ধরিত্রী আজ নির্বাক। করোনার কালো থাবায় থমকে আছে গোটা বিশ্ব। সবার জীবনের গতিপথ থেমে থাকলেও ক্যালেন্ডারের পাতা থেকে দিনগুলো হারিয়ে যাচ্ছে নিজ নিয়মে। নিজেদের সুরক্ষিত রাখতে নানা স্বাস্থ্যবিধি মেনে ঘরবন্দী হয়ে অবসর সময় কাটাচ্ছেন শিক্ষার্থীরা। লকডাউন শিথিলের পর খুলেছে সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান। সেই সাথে, সীমিত আকারে কিছু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুললেও শিক্ষাব্যবস্থায় নেই তেমন কোন অগ্রগতি, বন্ধ সব ধরনের ক্লাশ-পরীক্ষা। অনাকাঙ্ক্ষিত এই দীর্ঘ ছুটির মাশুল দিতে হবে হাজার হাজার শিক্ষানবিশদের। শিক্ষাব্যবস্থা সচল রাখতে জ্ঞানী-গুণীরা ভাবছেন ভিন্ন পথ। সেশনজট দূরীকরণে শিক্ষা মঞ্জুরী কমিশন (ইউজিসি) সকল পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়কে অনলাইনে ক্লাস নেয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। কিন্তু এই অনলাইন পদ্ধতি সেশনজট নামক অভিশাপ থেকে মুক্তি দিতে কতটা ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে সে নিয়ে যথেষ্ট উদ্বিগ্ন শিক্ষার্থীরা। আবার, বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন বিনামূলে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের ইন্টারনেটসেবা দেয়ার যে উদ্যোগ গ্রহণ করেছে তা কতটা বাস্তবায়ন করা সম্ভব হবে তা নিয়েও যথেষ্ট সন্দিহান শিক্ষার্থীরা। অনলাইন পদ্ধতিতে শ্রেণীকার্যক্রমের ইতিবাচক ও নেতিবাচক প্রভাব নিয়ে মতামত জানিয়েছেন বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী মাহবুবুর রহমান মাসুম বলেন, সেশনজট কমাতে এবং শিক্ষাজীবনের ধারাবাহিকতা রক্ষার উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে অনলাইন ক্লাস চালুর উদ্যোগ অবশ্যই প্রশংসার দাবি রাখে। যে সংকটের মধ্যে দিয়ে আমরা যাচ্ছি, তার আশু কোনো সমাধানের সম্ভাবনা না থাকায় অনলাইন ক্লাসের গ্রহণযোগ্যতার প্রশ্নটির উত্তর দিচ্ছে, সুযোগ করে দিচ্ছে শিক্ষাক্ষেত্রে আধুনিকায়নের। ইউজিসির নির্দেশনানুযায়ী অনলাইন শ্রেণীকার্যক্রম চালু করা খুবই ভালো সিদ্ধান্ত বলে আমি মনে করছি। তবে ডিভাইস, ডেটা স্পিড, প্রাপ্যতা এবং মূল্যসহ শিক্ষা সংশ্লিষ্ট সমস্যাগুলোকে আইডেন্টিফাই করতে হবে এবং শিক্ষার্থীবান্ধব পদক্ষেপের মাধ্যমে সেগুলোর সমাধান করতে হবে।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী কাজী রাফিদা ফারিহা বলেন, বর্তমানে করোনা পরিস্থিতির ব্যাপারে আমরা সবাই কম-বেশি অবগত।এই অবস্থায় শিক্ষার্থীদের পড়তে হচ্ছে বহুমুখী সমস্যায়। নির্দ্বিধায় বলা যায় আমরা একটা বড় ধরনের সেশনজটের দিকে যাচ্ছি। এই সংকটকালীন সময়ে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো অনলাইনে শিক্ষা কার্যক্রম চালু করেছে এবং পাঠদান কার্যক্রম সুষ্ঠুভাবে পালন করছে। তাদের নিয়মিত পাঠদানের ফলে তারা পড়ালেখায় মনোযোগী হচ্ছে এবং করোনা মহামারী থেকে উত্তোলনের পর নিজেদের সামনের পরীক্ষার জন্য প্রস্তুত করছে। কিন্তু বিভিন্ন সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলাতে এ ব্যাপারে মন্থরগতি লক্ষ করা যাচ্ছে। ফলে খুব স্বাভাবিকভাবে একই সেশনের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা এগিয়ে যাচ্ছে এবং অন্যদিকে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা পিছিয়ে পড়ছে এবং ঘরে বসে বেকার সময় পার করছে। এছাড়াও বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে অনলাইন ক্লাস শুরু হলেও সেখানে শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি খুব একটা আশাজনক নয়। এই দুর্যোগকালীন সময়ে অনেক শিক্ষার্থী অর্থনৈতিক সমস্যায় ভুগছে তারা তাদের সেশন ফি ঠিকমত দিতে পারছে না,অনলাইনে ক্লাস হওয়া সত্ত্বেও বিভিন্ন প্রত্যন্ত অঞ্চলে অবস্থানরত শিক্ষার্থীরা শুধুমাত্র নেটওয়ার্কের অভাবে অনলাইন ক্লাস করতে পারছে না,টাকার স্বল্পতার জন্য এমবি কিনতে পারছে না ।মানুষ যেখানে তিনবেলা ঠিকমতো খেতে পারছে না সেখানে তাদের জন্য অনলাইন ক্লাস করাটা আসলেই বিলাসিতার মতন।ফলে অনলাইন ক্লাস অনেকের জন্য যেমন আশীর্বাদ তেমনি অনেকের জন্য অভিশাপ। যদিও ইউজিসি কর্তৃক শিক্ষার্থীদের বিনামূল্যে ইন্টারনেট সুবিধা দেয়ার আশ্বাস থাকলেও তা কতটা বাস্তবায়িত হবে সেটাই দেখার অপেক্ষায় আছি। তবে,অনলাইন ক্লাস কার্যক্রম অবশ্যই প্রশংসার যোগ্য কেননা এই মাল্টিমিডিয়ার যুগে আমরাও কোনো অংশে পিছিয়ে নেই।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী সামান্তা সাবরিনা সাগুফতা বলেন, বর্তমানে করোনাভাইরাসের কারণে সরকারি নির্দেশনায় সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় শিক্ষা মন্ত্রণালয়সহ ইউজিসি সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে, দেশের সব সরকারি ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে অনলাইনে ক্লাস হবে।বিশ্বায়নের এই যুগে বর্তমান করোনা পরিস্থিতিতে অনলাইনে যে ক্লাস নেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে, তা একটি যুগোপযোগী সিদ্ধান্ত।এ উদ্যোগ যদি কার্যকর করা যায়, তাহলে শিক্ষার্থীদের একরকম বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া লেখাপড়ায় কিছুটা হলেও সংযোগ ঘটবে এবং করোনা পরিস্থিতির জন্য যে সেশন জট আশংকা করা হচ্ছে তা হয়তো রোধ সম্ভব হবে।তবে যাদের জন্য এত আয়োজন, সেই আয়োজনে সবাই অংশগ্রহণ করতে পারবে কি না সে দিকটাও বিবেচনায় রাখা দরকার বলে মনে করি।কারণ আমাদের অনেক শিক্ষার্থী ভাই-বোন আছেন, যাদের প্রযুক্তি সামর্থ নেই। অধিকাংশই গ্রামে যাদের নেটওয়ার্ক পাওয়া নিয়েই অনেক ভোগান্তি পোহাতে হয়। সেখানে ইন্টারনেট সংযোগ দিয়ে অনলাইন ক্লাসে উপস্থিত হওয়াটা একরকম কষ্টসাধ্য। এছাড়া বর্তমানে অনেক পরিবারেই দেখা যাচ্ছে আর্থিক সমস্যা।এসব পরিবারের জন্য এত উচ্চমূল্যের ইন্টারনেট প্যাকেজ কিনে অনলাইন ক্লাসে যোগ দেয়া অসম্ভব।এমন পরিস্থিতে এ উদ্যোগ আশার মুখ দেখবে বলে মনে হয়না।আর যদি কার্যকর করাও হয়, তাহলে একটি বৃহদাংশ বঞ্চিত হবে।
শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী মোঃ মোবাশ্বির কালাম বলেন, করোনার প্রাদুর্ভাব বৃদ্ধির কারণে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা ক্লাস বর্জনের ঘোষনা দেয়। এরপর দেশের সকল বিশ্ববিদ্যালয়ে সাধারণ ছুটি ঘোষণা দেয়ার পর শাবিপ্রবির কিছু ডিপার্টমেন্ট অনলাইন ক্লাস চালু করেছে প্রথম থেকেই। বিশ্ববিদ্যালয় দ্রুততম সময়ে সেমিস্টার শেষ করতে আগ্রহী হওয়ায় অনলাইন ক্লাসের ব্যাবস্থা করে। এতে ইন্টারনেটের অপ্রতুলতার জন্যে সকল শিক্ষার্থীর অংশগ্রহণ ব্যাহত হয়।
