সুপারিশ মানুষের নৈতিক মূল্যবোধের পরিচায়ক। আমাদের জীবনের এক গুরুত্বপূর্ণ অনুসঙ্গ। সুপারিশ করা, কারো জন্য মধ্যস্থতা হওয়া, কারো প্রয়োজন সমাধা করার জন্য কারো কাছে আবেদন করা একটি সামাজিক আমল। সব এলাকা ও সব জমানাতেই তা পাওয়া যায়। কারো উপকার করা কিংবা অপকার দূর করার জন্য কারো কাছে আবেদন করা অত্যন্ত সওয়াবের কাজ।
সুপারিশের এই আমলটি কখনো শরিয়তসম্মত হয় আবার কখনো বা শরিয়তসম্মত হয় না। মহান আল্লাহ বলেন, ‘যদি কেউ কোনো ভালো (কাজের) সুপারিশ করে তাহলে তাতে তার অংশ থাকবে, আর কেউ কোনো মন্দ (কাজের) সুপারিশ করলে তাতে তার অংশ থাকবে; আর আল্লাহ সর্ব বিষয়ে নজর রাখেন।’ (সূরা নিসা, আয়াত : ৮৫) অর্থাৎ যে ব্যক্তি কারো বৈধ অধিকার ও বৈধ কাজের জন্যে বৈধ পন্থায় সুপারিশ করবে, সেও সওয়াবের অংশ পাবে। তেমনিভাবে যে ব্যক্তি কোনো অবৈধ কাজের জন্য অথবা অবৈধ পন্থায় সুপারিশ করবে, সে আজাবের অংশ পাবে।
সুপারিশের সওয়াব ও আজাব সুপারিশ সফল হওয়ার উপর নির্ভরশীল নয়, বরং সুপারিশ করলেই সওয়াব অথবা আজাব হবে। আপনি ভালো সুপারিশ করলেই সওয়াবের অধিকারী হয়ে যাবেন এবং মন্দ সুপারিশ করলেই আজাবের যোগ্য হয়ে পড়বেন-আপনার সুপারিশ কার্যকরী হোক বা না হোক।
সুপারিশের প্রতিদান : ভালো কাজে সুপারিশ করা একটি সৎকর্ম। সৎকর্মে সাহায্য সম্পর্কে মহান আল্লাহ বলেন, ‘সৎকর্ম ও খোদাভীতিতে একে অন্যের সাহায্য কর। পাপ ও সীমালঙ্ঘনের ব্যাপারে একে অন্যের সহায়তা করো না।’ (সূরা মায়েদা, আয়াত : ২)
এ ছাড়াও স্পষ্টভাবে বিভিন্ন হাদিসে সুপারিশ করার ফজিলত বর্ণিত হয়েছে। রাসূল (সা.) বলেন, ‘আল্লাহতায়ালা ততক্ষণ পর্যন্ত বান্দার সাহায্য অব্যাহত রাখেন, যতক্ষণ সে কোনো মুসলমান ভাইয়ের সাহায্যে ব্যাপৃত থাকে। তোমরা সুপারিশ কর, সওয়াব পাবে। অতঃপর আল্লাহ স্বীয় পয়গাম্বরের মাধ্যমে যে ফয়সালা করেন তাতে সন্তুষ্ট থাক।’
রাসূল (সা.) বলেন, ‘মুসলমান মুসলমানের ভাই। সে তার ওপর জুলুম করতে পারে না, তাকে অপমানিত করতে এবং শত্রুর হাতে তুলে দিতে পারে না। আর যে তার ভাইয়ের প্রয়োজন পূরণ করে, আল্লাহ তার প্রয়োজন পূরণ করে দেন। যে (দুনিয়াতে) কোনো মুসলমানের একটি বিপদ ও দুশ্চিন্তা দূর করে দেয় আল্লাহ কিয়ামতের দিন তার বিপদ ও দুশ্চিন্তা দূর করে দেবেন।’ (সহিহ বোখারি, হাদিস : ২৪৪২)
হজরত মুয়াবিয়া (রা.) থেকে বর্ণিত, নবীজি (সা.) বলেন, ‘সুপারিশ করে সওয়াব অর্জন কর, তোমাদের কোনো প্রয়োজন দেখলে আমি তা মাথায় রাখি যে, কখন তা সমাধান করে সওয়াবের অংশীধার হবো।’ (সুনানে আবু দাউদ, হাদিস : ৫১৩২)
হজরত আবু মুসা আশআরি (রা.) বর্ণিত, নবীজি (সা.)-এর খেদমতে যখন কোনো অভাবী কোনো প্রয়োজনে এসে প্রয়োজন পূরণ করার আবেদন করত, তখন তাঁর মজলিসে যারা থাকতেন তাদের দিকে মুখ ফিরিয়ে তিনি বলতেন, ‘তোমরা এই অভাবগ্রস্তের জন্য আমার কাছে সুপারিশ করো, ফের তোমরা সুপারিশ করার সওয়াব পাও।‘ সহিহ বোখারি, হাদিস : ১৪৩২)
দোয়া করাও সুপারিশ : তাফসিরে মাজহারিতে বলা হয়েছে, কোনো মুসলমানের অভাব-অনটন দূর করার জন্যে আল্লাহর কাছে দোয়া করাও ভালো সুপারিশের অন্তর্ভুক্ত। এতে দোয়াকারীও সওয়াব পায়। হাদিস শরিফে এসেছে, ‘যখন কেউ মুসলমান ভাইয়ের জন্য নেক দোয়া করে, তখন ফেরেশতা বলেন, আল্লাহতায়ালা তোমারও অভাব দূর করুন।’
