বিভিন্ন ফুলের সাথে মিল রেখে কামিনী, হাসনাহেনা, গন্ধরাজ-এমন নামকরণ করা হয়েছে ভবনগুলোর।এখানকার চারপাশের পরিবেশটাও নয়নাভিরাম। সমুদ্রদ্বীপ কুতুবদিয়া ও পাশের মহেশখালীতে ১৯৯১ সালে সাগরজলে ভিটেমাটি হারানো জলবায়ু উদ্বাস্তু মানুষদের জীবনে এটা স্বপ্নের চেয়েও বড় কিছু। সব হারিয়ে কক্সবাজারে এসে তারা বেছে নিয়েছিলেন বস্তিজীবন, সেই বস্তি থেকেই বিমানবন্দর সম্প্রসারণের কারণে আবার হয়েছেন উচ্ছেদ। তবে অবাক ব্যাপার হচ্ছে, এবার উচ্ছেদ হয়েও ঠিকানাহারা না হয়ে তারা পেয়ে যাচ্ছেন কল্পনাকেও হার মানানো ঘটনার মতো ফ্ল্যাটের চাবি। আর তাদের এই ফ্ল্যাট উপহার দিচ্ছেন স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তার শুরু আজই।
পর্য টর নগরী কক্সবাজারে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ১০টি বিশেষ অগ্রাধিকার উন্নয়ন প্রকল্পের কাজ চলমান রয়েছে। এর মধ্যে অন্যতম শেখ হাসিনা আশ্রয়ণ প্রকল্প। এ প্রকল্পের প্রথম পর্যায়ে ১৯টি পাঁচতলা ভবনের কাজ সম্পন্ন হয়েছে। সেখানে বিমানবন্দর সম্প্রসারণের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত জলবায়ু উদ্বাস্তু ৬০০ পরিবার পাচ্ছে নতুন ফ্ল্যাট। কক্সবাজার সদরের খুরুশকুল ইউনিয়নের বাঁকখালী নদীর তীর ঘেঁষা বৃহৎ এ প্রকল্পে পর্যায়ক্রমে ৪হাজার ৪৪৮টি পরিবার পাবে নির্মিত ফ্ল্যাট। আজ ২৩ জুলাই ভার্চুয়াল প্ল্যাটফর্মে গণভবন থেকে প্রধানমন্ত্রী এর উদ্বোধন করবেন। উদ্বোধন শেষে উপকারভোগীদের কাছে হস্তান্তর করা হবে ফ্ল্যাটের চাবি।
বিত ১৯৯১ সালে দেশের ইতিহাসের প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসে কক্সবাজারের উপকূলীয় এলাকায় ব্যাপক ধ্বংসলীলা ঘটে। মহেশখালী কুতুবদিয়াসহ উপকূলের বিশাল এলাকা সমুদ্রে বিলীন হয়ে যায়। এতে গৃহহারা হন হাজার হাজার মানুষ। এসব মানুষ জীবনের তাগিদে আশ্রয় নেন কক্সবাজার শহরের বিমানবন্দরের পশ্চিমে বালিয়াড়ী ও ঝাউবাগান এলাকায়। যা পরবর্তীতে কক্সবাজার পৌরসভার ১ নং ওয়ার্ডে রূপান্তরিত হয়। সেখানে বর্তমানে প্রায় ৩০ হাজার মানুষ বসবাস করছে। জলবায়ু উদ্বাস্তু এসব মানুষ ঝুঁকিপূর্ণভাবে সেখানে বসবাস করে আসছিল। এদিকে, বিশ্বমানের পর্যটন শিল্পের বিকাশ ও ভৌগোলিক গুরুত্ব বিবেচনায় কক্সবাজার বিমানবন্দরকে আন্তর্জাতিক মানে উন্নীত করা হচ্ছে। বিমানবন্দর সম্প্রসারণের লক্ষ্যে পৌরসভার ১ নম্বর ওয়ার্ডের কুতুবদিয়া পাড়া, নাজিরাটেক এবং সমিতি পাড়া এলাকার বিপুল পরিমাণ ভূমি অধিগ্রহণ করে সরকার। অধিগ্রহণের আওতায় পড়া জমিতে ৪ হাজার ৪০৯টি পরিবার বাস করতো। ২০১১ সালে ৩ এপ্রিল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কক্সবাজারে এক জনসভায় এসব জলবায়ু উদ্বাস্তু পরিবারের জন্য পুনর্বাসনের নির্দেশনা দেন। তারই পরিপ্রেক্ষিতে ২০১৪-১৫ অর্থবছরে গ্রহণ করা হয় খুরুশকুল আশ্রয়ণ প্রকল্প। যার নাম দেওয়া হয়েছে শেখ হাসিনা আশ্রয়ণ প্রকল্প। সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে প্রথম পর্যায়ে ৫তলা বিশিষ্ট ১৯টি ভবন নির্মাণ সম্পন্ন হয়েছে। এতে ৬০০ পরিবার পাচ্ছে নতুন ফ্ল্যাট। আজ ২৩ জুলাই ভার্চুয়াল প্ল্যাটফর্মে গণভবন থেকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এর উদ্বোধন করবেন। উদ্বোধন শেষে উপকারভোগীদের কাছে হস্তান্তর করা হবে ফ্ল্যাটের চাবি। এসব ফ্ল্যাট পাওয়ার আনন্দে উপকারভোগীরা প্রধানমন্ত্রীর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন।
প্রধানমন্ত্রীর দেওয়া ফ্ল্যাটের সম্ভাব্য তালিকাভুক্ত গ্রহীতা ও শুটকি ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি আতিক উল্লাহ জানান, ‘১৯৯১ সালের ঘূর্ণিঝড়ের পর থেকে আমাদের কোথাও আশ্রয় মেলেনি। এখানে-ওখানে জীবন অতিবাহিত হয়েছে আমাদের। ঘরহারা, বাড়িহারা হয়ে কক্সবাজার শহরে আসা কুতুবদিয়াপাড়ার মানুষ আজ অনেক খুশি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আজ আমাদের স্থায়ী বসবাসের সুযোগ করে দিয়েছেন। এজন্য প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ।’
