারের জন্য আমার সফরকৃত ঐ উন্নত দেশের একটি ফাইভ স্টার হোটেলের ডাইনিংয়ে সবাই লাইনে দাড়িয়ে আছে। লাইনটি ৭০/৭৫ জনের হবে।
কিন্তু এত বড় লাইনে দাঁড়ানোতো আমার সংস্কৃতি না!
তাই লাইনের মাথায় আমরা দুজন বাংলাদেশী আরেকটি ছোট লাইন করলাম। লাইনে এবার একজন বৃদ্ধ লোকের খাবার নেয়ার পালা। বৃদ্ধের সাথে আমিও হাত বাড়ালাম প্লেট নিতে। তখনই পেলাম জীবনের শ্রেষ্ঠ শিক্ষা।
কি ছিল শিক্ষাটি?
শুনুন। তিনি আমাকে প্লেট ছেড়ে বললেন, "ইয়ংম্যান, প্লিজ ইউ ফাস্ট!" আমরা দুজন বাংলাদেশী খাবার নিয়েছিলাম ঠিকই, কিন্তু মাথা নিচু করে খেয়েছিলাম। আর সেমিনারে আসা ৭০টি দেশের নাগরিকেরা দেখেছিল, লাইন ভেঙে বেলাইনে যাওয়া দু'জন বাংলাদেশীকে।
পরদিন সেমিনার কক্ষে পৌছে দেখলাম, সেমিনারের প্রধান আলোচক ঐ বৃদ্ধ মানুষটি। আমারা মাথা নিচু করে বসে থাকলাম। কিন্তু প্রফেসর রোনাল্ড বিষয়টি স্বাভাবিক করতে আমার প্রোফাইল (হবি) দেখে আমাকে গান গাইতে মঞ্চে ডাকলেন। আর মুহু মুহু করতালি আর ধ্বনিত হলো "মোহাম্মদ মোহাম্মদ"। হলটি যেন উৎসবে ভরে উঠল। পরক্ষণেই বুঝতে পারলাম আমার ফাষ্ট নেম "মোহাম্মদ" শব্দটি ধ্বনিত হচ্ছে। আমি একটি দেশ গান করে স্বাভাবিক হয়েছিলাম। তারপর যতদিন ছিলাম, ততদিন প্রফেসর রোনাল্ডের এক্সট্রা কেয়ার পেয়েছিলাম।
এটা কি কেবল আমার দোষ ছিল? মোটেই না। বরং এটা দেখে দেখেই আমি বড় হয়েছিলাম যে, লাইনে দাঁড়িয়ে টিকিট পাওয়া যায় না! সেটা বাসের হোক, ট্রেনের হোক কিংবা সিনেমার? তাই দুটি পয়সা খরচ করে কালো বাজার থেকেই কিনতে আমরা অভ্যস্ত বা স্বচ্ছন্দ বোধ করি। কিংবা কাউন্টারের মুখে জটলা পাকিয়ে দুই তিনটি লাইন করি।
তাছাড়া আরেকটি ভাবনাতো জাতি হিসেবে আমাদের আছেই, অর্থাৎ আমিতো বিশেষ কেউ! তাৎক্ষনাত আমি বা আমরা কোন না কোন ভাবে অমুক বা তমুকের লোক হয়েই যাই! মুখে না বললেও ভাবে বুঝিয়ে দেই, আমাকে চেনেন? আমি লাইন ধরবো কেন? লাইন তো আপনার মতো আম জনতার জন্য!
এভাবে যিনি লাইন ধরে আজ বঞ্চিত হয়েছেন, তিনিও পরদিন ভিআইপি ধরেন বা ভিআইপির চেলা চামচা হতে তৎপরতা দেখান। আর এভাবেই এদেশে ভি আই পি সংস্কৃতি আরো শক্ত পোক্ত হয়।
ফিরতি পথে, সিঙ্গাপুরে যাত্রা বিরতিতে যাত্রী লাউঞ্জে একজন মাননীয় প্রতিমন্ত্রীকে দেখে সবাই অবাকই হয়েছিল যে, তিনি কোন প্রকার প্রটোকল ছাড়া সাধারণ যাত্রীদের সাথে কিভাবে!
সিঙ্গাপুর এয়ারপোর্ট না পারলেও ঢাকা এয়ারপোর্ট তাঁকে যথাযথ সম্মান প্রদর্শন করায় সে দিন স্বস্তি ফিরে এসেছিল সকল সহ যাত্রীদের মধ্যে।
গল্পটি এখানেই শেষ নয়, গল্পটি ছিল আরোও বেদনা দায়ক। যখন এয়ারপোর্ট থেকে বের হচ্ছিলাম, তখন দেখেছিলাম একজন তরুণ কাস্টমস অফিসার পঞ্চাশ উর্ধো একজন প্রবাসী ভাইকে (রেমিটেন্স যোদ্ধা) তুই তোয়াক্কী ও গালি গালাজ করছেন। তখন রক্ত গরম হয়ে গিয়েছিল, তীব্র ভাষায় কৈফিয়ত চাইলাম। সে দিন ঐ অফিসার শুধু নমনীয় হয়েছিল আমার হাতে রক্ষিত পাসপোর্টের কালার দেখে।
এখন প্রশ্ন হলো, এ দেশে একদা ইংরেজরা জমিদারী প্রথা চালু করেছিল, চালু করেছিল জমিদার ও প্রজার সংস্কৃতি। কিন্তু বাঙ্গালীতো ঐ দীর্ঘস্থায়ী শোষণ বঞ্চনা থেকে একটি রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন হয়ে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে প্রতিষ্ঠা করেছে "গণ প্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ"। এর অর্থ দাঁড়ায় রাষ্ট্রের মালিক জনগণ। বঙ্গবন্ধু আজীবন দুঃখী ও সাধারণ মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য সংগ্রাম করে গেছেন। তাঁর সুযোগ্য কন্যাও দুঃখি ও সাধারণ মানুষের জন্য নিজেকে উৎসর্গ করেছেন। শুধু তাই নয়, যে দেশে হাইকোর্ট রায় দেয়, রাষ্ট্রপ্রতি ও প্রধানমন্ত্রী ছাড়া দেশে কোন ভি আই পি নেই। যেখানে প্রকৃত ভিআইপি দুজন (মহামান্য রাষ্ট্রপতি ও মাননীয় প্রধানমন্ত্রী) রিক্সা বা ভ্যানে চড়ে অনন্য নজির সৃষ্টি করেন; সে দেশে যখন বিবিসি নিউজ করে "মহামারীতেও পরিবর্তন হয়নি বাঙালির ভিআইপি সংস্কৃতি" (বিবিসি বাংলা, ২৬ জুন ২০২০) অর্থাৎ করোনা টেস্ট, হাসপাতালে ভর্তি, কেবিন, আইসিইউ ইত্যাদি ক্ষেত্রে ভিআইপিদের চাপ, লবিং ইত্যাদি তখন ঐ নিউজ পড়ে মনে বড়ই দুঃখ হয়। আর দুঃখ ভারাক্রান্ত হৃদয়ে জানতে ইচ্ছে করে, যে রাষ্ট্রের ভিআইপি মাত্র দুজন (হাইকোর্টের রায় অনুযায়ী) সে রাষ্ট্রে এত ভিআইপি কোথা থেকে আসে?
জি এম কিবরিয়া
প্রধান সমন্বয়কারী
ক্লিন গ্রিণ বাংলাদেশ।