আইন প্রণয়নের প্রাম্ভকালীন হতেই আইন পরিবর্তন ও পরিমার্জন একটি স্বাভাবিক ও সুপ্রচলিত নিয়মতান্ত্রিক প্রক্রিয়া। ব্রিটিশরা এই উপমহাদেশ শাসনকালে তাদের নিজ স্বার্থে ও শাসনকার্য পরিচালনা সুবিধার্তে বিভিন্ন আইন প্রণয়ন করেন এবং ব্রিটিশ শাসন অপসারনের পর বাংলাদেশের পাশাপাশি অন্যান্য দেশগুলো সময়ে সময়ে সমাজের মান এবং যুগানুসারে পুরাতন আইন সংশোধন ও পরিমার্জন করেন। বহুকাল হতে ব্যাংক-কোম্পানি আইন ১৯৯১ এর সংশোধনের জন্য তুবুল সমালোচনা ও দাবি তোলা হলেও সম্প্রতি ব্যাংক-কোম্পানি আইন এর সংশোধনীতে কিছু কার্যকর পরিবর্তন এর প্রস্তাবনা দেখা গিয়েছে।
ব্যাংক কোম্পানি আইন ১৯৯১-এ সাম্প্রতিক প্রস্তাবিত সংশোধনীগুলি “স্বেচ্ছাকৃত খেলাপী ঋণ গ্রহীতা” বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণের উদ্দেশ্যে করা হয়েছে। এই নতুন সংশোধনীগুলির কারণে, ইচ্ছাকৃত খেলাপিরা বিদেশ ভ্রমণ, শেয়ার ক্রয়, তার পরিচালক পদটি ব্যবহার সহ সকল ধরণের প্রত্যাশিত সুবিধা ভোগে কিছুটা বাধানিষেধের সম্মুখিন হবে।
প্রস্তাবিত সংশোধনীতে কিছু সংজ্ঞাকে বিস্তৃত অর্থ দেওয়া হয়েছে উদাহরণস্বরূপ, পরিবারের সংজ্ঞায় স্বামী-স্ত্রী, সন্তান, পিতা-মাতা, ভাইবোন এর পাশাপাশি শ্বশুর, শাশুড়ী, নাতি-নাতনী, পুত্রবধূ, কন্যার জামাতা এবং অন্যান্য নির্ভরশীলদেরও অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। অধিকন্তু, "ব্যক্তি" অর্থ উভয় “প্রাকৃতিক ব্যক্তি” এবং “কৃত্রিম আইনী” সত্তাকে বোঝানো হয়েছে। নতুন প্রস্তাবনার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তনগুলির মধ্যে অন্যতম হল “স্বেচ্ছাকৃত খেলাপী ঋণ গ্রহীতা” সম্পর্কীয় আইনের অন্তর্ভুক্তি। ইহার পূর্বে, শুধুমাত্র আইনের অভাবে স্বেচ্ছাকৃত খেলাপী ঋণ গ্রহী ব্যক্তিকে দায়বদ্ধ করা সম্ভব হত না। ব্যাংক আইনের নতুন সংশোধনী কার্যকর হলে “স্বেচ্ছাকৃত খেলাপী ঋণ গ্রহীতা” এর বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ সম্ভব হবে।
অধিকন্তু, আন্তর্জাতিক মানের চর্চা এবং নীতি অনুশীলন বজায় রাখার লক্ষ্যে ঋণ, অর্থ পাচার বা মানি লন্ডারিং, ট্রাষ্টির দায়িত্ব, সন্ত্রাসী অর্থায়ন এবং আর্থিক অপরাধের সংজ্ঞার কিছু গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন সাধন করা হয়েছে। যেহেতু অধিগ্রহণের তারিখ মিউটেশনের অন্তর্ভুক্ত সম্পত্তি বিক্রয় করার অধিকারের পূর্বশর্ত, নতুন ব্যাংক-কোম্পানি আইনে অধিগ্রহণের তারিখের ব্যাখ্যা এবং দখল ও মিউটেশন সম্পর্কীয় কিছু নতুন বিধান সংযুক্ত করার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।