আরেক উপকারভোগী আবু তাহের কুতুবী জানান, ‘প্রধানমন্ত্রীর এই অবদান ভুলবার মতো নয়। আজ আমরা স্বয়ংসম্পূর্ণ একটি থাকার ঘর পেতে যাচ্ছি। বাস্তুহারা মানুষগুলোর স্বপ্ন বাস্তবায়ন হয়েছে। দীর্ঘদিন পর হলেও একটি স্থায়ী ঠিকানা হওয়ায় আমরা গর্বিত। আমরা প্রধানমন্ত্রীর জন্য দোয়া করছি।’
কক্সবাজার জেলা প্রশাসক মো. কামাল হোসেন বলেন, ‘কক্সবাজার বিমানবন্দর সম্প্রসারণের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত যেসব জলবায়ু উদ্বাস্তু পরিবার আছে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী তাদের জন্য বিশেষ আশ্রয়ণ প্রকল্প খুরুশকুলে করেছেন। ৫ তলা বিশিষ্ট ১৯টি ভবন প্রস্তুত হয়ে গেছে। সেখানে ৬ শত পরিবারকে লটারির মাধ্যমে নির্ধারণ করা হয়েছে। আজ ২৩ জুলাই প্রধানমন্ত্রী এর উদ্বোধন করবেন। ধারাবাহিকভাবে তালিকাভুক্ত ৪ হাজার ৪০৯ জনের সবাই এ ফ্ল্যাট পাবে।’
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আজ কক্সবাজারের খুরুশকুল আশ্রয়ণ প্রকল্পের উদ্বোধন করবেন।
কক্সবাজারের বাঁকখালী নদীর পাশে নয়নাভিরাম জায়গায় এ প্রকল্পটি করা হয়েছে। নানা চ্যালেঞ্জের মুখে এ প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করা হয়েছে। এ প্রকল্প থেকে যথেষ্ট জ্ঞান অর্জন সম্ভব হয়েছে বলে জানান রামু ১০ পদাতিক ডিভিশনের জিওসি মেজর জেনারেল মাঈন উল্লাহ।
তিনি বলেন, ‘নয়নাভিরাম এই এলাকায় গড়ে উঠা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আশ্রয়ণ প্রকল্পের জন্য শুধু মাটি ভরাটের কাজ করতে হয়েছে এক বছর। ভবনগুলো কোন ডিজাইনের হবে, কোথায় কোন ভবন গড়ে উঠবে সব কিছু আমাদের বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ দেখভাল করেছেন। বিশেষ করে এই আশ্রয় প্রকল্পের কাজটি করতে গিয়ে আমাদের প্রচুর জ্ঞান অর্জন হয়েছে। এতে করে দেশের প্রধানমন্ত্রী ও বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রধান যদি আমাদের নির্দেশ দেন বিশ্বের বিভিন্ন জায়গায় এসব ভবন নির্মাণে আর কোনও বেগ পেতে হবে না।’
এ বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের আশ্রয়ন প্রকল্প-২ এর প্রকল্প পরিচালক অতিরিক্ত সচিব মাহবুব হোসেন বলেন, ‘মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ২০১১ সালের ৩ এপ্রিল কক্সবাজারের এক জনসভায় কক্সবাজার বিমানবন্দর সংলগ্ন এলাকায় জলবায়ু উদ্বাস্তু যেসব মানুষ অস্থায়ীভাবে বসবাস করতেন তাদের পুনর্বাসনের নির্দেশনা দেন। তারই পরিপ্রেক্ষিতে ২০১৪-১৫ অর্থ বছরে গ্রহণ করা হয় খুরুশকুল বিশেষ আশ্রয়ণ প্রকল্প। এ প্রকল্পে ৪টি জোন রয়েছে, আবাসিক জোন, পর্যটন জোন, শুটকি মহাল ও বাপার জোন। আবাসিক জোনে ৫ তলা এ বিশিষ্ট ১৩৯টি ভবনে ৪ হাজার ৪০৯ উদ্বাস্তু পরিবারকে পুনর্বাসন করা হবে।’
উল্লেখ্য, দেশে এটিই প্রথম সর্ববৃহৎ এবং সর্বাধিক বাজেটের আশ্রয়ণ প্রকল্প। প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে প্রায় ২৫৩ দশমিক ৩৫০ একর জমি অধিগ্রহণ করা হয়। এ প্রকল্পে ১৩৯টি ৫ তলা ভবন নির্মাণ করা হবে। যার মধ্যে শেখ হাসিনা টাওয়ার নামে একটি ১০ তলা বিশিষ্ট সুউচ্চ ভবনও থাকবে। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে ২০১৭ সালে প্রকল্পটির কাজ শুরু হয়। প্রকল্পের বাকি ভবনগুলোর কাজও এগিয়ে চলছে। এ প্রকল্পে বসবাসকারী পরিবারগুলোর আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের লক্ষ্যে স্কুল, মসজিদ, স্বাস্থ্যসেবার জন্য হাসপাতাল ইত্যাদির ব্যবস্থা থাকবে। বিনোদনের ব্যবস্থাও রাখা হবে। পাশাপাশি প্রকল্প এলাকায় আশ্রয় পাওয়া মৎস্যজীবীদের কর্মসংস্থানের জন্য নানা পরিকল্পনা গ্রহণ করা হচ্ছে।