বৈশ্বিক প্রতিযোগিতামূলক বাজারে পণ্যের দাম কমাতে সবসময়ই তত্পর থাকেন পোশাক খাতের পশ্চিমা ক্রেতারা। কভিড-১৯ পরিস্থিতিতেও নিত্যনতুন কৌশল নিয়ে হাজির হয়েছেন তারা। এসব কৌশলের মধ্যে রয়েছে ক্রয়াদেশগুলোর আওতায় থাকা পণ্য বিবরণে সংশোধন আনা ও সরবরাহ সময় পিছিয়ে দেয়া।
চলতি বছরের মার্চে দেশে প্রাণঘাতি রোগী শনাক্তের পর একের পর এক ক্রয়াদেশ বাতিল করতে থাকেন ক্রেতারা। ক্রয়াদেশ বাতিল ও স্থগিতের এ ধারা এপ্রিলের শেষ পর্যন্ত অব্যাহত ছিল। তবে জুনে আবার ক্রয়াদেশ ফিরতে শুরু করে।
খাতসংশ্লিষ্টরা বলছেন, ফিরিয়ে দেয়া ক্রয়াদেশগুলোতে থাকা পোশাক পণ্যের বিবরণ (স্পেসিফিকেশন), ডিজাইনসহ নানারকম সংশোধন আনছেন ক্রেতারা। মূলত পণ্যের মূল্য কমানোর কৌশল হিসেবে এসব সংশোধন আনছেন তারা।
পোশাক খাতসংশ্লিষ্ট সংগঠন প্রতিনিধিদের দাবি, ক্রেতারা এখন প্রায়ই পণ্যে নতুন কাজ সংযোজনসহ নানারকম পরিবর্তন আনছেন, যদিও অতিরিক্ত কাজের জন্য অতিরিক্ত মূল্য পরিশোধ করছেন না। বরাবরই ক্রেতারা ন্যূনতম মজুরি নিশ্চিত করাসহ সোস্যাল কমপ্লায়েন্সের নানা দিক পরীক্ষা করছেন। কিন্তু এগুলো নিশ্চিত করার জন্য পণ্যে বাড়তি মূল্য প্রস্তাব করছেন না।
বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের প্রথম সহসভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, বাংলাদেশের পোশাক সরবরাহকারীরা মারাত্মকভাবে মূল্য কমানোর চাপে আছেন। ক্রেতারা সুবিধা নেয়ার নানারকম প্রচেষ্টা চালাচ্ছেন। তারা পণ্য নকশার স্পেসিফিকেশনে পরিবর্তন আনছেন এফওবি মূল্য চূড়ান্ত হওয়ার পর।
পোশাক খাতসংশ্লিষ্টদের অভিযোগকে সমর্থন করে আন্তর্জাতিক একটি প্রতিবেদনও। ‘কস্ট অ্যান্ড কস্ট নেগোসিয়েশন অ্যান্ড দ্য নিড ফর নিউ প্র্যাকটিস’ শীর্ষক বিশেষ ওই প্রতিবদনটি গত ৩০ জুলাই প্রকাশ করে আন্তর্জাতিক অলাভজনক সংস্থা বেটার বায়িং ইনস্টিটিউট।
প্রতিবেদনে বলা হয়, পোশাক প্রস্তুতকারকরা কভিড-১৯ মহামারীর প্রভাবে নতুন চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করছেন, যার মধ্যে অন্যতম একটি হচ্ছে পণ্যের মূল্য পরিবর্তন। মূল্য চূড়ান্ত হওয়ার পরও ক্রয়াদেশে কৌশলে পরিবর্তন আনছেন ক্রেতারা। পোশাক সরবরাহকারীদের মতামতের ভিত্তিতে তৈরি করা ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ক্রেতাদের দেয়া কৌশলগত চাপের প্রভাবে ব্যবসা ও মুনাফা হুমকির মুখে রয়েছে। এতে কারখানার সামাজিক ও পরিবেশগত বিষয়গুলোকে টেকসই করারও হুমকির মধ্যে পড়ছে।