নতুন সংশোধনীতে ব্যাংক-কোম্পানির পরিচালনা এবং পরিচালনা কর্মচারী সম্পর্কিত কিছু পরিবর্তন প্রস্তাবিত হয়েছে। কোনো চেয়ারম্যান, পরিচালক, ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি), প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) বা দুই স্তর অধঃস্তন কর্মকর্তা অর্থ, দুর্নীতি, বা জালিয়াতি সম্পর্কিত দোষে সাব্যস্ত হলে সেই ব্যক্তি প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে ব্যাংক-কোম্পানির পরিচালনা ও প্রশাসনের কোনো কার্যকলাপে অংশ নিতে পারবে না। তদ্ব্যতীত, সেই ব্যক্তি অন্য কোনো ব্যাংক-কোম্পানিতে নিয়োগ প্রাপ্ত হবার যোগ্যতাও হারাবে। কোনো পরিচালকের বিরুদ্ধে ঋণ খেলাপীকে সহায়তা অথবা এই সম্পর্কিত কোনো অভিযোগের বিষয়ে তদন্তের নোটিশ প্রদান করা হলে, নোটিশের প্রক্রিয়া সম্পন্ন না হওয়া অবদি পরিচালকদের পদ ছাড়তে অথবা পদত্যাগ করতেও বাধা প্রদান করা হয়েছে। এরূপ বিধানসমূহ অত্যন্ত কঠোর প্রতীয়মান এবং আসামীকে অবশ্যই তার ন্যায্য বিচারের অধিকার প্রদান করা উচিত। তাদের উপর এরূপ কঠোর শাস্তি আরোপের পূর্বে অবশ্যই শুনানির সুযোগ প্রদান করা উচিত।
যেকোনো খাতের উন্নয়নের জন্য সুশাসন প্রতিষ্ঠাই হল পূর্বশর্ত। তাই ব্যাংকিং খাতের সুপ্রতিষ্ঠিত উন্নয়নের লক্ষে ব্যাংক-কোম্পানি আইনের প্রস্তাবিত সংশোধনীর ১৪ক ধারার আওতায় কয়েকটি কঠোর নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে। পূর্বে ব্যাংকের শেয়ার ক্রয়ের ক্ষেত্রে কোনো ব্যাক্তি, কোম্পানি বা একই পরিবারের সদস্যদের দ্বারা যৌথভাবে বা স্বতন্ত্রভাবে ১০% এর বেশি শেয়ার ক্রয় নিষিদ্ধ ছিল এবং এখন নতুন সংশোধনী অনুসারে কোনও প্রতিষ্ঠান বা একই সংঘবদ্ধ প্রতিষ্ঠান বা কোম্পানি পৃথক সত্তা থাকা সত্তেও মোট ১০% এর বেশি শেয়ার সংরক্ষণ করতে বাধা প্রদান করা হয়েছে। এই জাতীয় অন্তর্ভুক্তির ফলে কোনও একক সত্তার ব্যাংকিং পরিষেবা অর্জনের ক্ষেত্রে কোনো শ্রেষ্ঠত্ব থাকবে না। এগুলি ব্যাংক-কোম্পানির মালিকানাধীন কোনো একক সংস্থা বা পরিবার বা প্রতিষ্ঠান কর্তৃক আধিপত্য রোধ করতে সক্ষম হবে এবং ব্যাংক খাতে সুশাসন এর স্থায়িত্ব নিশ্চিত করবে।
ব্যাংক কোম্পানি আইন ১৯৯১ এর প্রস্তাবিত ধারা ১৪খ অনুসারে, একজন ব্যক্তি, সংস্থা বা প্রতিষ্ঠানকে পর্যাপ্ত শেয়ারহোল্ডার হওয়ার যোগ্যতা অর্জনের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদন প্রয়োজন হবে। সংশোধনীতে মূলত দুটি শর্তের অন্তর্ভুক্তি রয়েছে। প্রথমত, কোনো ব্যাংক সংস্থা অন্য ব্যাংক সংস্থার সংখ্যাগরিষ্ঠ শেয়ারধারক হতে পারবে না। দ্বিতীয়ত, কোনো আইনি সত্তা কোনো ব্যাংক সংস্থার সংখ্যাগরিষ্ঠ শেয়ারধারক থাকা অবস্থায় অন্য কোনো ব্যাংক-কোম্পানির সংখ্যাগরিষ্ঠ শেয়ারধারক হতে পারবে না। এরূপ শর্তাবলী ব্যাংক-কোম্পানির শেয়ার মালিকানার নিয়ন্ত্রনের মাধ্যমে ঋণ ও শেয়ার সম্পর্কিত ঝুঁকি বিপুল পরিমাণ হ্রাস করতে উল্লেখ জনক ভূমিকা রাখতে পারবে। এছাড়াও, এই বিধানটি আর্থিক খাতে সুশাসন এবং স্থিতিশীলতা বজায় রেখে ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের স্বার্থ রক্ষা করবে বলে আশা করা যায়।
