কোভিড-১৯-এর দুর্যোগকালে সারা বিশ্বের শিক্ষাব্যবস্থা ও শিক্ষাকার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে। বাংলাদেশও এর ব্যতিক্রম নয়। সাম্প্রতিক সময়ে ইউনেস্কোর দেওয়া তথ্যমতে, কোভিড-১৯ পরিপ্রেক্ষিতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় বিশ্বের প্রায় ১৬৫টি দেশের দেড় বিলিয়ন শিক্ষার্থী প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনা থেকে বিচ্ছিন্ন। বাংলাদেশের শিক্ষার্থীদের স্বাস্থ্যঝুঁকি এবং নিরাপত্তা বিবেচনায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো এখনো ছুটির আওতায়ই রয়ে গেছে। অবস্থার উন্নতি না হলে আগামী সেপ্টেম্বর পর্যন্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকতে পারে বলে ইতিপূর্বে জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। এমতাবস্থায়, গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দেখা দিয়েছে শিক্ষাকার্যক্রমের স্থবিরতা কাটানো। এই স্থবিরতা কাটানোর লক্ষ্যে বেসরকারি কিছু বিশ্ববিদ্যালয় অনলাইনে নিজেদের শিক্ষাকার্যক্রম চালিয়ে নেওয়ার প্রয়াস নিয়েছে। তাছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে চলমান সেমিস্টার শেষ করতে অনলাইনের মাধ্যমে ক্লাস-পরীক্ষা ও খাতা মূল্যায়ন করার বিষয়টিও অনুমোদন করেছে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন। আপাতদৃষ্টিতে এই প্রয়াসকে সময়োপযোগী ও প্রয়োজনীয় বলা যায়। যদিও বাংলাদেশে ই-লার্নিংয়ের বা অনলাইন ক্লাসের চর্চা উল্লেখযোগ্য মাত্রায় শুরু হয়নি এখনো। বর্তমানে করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের ফলে সৃষ্ট পরিস্থিতির কারণে সংশ্লিষ্টবোদ্ধারা ই-লার্নিংয়ের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করছেন।
অনলাইন ক্লাসের জন্য প্রয়োজন কম্পিউটার, ল্যাপটপ, স্মার্টফোন ও দ্রুতগতির নিরবচ্ছিন্ন ইন্টারনেট সেবা, এগুলো আয়ত্তের মধ্যে না থাকলে কোনোভাবেই অনলাইনে ক্লাসে যোগ দেওয়া সম্ভব না। তাই অনলাইনে ক্লাসে অংশগ্রহণের জন্য আর্থিক সক্ষমতাও একটি বড় বিষয়। শহরকেন্দ্রিক মধ্যবিত্ত বা উচ্চবিত্ত পরিবারের শিক্ষার্থীদের জন্য অনলাইন ক্লাসে কোনো প্রতিবন্ধকতা না থাকলেও, অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল কিংবা নিম্নমানের ইন্টারনেট সংযোগসম্পন্ন এলাকায় যারা অবস্থান করছে, তাদেরকে বাইরে রেখে অনলাইন শিক্ষাকার্যক্রম চালিয়ে যাওয়া হবে কষ্টকর। ভার্চুয়াল ক্লাস পরিচালনার জন্য যে কারিগরি দক্ষতার ও প্রশিক্ষণের প্রয়োজন, তারও সংকট রয়েছে কোনো কোনো ক্ষেত্রে। বিজ্ঞান ও গবেষণার ছাত্রদের পড়াশোনা বেশির ভাগ ল্যাবকেন্দ্রিক। অনলাইনে পাঠদান তাদের তেমন কোনো সুবিধা দিতে পারবে না। ডিজিটাল ক্লাসের যে মেডথ, অনেক শিক্ষক সেই সম্পর্কে এখনো অবহিত নন যথাযথভাবে।
অনলাইন ক্লাসের নানারকম অসুবিধার সঙ্গে সঙ্গে এ কথাও মানতে হবে যে করোনা ভাইরাসের কারণে এক অনির্ধারিত ছুটির কবলে পড়েছে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো। সেশনজট বাড়ছে, পড়াশোনা নিয়ে অনিশ্চয়তায় পড়েছেন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রায় সোয়া ৮ লাখ শিক্ষার্থী। এ পরিস্থিতিতে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো নতুন ভর্তি, ক্লাস নেওয়া, পাঠ্যক্রম শেষ করা, পরীক্ষা গ্রহণ ও ফল প্রকাশে সামগ্রিক জটের মধ্যে পড়ে গেছে। এমতাবস্থায় অনেক বিশেষজ্ঞ মনে করছেন, এই মুহূর্তে অনলাইন ক্লাসের বিকল্প নেই। তাদের মতে, অনলাইন ক্লাসের জন্য শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের প্রস্তুত করতে হবে। কারণ, শিক্ষার্থীদের দীর্ঘ ক্ষতির মুখে ফেলা যাবে না। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের সুযোগ-সুবিধা বাড়িয়ে অনলাইন ক্লাস নেওয়া সম্ভব। বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে বিশ্লেষণ করতে গেলে, বিশ্বের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় এখন অনলাইনে শিক্ষা কার্যক্রম শুরু করেছে। করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাবকালীন সময়ে চীন সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করে। উদাহরণস্বরুপ, করোনা শুরুর মাস তিনেকের মধ্যে চীনের Zhejiang University তাদের সব শিক্ষার্থীকে এই ই-লার্নিং পদ্ধতির আওতায় নিয়ে আসে। বিদেশি শিক্ষার্থীরাও এই সুযোগ লাভ করে, এমনকি কিছু কোর্স বিশ্বব্যাপী সব শিক্ষার্থীর জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়। ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় ২০২১ সালের জুন পর্যন্ত তাদের সব প্রোগ্রাম অনলাইনে করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। আমেরিকা থেকে কিছু বাংলাদেশি শিক্ষক বলছেন, তাদের লেখাপড়ার এক ঘণ্টাও ব্যাঘাত হয়নি। কারণ, তাদের অনলাইন অবকাঠামো তৈরি ছিল। যথাযথ পরিকল্পনা করে ঘোষণা দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই সবাই অনলাইনে। লকডাউনে কিন্তু লেখাপড়া কার্যক্রম বন্ধ নেই। করেনার এই সংকট দেশের অর্থনীতিসহ বিভিন্ন খাতকে মারাত্মকভাবে প্রভাবিত করেছে। শিক্ষা খাতও এর বাইরে নয়। অন্যান্য খাতের মতো শিক্ষা খাতের এই ক্ষতিও স্বীকার করে নিতে হবে। স্বপ্ল মেয়াদে এই ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে হলে অনলাইন ক্লাসের বিকল্প নেই। সূত্র: দৈনিক ইত্তেফাক
লেখক: বিভাগীয় প্রধান, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ,
বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, রংপুর।