কভিড-১৯-এর প্রভাবে ব্যবসার পরিবর্তিত চর্চা শনাক্ত করার লক্ষ্যে প্রতিবেদনটি করেছে বেটার বায়িং। বাংলাদেশ, চীন, হংকং, ভারত ও পাকিস্তানসহ ৩০টি দেশের মোট ১৪৭ সরবরাহকারীর ওপর চালানো জরিপের ফলাফল প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ক্রেতারা কস্ট নেগোসিয়েশনের বাইরে গিয়ে কম মূল্য নিশ্চিত করা এবং সরবরাহকারীদের সমাধান সৃষ্টিতে পরিকল্পনা, পূর্বাভাস, নকশা ও উন্নয়নসহ অন্যান্য ব্যবসায়িক চর্চার ব্যবহার শুরু করেছেন। তাদের ব্যবহূত চর্চার মধ্যে বেশি ব্যবহার হচ্ছে গ্রহণ করুন বা ত্যাগ করুন। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বেশির ভাগ সরবরাহকারী জানিয়েছেন তাদের ক্রেতাদের ৯২ দশমিক ৫ শতাংশই নতুন ক্রয়াদেশ দিতে শুরু করেছেন।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ক্রয়াদেশে পণ্যের পরিমাণ আগের তুলনায় কমেছে। সরবরাহকারীরা পণ্যের মূল্য কমাতে ক্রেতাদের নতুন পদ্ধতির বিষয়ে উল্লেখ করেছেন। দীর্ঘমেয়াদের ক্রয় পরিকল্পনাসহ ব্যয় কমাতে পণ্যের নকশা পরিবর্তনের বিষয়েও জরিপের মাধ্যমে জানিয়েছেন সরবরাহকারীরা।
প্রসঙ্গত, চীনের উহানে কভিড-১৯-এর প্রাদুর্ভাব দেখা দেয় গত ডিসেম্বরের শেষে। ফেব্রুয়ারি থেকে মার্চের মধ্যে তা বিশ্বের অধিকাংশ দেশে ছড়িয়ে পড়ে। এ প্রেক্ষাপটে জানুয়ারি থেকেই দেশের তৈরি পোশাক রফতানিতে নিম্নমুখিতা বজায় রয়েছে। করোনার প্রভাবে দেশের তৈরি পোশাক খাত প্রথমে কাঁচামালের সরবরাহ সংকটে পড়ে। চীনে নভেল করোনাভাইরাসের ব্যাপক সংক্রমণের কারণে দেশটি থেকে কাঁচামাল আমদানি ব্যাহত হয়।
দেশে তৈরি পোশাক খাতের ওভেন পণ্যের আনুমানিক ৬০ শতাংশ কাপড় আমদানি হয় চীন থেকে। আর নিট পণ্যের কাঁচামাল আমদানি হয় ১৫-২০ শতাংশ। গত বছরের ডিসেম্বরে চীনের নভেল করোনাভাইরাসের প্রকোপ দেখা দিলে প্রথম ধাক্কাটি আসে শিল্পের কাঁচামাল আমদানিতে। পরবর্তী সময়ে ধীরগতিতে হলেও কাঁচামাল সরবরাহ পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে শুরু করে। এরপর রফতানি তৈরি পোশাকের প্রধান রফতানি গন্তব্য ইউরোপ ও আমেরিকায় করোনার প্রাদুর্ভাব ছড়িয়ে পড়লে সেখানে চাহিদার সংকট তৈরি হয়। এরই ধারাবাহিকতায় ক্রয়াদেশ বাতিল-স্থগিত করতে থাকে একের পর এক ক্রেতাপ্রতিষ্ঠান।
ওই সময় ক্রয়াদেশ বাতিল-স্থগিত করা ক্রেতাদের মধ্যে প্রাইমার্কের মতো বড় ক্রেতাপ্রতিষ্ঠানও আছে। বৈশ্বিক লকডাউন পরিস্থিতিতে পরিবর্তনের কারণে নতুন ক্রয়াদেশও আসতে শুরু করেছে পোশাক কারখানাগুলোতে। কারখানা মালিকরা বলছেন, বাতিল বা স্থগিত হওয়া ক্রয়াদেশগুলোর কিছু ফিরে এসেছে। আবার নতুন ক্রয়াদেশও পেতে শুরু করেছে কারখানাগুলো। কিন্তু তা স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে অনেক কম।