পুঁজিবাজারের তালিকাভুক্ত সিভিও পেট্রোকেমিক্যালসহ ১২টি কোম্পানি থেকে ভেজাল ভেজাল তেল না কেনার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি)। একই সাথে কোম্পানিগুলোকে কনডেনসেট (গ্যাসের উপজাত) না দেওয়ারও সিদ্ধান্ত হয়েছে। গত ১জুলাই থেকে এটি কার্যকর করা হয়েছে।
কোম্পানিগুলো হলো-সিভিও পেট্রোকেমিক্যাল,সুপার রিফাইনারি লিমিটেড, অ্যাকোয়া মিনারেল টারপেনটাইন অ্যান্ড সলভেন্টস প্ল্যান্ট লিমিটেড, পিএইচপি পেট্রো রিফাইনারি, চৌধুরী রিফাইনারি, গোল্ডেন কনডেনসেট অয়েল রিফাইনারি, জেবি রিফাইনারি, ইউনিভার্সেল রিফাইনারি, লার্ক পেট্রোলিয়াম, সিনথেটিক রেজিন প্রোডাক্টস, রূপসা ট্যাংক টার্মিনাল ও কার্বন হোল্ডিং লিমিটেড। কনডেনসেট না দেওয়ায় বন্ধ হচ্ছে সরকারি বেসরকারি ১২টি ফ্রাকশনেশন প্ল্যান্ট। কোম্পানিগুলো এতদিন স্থানীয় বাজার থেকে কনডেনসেট নিয়ে পরিশোধনের মাধ্যমে জ্বালানি তেল উৎপাদন করত।
বিপিসি চেয়ারম্যান সামছুর রহমান বলেন, মোট ১২টি ফ্রাকশনেশন প্ল্যান্টের কাছ থেকে তারা জ্বালানি তেল কেনা বন্ধ করে দিয়েছেন। ওই প্ল্যান্টগুলোতে কনডেনসেট দেয়াও বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। তিনি বলেন, কোম্পানিগুলোর উৎপাদিত অকটেন ও পেট্রলে আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনযুায়ী ‘অকেটেন নাম্বার’ থাকত না।
অভিযোগ আছে, দীর্ঘদিন ধরে এসব ফ্রাকশনেশন প্ল্যান্ট সরকারের কাছ থেকে কনডেনসেট কিনে ভেজাল অকটেন ও পেট্রল উৎপাদন করে বিপিসির কাছে বিক্রি করত। একই সঙ্গে পরিশোধন না করে অকটেন ও পেট্রলের সঙ্গে মিশিয়ে তা বিভিন্ন পেট্রলপাম্পে বিক্রি করে দিত। বিপিসি এসব অসাধু ফ্রাকশনেশন প্ল্যান্টগুলোকে একাধিকবার সতর্ক করেও ভেজাল তেল উৎপাদন বন্ধ করতে পারেনি। সর্বশেষ ৩ মাসের সময় বেঁধে দিলেও তারা ভেজাল বন্ধ করেনি। শেষ পর্যন্ত ১ জুলাই থেকে এই ১২টি ফ্রাকশনেশন প্ল্যান্ট থেকে জ্বালানি তেল না কেনা এবং কোম্পানিগুলোকে কনডেনসেট না দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়।
জ্বালানি বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, রিফাইনারি কোম্পানি বা ফ্রাকশনেশন প্ল্যান্টগুলো পরিশোধন না করে জ্বালানি তেল ভেজাল করে গত ১৬ বছরে ৭ হাজার ৫৬০ কোটি টাকার বেশি অর্থ লোপাট করেছে। ২০০০ সাল থেকে থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত এক হিসাবে এই অর্থ লোপাটের ঘটনা ঘটেছে।
জানা গেছে ২০০০ সাল থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত ১৬ বছরে সরকারি বেসরকারি রিফাইনারি কোম্পানি পেট্রবাংলার কাছ থেকে ১৮৬ কোটি ৯৩ লাখ লিটার কনডেনসেট নিয়েছে। এ ছাড়া আমদানি করা কনডেনসেটের পরিমাণ ছিল ২৬ কোটি ৬৭ লাখ লিটার। আমদানিসহ মোট কনডেনসেট নিয়েছে ২১২ কোটি লিটার। কিন্তু জ্বালানি তেল (অকটেন-পেট্রল) হিসেবে পরিশোধন করে বিপিসিকে দিয়েছে মাত্র ১০৩ কোটি ৮৭ লাখ লিটার। বিপিসি বলছে, এ সময়ে মোট ১০৮ কোটি লিটার কনডেনসেটের কোনো হিসাব দিতে পারেনি ফ্রাকশনেশন প্ল্যান্ট কোম্পানিগুলো।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিপিসির একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, রিফাইনারিগুলো এই ১০৮ কোটি লিটার কনডেনসেট পরিশোধন না করে অকটেন পেট্রলের সঙ্গে মিশিয়ে ভেজাল আকারে পেট্রল পাম্পগুলোতে বিক্রি করে দিয়েছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, লিটারপ্রতি অকটেন ও পেট্রল ও ডিজেলের মাঝামাঝি রেট ৭০ টাকা হিসেবে ধরলে মোট সাত হাজার ৫৬০ কোটি টাকা লোপাট হয়েছে। একই সঙ্গে ১৬ বছরে ১০৮ কোটি লিটার ভেজাল তেল বাজারে ছড়িয়ে পড়েছে।
আরও পড়ুন
বর্তমানে দেশে তিনটি সরকারি ও ১২টি বেসরকারি তেল রিফাইনারি বা ফ্রাকশনেশন প্ল্যান্ট রয়েছে। তারা পেট্রোবাংলার কাছ থেকে কনডেনসেট কেনে। কনডেনসেট থেকে পেট্রল অকটেন ও অন্যান্য জ্বালানি তেল উৎপাদন করে বিপিসির কাছে বিক্রি করে। কিন্তু অভিযোগ আছে কিছু রিফাইনারি পেট্রলপাম্প মালিকদের সঙ্গে যোগসাজশে ক্রয় করা কনডেনসেট পরিশোধন (রিফাইন) না করেই পুরোটাই ভেজাল আকারে পাম্পগুলোতে বিক্রি করে দিচ্ছে। এর ফলে গাড়ির ইঞ্জিন নির্ধারিত সময়ের অনেক আগেই বিকল হয়ে যাচ্ছে। পাশাপাশি দূষণ হচ্ছে পরিবেশও।
১২টি রিফাইনারির বিরুদ্ধে প্রায় ১৫০০ কোটি টাকার দুর্নীতি ও লুটপাটের অভিযোগ নিয়ে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) তদন্ত করছে।
জ্বালানি বিভাগের অপর এক কর্মকর্তা বলেন, ১২ কারখানায় ফেব্রুয়ারি বা মার্চের মধ্যে কনডেনসেট বন্ধ করে দেয়ার কথা ছিল। কারণ, তাদের উৎপাদিত পণ্যের মান (বিএসটিআই গ্রেড) ৭০ থেকে ৮২ পর্যন্ত। কিন্তু পেট্রলের ন্যূনতম মান ৮৫ নির্ধারণ করেছে বিএসটিআই। ১২ কারখানা আধুনিকায়নের জন্য মালিকপক্ষকে অনেক তাগাদা দেয়া হয়েছে। তারা কথা শুনছেন না। তাই তাদের কাঁচামাল (কনডেনসেট) বন্ধ করে দেয়া হয়েছে।