ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জে আধুনিক বিদ্যুৎ ব্যবস্থা গড়ে তুলতে প্রায় দেড় হাজার কোটি টাকার প্রকল্প হাতে নিতে যাচ্ছে বিদ্যুৎ বিভাগ। প্রকল্পের আওতায় নতুন সাবস্টেশন স্থাপন ও পুরনো সাবস্টেশনের সংস্কারসহ স্মার্ট গ্রিড স্থাপন করা হবে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এতে করে বিদ্যুৎ বিতরণের ‘টেকনিক্যাল লস’ কমে আসবে।
‘ডিপিডিসির আওতাধীন এলাকায় উপকেন্দ্র নির্মাণ ও পুর্নবাসন, বিদ্যুৎ ব্যবস্থায় ক্যাপাসিটি ব্যাংক স্থাপন এবং স্মার্ট গ্রিড ব্যবস্থার প্রবর্তন’ শীর্ষক প্রকল্পটির খরচ ধরা হয়েছে ১ হাজার ৪৫৪ কোটি ৪ লাখ টাকা।
এর মধ্যে সরকারের নিজস্ব তহবিল থেকে ৩৬৯ কোটি দুই লাখ টাকা ও বাস্তবায়নকারী সংস্থা ঢাকা পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেডের (ডিপিডিসি) তহবিল থেকে ৮২ কোটি ৬০ লাখ টাকা খরচ করা হবে। বাকি এক হাজার দুই কোটি টাকা আসবে ফ্রান্স ডেভেলপমেন্ট এজেন্সির (এএফডি) ঋণ ও ইউরোপীয়ান ইউনিয়নের (ইইউ) অনুদান থেকে।
পরিকল্পনা কমিশন সূত্রে জানা গেছে, এরই মধ্যে প্রকল্পটি প্রস্তাব করা হয়েছে পরিকল্পনা কমিশন। জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) আগামী বৈঠকে প্রকল্পটি উপস্থাপন করা হতে পারে। অনুমোদন পেলে চলতি আগস্ট থেকেই ২০২৩ সালের জুনের মধ্যে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করা হবে।
পরিকল্পনা কমিশনের একাধিক কর্মকর্তা বলেন, বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয় থেকে প্রস্তাব পাওয়ার পর গত ৯ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত হয় প্রকল্প মূল্যায়ন কমিটির (পিইসি) সভা। ওই সভায় জানানো হয়, প্রকল্পটি বাস্তবায়নের মাধ্যমে ছয়টি নতুন সাবস্টেশন নির্মাণ করা হবে। এছাড়া তিনটি সাবস্টেশনের সংস্কার ও ক্ষমতা বাড়ানো হবে। আর স্মার্ট গ্রিড বসানো হবে। এতে টেকনিক্যাল লস কমবে। প্রকল্পের আওতায় নতুন করে ১ লাখ ১৫ হাজার গ্রাহককে বিদ্যুৎ সংযোগ দেওয়াও সম্ভব হবে। সদ্য সমাপ্ত সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার উদ্দেশ্য ও লক্ষ্যের সঙ্গে প্রকল্পটি সামঞ্জস্যপূর্ণ। কেননা ডিপিডিসির আওতায় ৬০টি সাবস্টেশন, চার লাখ ২৬ হাজার নতুন গ্রাহক সংযোগ এবং সিস্টেম লস ৯ শতাংশে নামিয়ে আনার লক্ষ্য ছিল। প্রকল্পটি ওই লক্ষ্যগুলো পূরণে সহায়ক হবে।
বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, ডিপিডিসি এলাকায় বিদ্যুদের চাহিদা বাড়ছে। ফলে বিদ্যমান সিস্টেমের ওপর বাড়তি চাপ তৈরি হচ্ছে। এর ধারাবাহিকতায় ২০২১ ও ২০২৫ সালে ওইসব এলাকায় বিদ্যুতের সম্ভাব্যতা চাহিদার পরিমাণ দাঁড়াবে যথাক্রমে প্রায় ২ হাজার ২৪৪ ও ৩ হাজার ২৮৫ মেগাওয়াট। এ প্রেক্ষাপটে ডিপিডিসি এলাকায় নিরাপদ ও নিরবচ্ছিন্ন উপায়ে বিদ্যুৎ সরবরাহের জন্য নতুন ১৩২/৩৩ কেভি ও ৩৩/১১ কেভি সাবস্টেশন নির্মাণসহ বিদ্যমান ৩৩/১১ কেভি সাবস্টেশনগুলোর সংস্কার প্রয়োজন।
