কুরবানীর পশু কেমন হবে? মুফতী মাহমুদ হাসান
:: প্রকাশ: ২০২০-০৭-২৫ ১০:৫৪:২৩
পশু কুরবানী দেয়ার ক্ষেত্রে শরিয়তের দাবি হলো নিখুঁত ও নির্দিষ্ট গুণ সম্পন্ন পশু হওয়া চাই। তাই আমাদের অবশ্যই জানা থাকতে হবে পশু কোন ধরনের গুণ সম্পন্ন হওয়া বাঞ্ছনীয় । আর এই গুণসম্পন্ন পশুর মধ্যে কোন ধরনের পশু উত্তম।
তাই আসুন জেনে নেই কুরবানীর পশুর মধ্যে কোন ধরনের গুণাবলী পাওয়া যেতে হবে এবং এই গুণাবলীসম্পন্ন পশুর মধ্যে কোনগুলো কুরবানী দেয়া উত্তম।
কুরবানীর পশুটি পাঁচটি গুণসম্পন্ন হতে হবে
প্রথম গুন: কুরবানীর পশুটি গৃহপালিত পোষা প্রাণী হাওয়া
১. মাসআলাঃ
ছয় প্রকার পশু দ্বারা কুরবানী করা যায়ঃ
☑️১৷উট৷☑️২৷ গরু৷☑️৩৷ মহিষ৷☑️৪৷ ছাগল৷☑️৫৷ ভেড়া৷☑️৬৷ দুম্বা৷
এছাড়া অন্য কোন পশু দ্বারা কুরবানী সহীহ হবেনা৷ (ফতোয়ায়ে কাযীখান ৩/৩৪৮ পৃষ্ঠা৷ বাদায়েউস সানায়ে ৪/২০৫ পৃষ্ঠা৷ আল হিদায়া ৪/১৫০ পৃষ্ঠা৷)
২.মাসআলা
নর ও মাদা পশুর কুরবানীসব পশু কুরবানী করা জায়েয সেগুলোর নর-মাদা দুটোই কুরবানী করা যায়।( -কাযীখান ৩/৩৪৮, বাদায়েউস সানায়ে ৪/২০৫)
৩.মাসআলা:
বন্য পশুদিয়ে কুরবানী করার হুমুক: বন্য পশুদিয়ে কুরবানী হয় না। এ কারণে নীলগাই, বনগরু এবং গয়াল নামে আমাদের দেশে যে পশু পাওয়া যায় তার গোশত হালাল হলেও তা দিয়ে কুরবানী করা বৈধ নয়। (বাদায়েউস সানায়ে’ ৫/৬৯)
৪.মাসআলা
হরিণ দ্বারা কুরবানি করা:
হরিণের গোশত হালাল। তবে হরিণ বন্য হওয়ার কারণে তা দিয়ে কুরবানী জায়েয হবে না। এমনকি তা গৃহপালিত হয়ে গেলেও কুরবানী বৈধ নয়। (ফতোয়া আলমগিরী:৫/২৯৭)
দ্বিতীয় গুণ:কুরবানীর পশু অবশ্যই শরীয়ত অনুসারে একটি নির্দিষ্ট বয়সের হতে হবে, ।
৫.মাসআলাঃ
কুরবানীর পশুর বয়স
ছাগল, ভেড়া ও দুম্বার বয়স চন্দ্রমাস হিসেবে কমপক্ষে পূর্ন এক বছর হতে হবে। তবে ছয় মাসের ভেড়া ও দুম্বা যদি মোটা-তাজায় দেখতে এক বছরের মতই দেখা যায়, তাহলে কুরবানী সহীহ হবে। তবে ছাগলের বয়স এক বছরের কম হলে কুরবানী সহীহ হবেনা৷
(সুনানে আবু দাউদ ২৭৯৯ হাদীস৷ সুনানে ইবনে মাজাহ ৩১৩৯ হাদীস৷ ফতোয়ায়ে কাযীখান ৩/৩৪৮ পৃষ্ঠা৷)
৬.মাসআলাঃ
গরু ও মহিষের বয়স চন্দ্রমাস হিসাবে কমপক্ষে দুই বছর হতে হবে। এর কম হলে কুরবানী সহীহ হবেনা।(সুনানে নাসায়ী ৪৩৭৮ হাদীস৷ বাদায়েউস সানায়ে ৪/২০৫ পৃষ্ঠা৷)
৭.মাসআলাঃ
উটের বয়স চন্দ্রমাস হিসাবে কমপক্ষে পাঁচ বছর হতে হবে। এর কম হলে কুরবানী সহীহ হবেনা৷ (ইলাউস সুনান ৭/২৪৫ পৃষ্ঠা৷
ফতোয়ায়ে কাযীখান ৩/৩৪৮ পৃষ্ঠা৷)
৮.মাসআলাঃ
বিক্রেতা যদি পশুর বয়স পূর্ন হয়েছে বলে সাক্ষ্য দেয় এবং পশুর শারীরীক গঠন দেখেও যদি তেমনই মনে হয়, তবে বিক্রেতার কথার উপর আস্থা রেখে সে পশু ক্রয় করা এবং তা দ্বারা কুরবানী করা সহীহ হবে। (ফতোয়ায়ে শামী ৫/২২৫ পৃষ্ঠা৷)