পূর্ববর্তী আইনে পরিচালক, ব্যবস্থাপনা পরিচালক এবং প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা নিয়োগ, পদায়ন, বরখাস্ত বা অপসারণের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদনের প্রয়োজন ছিল। প্রস্তাবিত সংশোধনীতে উপরোক্ত কর্মকর্তা এবং তাহাদের দুই স্তর অধঃস্তন কর্মকর্তাদের পুনঃনিয়োগের জন্যও বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃক অনুমতির বিধান রয়েছে। পূর্বে, কোনও ব্যাংক-কোম্পানি পরিচালকের তার পরিচালকত্ব চলাকালীন সময়ে অন্য কোনও ব্যাংক-কোম্পানির পরিচালক হওয়ায় নিষেধাক্কা ছিল। ব্যাংক-কোম্পানিতে একক শিল্প গোষ্ঠীর নিয়ন্ত্রণ রোধ করতে নতুন প্রস্তাবনায় এজেন্ট বা প্রতিনিধিদের জন্যও একই বিধি প্রয়োগ করার প্রস্তাব করা হয়েছে। কিন্তু, এই বিধিগুলি রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ব্যাংক কর্মকর্তাদের জন্য প্রযোজ্য নয়। এটি বেসরকারী ব্যাংকের কর্মকর্তাদের সাথে বৈষম্য এবং বৈষম্যমূলক আচরণের বহিঃপ্রকাশ স্বরূপ। সুতরাং, অভিন্নতা এবং ন্যায্যতার স্বার্থে নতুন আইনের এই ধারার পুনর্বিবেচনা অতিব জরুরি।
নতুন সংশোধনীতে অন্তর্ভুক্ত আরও কয়েকটি বিধি কঠোর প্রকৃতির ও অসামঞ্জস্যপূর্ণ। উদাহরণস্বরূপ, যে সকল কর্মকর্তার বিরুদ্ধে অভিযোগ বা তদন্তের পরে জালিয়াতি, আর্থিক অপরাধ, অবৈধ কার্যক্রম বা একই জাতীয় দাবী প্রমাণিত হয়েছে, তাদের উক্ত সিদ্ধান্তকে আদালতে চ্যালেঞ্জ করার কোনো বিধান রাখা হয়নি। তদুপরি, ব্যাংক কোম্পানি আইনের ৪৬ ধারায় বাংলাদেশ ব্যাংকের এই জাতীয় অভিযোগের জন্য যে কোনো ব্যাংক সংস্থার চেয়ারম্যান, পরিচালক, ব্যবস্থাপনা পরিচালক, প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা বা দুই স্তর নিম্নস্ত কর্মকর্তাদের অপসারণেরও ক্ষমতা প্রদান করা হয়েছে। যদিও এই ধরনের বিধানগুলি যেকোনো ক্ষতিকারক অবৈধ কার্যকলাপ এবং আন্তর্জাতিক নিয়মাবলীর মান বজায় রাখতে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করবে, তবে এ জাতীয় বিধানগুলি ন্যায়বিচার পাওয়ার মানবাধিকারের সাথে সরাসরি সাংঘর্ষিক। আইনের আন্তর্জাতিক মান বজায় রাখা গুরুত্বপূর্ণ, তবে আইন প্রনয়নের সময় সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গের বিভিন্ন মৌলিক অধিকার যেমনঃ সুষ্ঠ বিচার পাওয়ার অধিকার, আত্মরক্ষার অধিকার, এবং স্ব-মত ব্যাখ্যার অধিকার অবশ্যই নিশ্চিত করতে হবে। এছাড়াও, যেকোনো শাস্তি প্রদানের পূর্বে অবশ্যই সমস্ত অভিযোগ যুক্তিসঙ্গত এবং সন্দেহাতিত ভাবে প্রমাণ করতে হবে। অন্যথায়, এই ধরনের স্বেচ্ছাচারী বিধানগুলি অপ্রাসঙ্গিক হবে এবং ফলস্বরূপ, মাননীয় সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগে রীট এর মাধ্যমে চ্যালেঞ্জ যোগ্য হবে।