বাংলাদেশের আর্থসামাজিক অবস্থায় অনলাইন ক্লাস চাপিয়ে দেয়া কোনভাবেই উপর্যুপরি বলে আমি মনে করিনা। কচ্ছপ গতির ইন্টারনেট ব্যবস্থায় এটি শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের জন্য ভোগান্তি মাত্র। এতে বর্তমানের তৈথবচ শিক্ষাব্যবস্থার মান আরও নিম্নমুখী হবে বলে আমি মনে করি।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী জয়নব আফরোজ বলেন, শিক্ষার্থীরা বেকার বসে আছে। অনলাইন ক্লাশ নিয়ে তাদের শিক্ষাজীবনের এই অচলায়তনের কিছুটা হলেও অবসান ঘটানোর উদ্যোগকে আমি সাধুবাদ জানাচ্ছি প্রথমেই। আমি মনে করি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তাদের সদিচ্ছার জন্যই এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। কিন্তু তাদের কিছু ব্যাপার একটু ভেবে দেখা উচিত। সব শিক্ষার্থীদের কাছে কি কম্পিউটার/ল্যাপটপ /ট্যাবলেট আছে?? আবার সবার কাছে ভালো মানের স্মার্টফোন টিও নেই। ছোট স্ক্রিনের স্মার্টফোন ফেসবুক চালানোর উপযোগী হলেও অনলাইন শ্রেণীকার্যক্রমে অংশ নেয়ার মত উপযোগী ফোন সবার নেই। এক্ষেত্রে প্রশ্ন থেকেই যায় যে অনলাইন ক্লাশ কি শুধুমাত্র উচ্চবিত্ত কিংবা মধ্যবিত্তদের জন্য? তাহলে নিম্নমধ্যবিত্তদের কি হবে? আবার, গ্রামের বেশিরভাগ এরিয়াতেই নেটওয়ার্কের খুব সমস্যা। গাছের মগডালে উঠে ঘন্টাখানেক বসে থাকলে তবেই কিছুটা ভালো নেট পাওয়া যায়, এমন অভিযোগ শুনেছি প্রত্যন্ত অঞ্চলে অবস্থানরত অনেকের কাছ থেকে। যদিও সরকার এখন শিক্ষার্থীদের ফ্রী ইন্টারনেটের সুবিধা দেয়ার কথা জানিয়েছেন। সরকারের এমন চিন্তা ভাবনাকে সাধুবাদ জানাই এবং এটি বাস্তবায়ন হওয়ার অপেক্ষা করছি। তিন মাসের বেশি সময় ধরে সব বন্ধ থাকায় সেশনজটের আশংকায় আছি, সঠিকসময়ে সেমিস্টার শেষ করার জন্য অনলাইন ক্লাশের প্রয়োজনীয়তাকেও অনুভব করছি। আমি প্রযুক্তি কিংবা অনলাইন ক্লাশের বিরোধী নই। তবে সবদিক বিবেচনা করে শিক্ষার্থীবান্ধব ব্যবস্থা নিয়ে তদেরকে সহযোগীতা করার জন্য বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছে অনুরোধ জানাচ্ছি।
নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী বায়েজীদুল ইসলাম মজুমদার বলেন,
বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন অনলাইন ক্লাসের সিদ্ধান্ত অবশ্যই শিক্ষার্থীদের ভালোর কথা ভেবে নিচ্ছে। কিন্তু এই অনলাইন ক্লাসে কতজন শিক্ষার্থীর ভালো হচ্ছে সেদিকটা অবশ্যই খেয়াল রাখা উচিত প্রশাসনের। একটা ক্লাসের ৫০% উপস্থিতি দিয়ে কোন ক্লাস চলতে পারে না। ইন্টারেনেট সংযোগের দুরবস্থা আর আর্থিক অসচ্ছলতার জন্য পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অধিকাংশ শিক্ষার্থী এই অনলাইন ক্লাসের সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। শিক্ষা সবার মৌলিক অধিকার। এভাবে কাউকে মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করাটা সঠিক সিদ্ধান্ত হবে না প্রশাসনের। যদি অনলাইন ক্লাস শুরু করতেই হয় তবে সবার আগে শিক্ষার্থীদের বিনামূল্যে অথবা স্বল্পমূল্যে গতিসম্পূর্ণ ইন্টারনেট সেবার নিশ্চয়তা দেওয়া হোক। শিক্ষার্থীদের বিনামূল্য ইন্টারনেট সেবা দেয়ার গুঞ্জন শুনা গেলেও সেটা এত দ্রুত কার্যকর করা সম্ভব বলে আমার মনে হয়না।
লেখিকাঃ শিক্ষার্থী, নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়।