তৃতীয় গুন:কোরবানির পশুটি সকল প্রকার ত্রুটি থেকে মুক্ত হওয়া।
৯.মাসআলা: বিশেষ করে, অন্ধ, কানা ও ল্যাংড়া জন্তু বা এমন রুগ্ন ও দুর্বল জন্তু কুরবানীর স্থান পর্যন্ত যার হেঁটে যাওয়ার শক্তি নেই, অনুরূপভাবে এক তৃতীয়াংশের চেয়ে বেশী লেজ ও কান কাটা কিংবা লেজ ও কান বিহীন পশুর কুরবানী সহীহ হবে না। এবং অধিকাংশ দাঁত পড়ে যাওয়া পশু দ্বারাও কুরবানী সহীহ হবে না। (শামী:৬/৩২৩, আল বাহরুর রায়িক:৮/৩২৪ .কাজী খান কাজীখান ৩/৩৫২.বাদায়েউস সানায়ে ৫/৭৫)
চতুর্থ গুণ:কুরবানীর পশুর মালিক হওয়া, নিয়ম অনুযায়ী মালিকের থেকে অনুমোদন পাওয়া।অন্যের পশু দ্বারা কুরবানী আদায় হবে না।
পঞ্চম গুণ:কুরবানির পশুটি অন্য কারও সাথে মালিকানায় সম্পৃক্ত না হওয়া যেমন বন্ধকি পশু।
কুরবানীর জন্য কোন ধরনের পশু উত্তম?
এ ব্যাপারে সূত্র হলো, দুটি পশুর মধ্যে যার মূল্য বেশি সেটি উত্তম। যদি উভয়ের মূল্য সমান হয়, তাহলে যার গোশত বেশি সেটি উত্তম আর যদি উভয়ের গোশত ও মূল্য সমান হয়, তাহলে উভয়ের মধ্যে যার গোশত বেশি সুস্বাদু তা দিয়ে কুরবানী করা উত্তম।
☑️ _যদি গোশত আর মূল্য সমান না হয়, তাহলে যার মধ্যে (মূল্য,গোশত، স্বাদ) কোন এক দিক থেকে বেশি হবে তা দিয়ে কুরবানী করা উত্তম। সুতরাং যদি বকরি ওব বড় পশুর এক শপ্তমাংশ উভয়ের মূল্য গোশত সমান হয়, তাহলে বকরি দিয়ে কুরবানী করা উত্তম। কেননা বকরির গোশত সুস্বাদু। আর যদি বড় পশুর এক শপ্তমাংশের গোশত বিক্রির তুলনায় বেশি হয় তাহলে এক শতাংশ উত্তম। ছোট পশু( ছাগল ,ভেড়া )দিয়ে কুরবানী করা হতে একটি বড় পশু দিয়ে কুরবানী করা উত্তম, কেননা বড় পশুর গোশত ও মূল্য বেশি।
☑️_গরু-মহিষের তুলনায় উট দিয়ে কুরবানী করা উত্তম, কেননা উট বড় ও দামী। তবে যদি কোন এলাকায় একটি বকরি ও উটের মূল্য সমান বা বকরির মূল্য বেশি হয় তাহলে বকরি দিয়ে কোরবানি করা উত্তম ।কেননা বকরির গোশত সুস্বাদু।
☑️_নর ও মাদী পশুর গোশত ও মূল্য সমান হলে মাদী পশু দিয়ে কুরবানী করা উত্তম। কেননা মাদীর গোস্ত বেশি সুস্বাদ
☑️_এমনিভাবে ছাগল ও ভেড়ার মধ্যে খাসি দিয়ে কোরবানি করা উত্তম ,কেননা তার গোশত সুস্বাদু। আর নবী সাল্লাল্লাহু ওয়া সাল্লাম খাসি দিয়ে কোরবানি করেছে
☑️ছয়টি বকরি ও একটি গরুর মূল্য সমান হলে গরু দিয়ে কুরবানী করা উত্তম, তবে সাতটি বকরি একটি গরু হতে উত্তম।
☑️ভেড়া ও ভেড়ীর মূল্য সমান হলে ভেড়া উত্তম ,তবে যদি ভেড়ীর মূল্য বা গোশত বেশি হয় তাহলে ভেড়ী উত্তম ।এমনিভাবে নর ছাগল ও মাদী ছাগলের মূল্য সমান হলে মাদী ছাগল উত্তম।(ফাতাওয়ায়ে শামী ৯/৪৬৬,৪৮২, মুহিতে বোরহানি ৫/৬৬৯.)
في الدر الشاة افضل من سبع البقره اذا استويا في القيمة واللحم،والكبش أفضل النعجة إذا استويا فيهما،الانثي من اامعز أفضل من النبي إذا استويا قيمة والانثي من الابل البقر افضل ….الخ.