বিদ্যুৎ বিভাগ বলছে, ডিপিডিসি’র বর্তমান সিস্টেম ক্যাপাসিটি ৩ হাজার ১০ এমভিএ। ট্যারিফ পয়েন্টে ডিপিডিসির গড় পাওয়ার ফ্যাক্টর ১৩২ কেভি লেভেলে শূন্য দশমিক ৮৫, ৩৩ কেভি লেভেলে শূন্য দশমিক ৮৮ ও ১১ কেভি লেভেলে শূন্য দশমিক ৯০।
বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের রেগুলেশনে বলা হয়েছে— প্রত্যেক ট্যারিফ পয়েন্টে ১৩২ কেভি ও ৩৩ কেভি লেভেলে শূন্য দশমিক ৯০ পাওয়ার ফ্যাক্টর রাখতে হবে। বর্তমান পাওয়ার স্টেশনগুলোর বর্তমান কোনো ভোল্টেজ লেভেলে পাওয়ার ফ্যাক্টর ইমপ্রুভমেন্ট ডিভাইস নেই। ফলে ডিপিডিসি প্রতিমাসে পিডিবিকে বড় অঙ্কের অর্থ পাওয়ার ফ্যাক্টর কারেকশন চার্জ হিসেবে পরিশোধ করে। প্রকল্পটি বাস্তবায়নের মাধ্যমে পাওয়ার ফ্যাক্টর শূন্য দশমিক ৯০-এ উন্নীত করা হবে।
প্রকল্পের প্রস্তাবনায় বলা হয়েছে, প্রকল্পটির আওতায় ডিপিডিসির অধীন রাজধানীর ঝিগাতলা, লালমাটিয়া, আসাদগেট, সাত মসজিদ রোড ও গ্রিন রোডের মোট পাঁচটি ৩৩/১১ কেভি সাবস্টেশনে পাইলটিং বেসিসে স্মার্ট গ্রিড সিস্টেম চালু করা হবে। এ ব্যবস্থার মাধ্যমে সাবস্টেশন ও ফিডার লেভেলের ত্রুটি চিহ্নিত করা, আইসোলেশন অ্যান্ড সার্ভিস রেস্টোরেশন এবং অপটিক্যাল নেটওয়ার্ক রিকনফিগাশেন স্বয়ংক্রিয়ভাবে জানার সুযোগ তৈরি হবে। পাশাপাশি গ্রিড ব্যবস্থায় অটোমেটিক সার্কিট রিক্লোজার, রিং মেইন ইউনিট, অপটিক্যাল ফাইবার, লোড সুইচ, ডিজিটাল ইত্যাদি স্থাপনের মাধ্যমে ফিডার অটোমেশনের ব্যবস্থা করা হবে। ফলে মিটার রিডিংসহ অনলাইনে ট্রান্সফরমারের কার্যক্রম মনিটর করা সম্ভব হবে। এ সংক্রান্ত রক্ষণাবেক্ষণ ব্যয় ও টেকনিক্যাল লস উল্লেখযোগ্য হারে কমবে।
পরিকল্পনা কমিশনের মতামত দিতে গিয়ে কমিশনের শিল্প ও শক্তি বিভাগের সদস্য (সচিব) প্রদীপ রঞ্জন চক্রবর্তী একনেকের জন্য তৈরি প্রকল্প-সারসংক্ষেপে বলেন, প্রকল্পটি সফলভাবে বাস্তবায়ন করা হলে ডিপিডিসির আওতাধীন বিদ্যুৎ গ্রাহকরা আরও মানসম্মত ও নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সুবিধা ভোগ করতে পারবেন। কেননা এর মাধ্যমে পাওয়ার ফ্যাক্টরের উন্নয়ন সাধন এবং বিদ্যুতের সরবরাহ ও চাহিদার মধ্যে ভারসাম্য বজায় রাখা সম্ভব হবে।
প্রকল্পর আওতায় প্রধান কার্যক্রমগুলোর মধ্যে শিমরাইলের মোহাম্মদি স্টিল ও শ্যামপুরে দু’টি ১৩২/৩৩ কোভি গ্রিড সাবস্টেশন নির্মাণ করা হবে।
এছাড়া কামরাঙ্গীরচর, কল্যাণপুর, লালবাগ ও মাদারটেকে চারটি ৩৩/১১ কেভি সাবস্টেশন স্থাপন করা হবে। বিদ্যমান উপকেন্দ্রগুলোতে ক্যাপাসিটি ব্যাংক স্থাপনের মাধ্যমে ১৩২ কেভি, ৩৩ কেভি ও ১১ কেভি ভোল্টেজ লেভেলে পাওয়ার ফ্যাক্টরের উন্নয়ন করা হবে। ডেমরা, তালতলা ও কুমারটুলিতে তিনটি ৩৩/১১ কেভি সাবস্টেশনের সংস্কার করা হবে। কামরাঙ্গীরচর, লালমাটিয়া, গ্রিন রোড, খানপুর ও খিলগাঁও— এই পাঁচটি সাবস্টেশনে এআইএস ব্রেকারের পরিবর্তে জিআইএস ব্রেকার স্থাপন করা হবে।
এছাড়া ঝিগাতলা, লালমাটিয়া, আসাদ গেট, সাত মসজিদ রোড ও গ্রিন রোডে পাইলটিং ভিত্তিতে পাঁচটি ৩৩/১১ কেভি সাবস্টেশনে স্মার্ট গ্রিড সিস্টেম চালু করা হবে। ছয়টি সাবস্টেশনে ভবন নির্মাণ এবং ১১টি যানবাহন কেনাও হবে এই প্রকল্পের আওতায়।
সানবিডি/আরএম/