সুপারিশ একটি পরামর্শ : রাসূল (সা.) বলেন, ‘যার পরামর্শ নেওয়া হয়, সে একজন আমানতদার।’ (সুনানে আবু দাউদ, হাদিস : ৫১২৮) আমানতদারী ও দিয়ানতদারী রক্ষা করে যা ভালো মনে হয়, তা পরামর্শগ্রহীতাকে জানিয়ে দেওয়া ফরজ। এটা পরামর্শের হক।
সুপারিশ গ্রহণ করা জরুরি নয় : রাসূল (সা.) বলেন, ‘তোমরা আমার কাছে সুপারিশ করো। এটা জরুরি নয় যে, তোমাদের সুপারিশ আমাকে শুনতেই হবে; বরং ফয়সালা তো আল্লাহতায়ালার মর্জি মোতাবেকই করব।’
সুপারিশ হবে ন্যায়ের ভিত্তিতে, ন্যায় কাজে : নবীজি (সা.) বলেন, ‘মোহাম্মদের মেয়ে ফাতেমাও যদি চুরি করে, তাহলে এ ব্যাপারে আমি কারো সুপারিশ গ্রহণ করব না এবং তার হাত কেটে দেব।’ (সহিহ বোখারি)
সুপারিশ না মানলে অসন্তুষ্টি প্রকাশ করা যাবে না : উদার মন-মানসিকতা নিয়ে সুপারিশ করতে হবে। সুপারিশ যদি গৃহীত না হয় তাহলে এ নিয়ে তার রুষ্ট হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। নবীজি (সা.) কতটা উদার মন নিয়ে সুপারিশ করতেন তা বুঝা যায় একটি ঘটনা থেকে। দুই সাহাবি-হজরত মুগীছ (রা.) এবং হজরত বারীরা (রা.)। সম্পর্কে স্বামী-স্ত্রী ছিলেন। বিয়ের সময় হজরত বারীরা (রা.) ছিলেন আরেকজনের দাসী। হজরত বারীরা (রা.)-এর মনিব হয়তো তার অমতেই তাকে বিয়ে দিয়েছিলেন হজরত মুগীরা (রা.)-এর কাছে। বারীরা ছিলেন অত্যন্ত রূপসী। কিন্তু তার স্বামী মুগীছ (রা.)-এর গঠন-আকৃতি সুন্দর ছিল না। এরপরের কথা। উম্মুল মুমিনিন হজরত আয়েশা (রা.) এই দাসীকে কিনে স্বাধীন করে দিলেন। হজরত বারীরা যখন স্বাধীন হয়ে গেলেন, তখন ইসলামী শরিয়তের বিধানানুসারে তার বিয়েটি টিকিয়ে রাখার কিংবা ভেঙ্গে দেয়ার এখতিয়ার লাভ করলেন। এই এখতিয়ারের ভিত্তিতে তিনি তাদের বৈবাহিক সম্পর্ক ভেঙ্গে দেন। হজরত মুগীরা (রা.) অনুনয়-কান্নাকাটি করেও বারীরার মন গলাতে পারেননি। অবশেষে রাসূল (সা.)-কে বললেন, আপনি আমার জন্য সুপারিশ করুন। রাসূল (সা.) হজরত বারীরাকে তার সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার করতে সুপারিশ করলেন-তুমি যদি তাকে আবার গ্রহণ করে নিতে! সে যে তোমার সন্তানের বাবা! সদ্য মুক্তি পাওয়া এই নারী রাসূল (সা.)-কে প্রত্যুত্তরে যা বলেছিলেন তাতেই তিনি ইতিহাস হয়ে থাকতে পারেন। তিনি বলেছিলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আপনি আমাকে এর আদেশ করছেন? (আপনার আদেশ যদি হয় তাহলে আমার জন্য তা শিরোধার্য। আমার মতের সঙ্গে তা মিলুক আর না মিলুক, আমি আপনার আদেশই মেনে নেব। কিন্তু যদি আদেশ না হয় তাহলে ভিন্ন কথা) রাসূল (সা.) বললেন, আমি কেবলই একজন সুপারিশকারী। (অর্থাৎ এটা তোমার প্রতি আমার আদেশ নয়, পরামর্শ ও অনুরোধ) তখন বারীরা (রা.) বললেন, তাই যদি হয়, তাহলে তার কাছে আমার কোনো প্রয়োজন নেই। অর্থাৎ তাকে আবার গ্রহণ করে নেওয়া আমার পক্ষে সম্ভব নয়।’ (সুনানে আবু দাউদ, হাদিস : ২২৩৩) এখানে রাসূল (সা.) তাকে বিষয়টি চাপিয়ে দেননি। তবে এ সুপারিশ প্রত্যাখ্যাত হওয়ার কারণে তিনি অসন্তুষ্টও হননি এটা বিভিন্ন হাদিস দ্বারা প্রমাণিত। আল্লাহতায়ালা আমাদেরকে বৈধ কাজে সুপারিশ করার তাওফিক দান করুন। আমিন।
লেখক :মুফতি নূর মুহাম্মদ রাহমানী
মুহাদ্দিস, জামিয়া আরাবিয়া দারুল উলূম বাগে জান্নাত
৪৩ নবাব সলিমুল্লাহ রোড, চাষাড়া, নারায়ণগঞ্জ সদর, নারায়ণগঞ্জ
ই-মেইল: mmanormuhammad@gmail.com