☑️_ একই মূল্যে একটি পশু আবার দুটি পশু পাওয়া গেলে ,দেখতে হবে বয়স এবং আকৃতিতে ভালো হলে দুটি ক্রয় করা উত্তম, যেমন ১০হাজার টাকায় একটি বড় ছাগল পাওয়া যায় আবার সে মধ্যে দুটি ছাগল পাওয়া যায়। তাহলে দুটি উত্তম হবে যদি বয়স সঠিক হয়। (ফাতাওয়ায়ে হিন্দিয়াহ ২/২৪২. মুহীতে বোরহানী ৫/৬৬৯)
اشتري الاضحية بثلاثين درهما الشاتان أفضل من واحدة بخلاف ما إذا اشتري بعشرين حيث كانت الواحد أفضل لأنه يوجد بثلاثين درهما شاتان علي ما يجب من اكمال……الخ. الدر
কুরবানীর পশু মোটাতাজা হওয়া:
কোরবানির পশু মোটা তাজা সুন্দর ও শিংযুক্ত হওয়া উত্তম।বর্ণিত আছে ,
عن ابي الأسود الانصاري،عن الله عن جده،عن النبي صلي الله عليه وسلم إن أحب الضحايا الي الله اغلاهاواسمنها
নবী সা এরশাদ করেন, কুরবানীর পশু বেশি মূল্যবান ও মোটাতাজা হওয়া আল্লাহ তাআলার নিকট সর্বাধিক পছন্দনীয়। (বাইহাকী শরীফ ১৮৭৩. মুসনাদে আহমদ ১৫৫৩৩)
ইয়াহইয়া বিন সাঈদ থেকে বর্ণিত,
قال يحب بن سعيد سمعت ابا امامة بن سهل قال كنا لنسمن الاضحية بالمدينة وكان المسلمون بسمنون
অর্থ: আবু উমামা রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু বলেন আমরা মদিনায় কোরবানির পশুকে মোটাতাজা করতাম আর মুসলমানগনও তাদের পশুকে মোটাতাজা করত। বুখারী শরীফ
কোরবানির পশু মোটাতাজা হওয়ার উপায় হল, কোরবানির সময় আসার কিছুদিন পূর্বে ক্রয় করে ভালোভাবে যত্ন এবং খাওয়া-দাওয়া করাবে। এতে অল্প মূল্যের পশু ক্রয় করলেও মোটাতাজা দিয়ে কুরবানী করার সওয়াব পাওয়া যাবে। আর দীর্ঘদিন নিজের লালন-পালনে থাকলে পশুর প্রতি মায়া আসবে। এতে প্রিয় বস্তু কোরবানি করার সওয়াবও পাওয়া যাবে ।যেমন আল্লাহ তা’আলা ইরশাদ করেন
لن تنالوا البر حتي تنفقوا مماتحبون وما تنفقوا من شيء فان الله به عليم .العملات ٩٢
অর্থাৎ )হে মুসলিমগণ( তোমরা কখনোও পুর্ণ সাওয়াব পাবে না, যে পর্যন্ত না নিজের (অতিশয়) প্রিয় বস্তু (আল্লাহর রাস্তায়) ব্যয় না করবে। আর যা কিছু (সাধারন ভাবে) ব্যয় করবে তাও আল্লাহ খুব জানেন। সূরা আল ইমরান আয়াত 92
একটি ভ্রান্তি নিরসন:
কিছু লোকের ধারণা, কুরবানীর পশু কোরবানির দিন সমূহের পূর্বে ক্রয় করা ঠিক নয়, কেননা কোরবানির দিনের পূর্বে কিনলে তা মান্নাতের কোরবানিতে পরিণত হয়। এর দরুন মালদারের জন্য দুটি কুরবানী ওয়াজিব হয়। একটি কোরবানির দিনের পূর্বে কেনার দরুন আরেকটি মালদারের ওয়াজিব কোরবানি ।
এ ধারণাটি একেবারেই ভুল। এ মাসয়ালা গরিবের জন্য। অর্থাৎ গরীব ব্যক্তি কুরবানীর নিয়তে পশু ক্রয় পরলে তার উপর কুরবানী ওয়াজিব হয়। যদিওবা কোরবানির দিনের পূর্বে ক্রয় করে।
কিন্তু মালদার ব্যক্তি পূর্বে কেনার দ্বারা দুটি ওয়াজিব হয় না।
আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে ত্রুটিমুক্ত নিখুঁত পশু আল্লাহর জন্য কোরবানি করার তাওফিক দিক। আমীন।
মুফতী মাহমুদ হাসান।
*দারুল হাদীস (এম.এ,ইসলামিক স্টাডিস)
জামিয়াতুল আবরার বসুন্ধরা ঢাকা।
*আরবি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগ(অনার্স) ঢাকা।
*দারুল ইফতা (ইসলামিক আইন ও গবেষণা বিভাগ) ঢাকা।