ব্যাংক কোম্পানির পরিচালনা পর্ষদ আরও কার্যকর করার লক্ষে কিছু নতুন বিধান সংশোধন ও সংযোজন করার প্রস্তাবনা দেওয়া হয়েছে। পূর্বে কোন প্রতিষ্ঠানে মাত্র তিনজন স্বতন্ত্র পরিচালক রাখার বিধান থাকলেও নতুন প্রস্তাবনা অনুযায়ী পরিচালক সংখ্যা স্বতন্ত্র পরিচালকসহ ন্যূনতম এগারো জন এবং সর্বাধিক বিষ জন হবে; তবে স্বতন্ত্র পরিচালকের অনুপাত অবশ্যই মোট পরিচালকের অন্যূন এক পঞ্চমাংশ হতে হবে। তদুপরি, আন্তর্জাতিক অনুশীলন এবং নীতি অনুসরণ করে পরিচালকদের একাডেমিক, পেশাদার এবং বাস্তব অভিজ্ঞতা থাকার নীতি বৃদ্ধি করা হয়েছে এবং বছরে একবার বিকল্প পরিচালক নিয়োগ দেওয়া যাবে, তবে পরিচালকের কার্যালয়ের মেয়াদ অবশ্যই ছয় মাসের অধিক হবে না। তদুপরি, প্রস্তাবিত সংশোধনী অনুসারে প্রতিটি ব্যাংক-কোম্পানিকে উহাদের পরিচালনা পর্ষদের সদস্যদের সমন্বয়ে "নমিনেশন ও রেমুনারেসন কমিটি" এবং "এথিকস ও কমপ্লাইয়েন্স কমিটি" গঠন করতে হবে সংশ্লিষ্ট বিষয়াবলী মোকাবেলা করার জন্য।
ব্যাংক সংস্থা আইনের নতুন সংশোধনী অনুযায়ী ঋণ বা অগ্রিমের অনুদান পাওয়ার পূর্বে ব্যক্তিগত গ্যারান্টি এবং সিকিউরিটি প্রদান করার প্রয়োজন হবে। এই বিধানটি পরিচালকের সাথে সম্পর্কিত যে কোনো ঘনিষ্ঠ সংস্থা বা ব্যক্তির ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য হবে। এমনকি কোনো ব্যাংক-কোম্পানি বা তার পরিচালক বা পরিবারের সদস্য বা ২০% ভোটাধিকার প্রাপ্ত কোনো ব্যক্তির ক্ষেত্রেও বিধানটি সমান ভাবে প্রযোজ্য হবে। শরিয়া ব্যাংকিংয়ের ক্ষেত্রে কোন পরিচালকের পরিবারের সদস্য কোনো সিকিউরিটি প্রদান ব্যতিত মুদারবা ও মুশারাকা এর সুবিধা গ্রহণ করার অনুমতি পাবে না। প্রকৃতপক্ষে, এই বিধানসমূহ ব্যাংকের উপর অবৈধ প্রভাব হ্রাস করার লক্ষে প্রস্তাবিত হয়েছে। এছাড়াও, এটি কোনো ব্যাংকিং আর্থিক খাতে যথাযথ শৃঙ্খলা ও শাসন ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করবে। কোনো ব্যাংক সংস্থার পক্ষে খেলাপি ঋণগ্রহীতাকে ঋণের সুবিধা প্রদান অবৈধ করা হয়েছে। এই বিধান লংঘনের জন্য দায়িত্বে থাকা সমস্ত পরিচালক এবং কর্মকর্তা দায়বদ্ধ থাকবেন এবং লংঘনে সর্বনিম্ন পাঁচ লক্ষ টাকা জরিমানা বা তিন বছরের কারাদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবে।
তদ্ব্যতীত, ব্যাংক কোম্পানি আইন সংশোধনীতে, ধারা ২৭কক দ্বারা পরিচালকদের কাছ থেকে বৃহত্তর জবাবদিহিতার বিধি প্রদান করা হয়েছে; এছাড়াও, দোষী সাব্যস্ত হলে কঠোর শাস্তি নিশ্চিত করারও বিধান রয়েছে। ধারা ২৭ ককক এর মাধমে কোনও ব্যাংক সংস্থায় দুর্দান্ত পরিচালনা ও প্রশাসনের জন্য স্বেচ্ছাকৃত খেলাপী ঋণ গ্রহীতাদের সনাক্তকরণ এবং তালিকা তৈরি করতে নির্দেশ প্রদান করা হয়েছে। ধারা ২৭ কককক এর অধীনে স্বেচ্ছাকৃত খেলাপী ঋণ গ্রহীতাদের পুনরায় ঋণ সুবিধা প্রদানে নিষেধাক্কা প্রদান এবং শীঘ্রই তাদের বন্ধকী সম্পত্তি দখল করিয়া বিক্রয়/নিলামের জন্য উপস্থিত করতে নির্দেশনা প্রদান করা হয়েছে। এছাড়াও বিজনেস ক্লাসে বিদেশ ভ্রমণ, গাড়ি বা বাড়ি রেজিস্ট্রেশন, ট্রেড লাইসেন্স ইস্যু, আরজেএসসি এর আওতায় নিবন্ধকরণ নিষেধাজ্ঞার আওতাভুক্ত করা হয়েছে। ঋণখেলাপিদের রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক ভাবে বয়কট করারও প্রবিধান এর প্রস্তাবনা দেওয়া হয়েছে। এরূপ ধারার আওতায় বর্ণিত বিধিনিষেধগুলি স্বেচ্ছাকৃত খেলাপী ঋণ গ্রহীতা ও পরিচালকদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করতে সক্ষম হবে। এছাড়াও, এই জাতীয় পদক্ষেপগুলি ঋণ সুবিধার সাথে যুক্ত ঝুঁকিপূর্ণ কারণসমূহ সমাধান করবে এবং যথাযথ শৃঙ্খলা পুনরুদ্ধার করবে। এগুলি স্বেচ্ছাকৃত খেলাপী ঋণ গ্রহীতাদের যথাযথ জবাবদিহিতা এবং সামাজিক লজ্জা নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে আইনসভার অনেক প্রতিক্ষিত ও সাহসী পদক্ষেপ হিসাবে বিবেচিত হতে পারে।
ব্যাংক কোম্পানী আইন ১৯৯১ এর পঞ্চম অনুচ্ছেদের ৫৮ হইতে ৭৬ ধারাসমুহের মধ্যে অবিচ্ছিন্ন পরিবর্তন এর প্রস্তাবনা করা হয়েছে, যা দুর্বল ব্যাংক সংস্থাগুলির যথাযথ ব্যবস্থাপনার সংশোধনমূলক পদক্ষেপের কিছু অতি গুরুত্বপূর্ণ বিধানের সমন্বয় করেছে।
প্রস্তাবিত সংশোধনীতে শাস্তি বা জরিমানা সংক্রান্ত বিধানগুলি আরও কঠোরতর করা হয়েছে। লাইসেন্সের মেয়াদ শেষ হওয়ার পরে বা লাইসেন্সবিহীন ব্যবসা করার জন্য পাঁচ লক্ষ টাকা হতে পঞ্চাশ লক্ষ টাকা পর্যন্ত জরিমানা, এমনকি সাত বছর পর্যন্ত কারাদণ্ডও হতে পারে। একইভাবে, কেউ যদি বিভ্রান্তিমূলক, মিথ্যা বা মনগড়া দলিল বা তথ্য সরবরাহ করে তবে সেই ব্যক্তিকে তিন বছরের কারাদণ্ড অথবা সর্বোচ্চ পাঁচ লক্ষ টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত করারও বিধান আছে। এই জাতীয় কঠোর শাস্তি আন্তর্জাতিক মান বজায় রাখতে সহায়তা করবে, তবে, বিভিন্ন মানবাধিকার যেমন- সুষ্ঠ বিচার পাবার অধিকার, স্ব-প্রতিরক্ষা ও স্ব-মত ব্যাখ্যার অধিকার যাতে লঙ্ঘন না হয় এ বিষয়ে সতর্ক থাকতে হবে এবং যেকোনো আনিত অভিযোগের শাস্তি প্রদানের পূর্বে অভিযোগটি সন্দেহাতিত ভাবে প্রমাণ করতে হবে। অন্যথায় বিধানগুলিকে মাননীয় সুপ্রিম কোর্ট-এ রিট এর মাধ্যমে চ্যালেঞ্জ যোগ্য হবে।
নতুন সংশোধনী অনুযায়ী, বাংলাদেশ ব্যাংকে আর্থিক তথ্য জমা দেওয়ার পরে, এখন ব্যাংক সংস্থাগুলিকে সংবাদপত্রগুলিতে একই তথ্য প্রকাশ করার প্রয়োজন নাই; বরং তথ্যাবলী শুধুমাত্র ওয়েবসাইটে যেখানে তথ্য পরিষ্কারভাবে দৃশ্যমান এমন স্থানে প্রকাশ করতে হবে। বর্তমান প্রেক্ষাপটে নতুন বিধানটি অতি যুগাপযুগি উদ্যোগ, ইহার ফলে ব্যাংকগুলির ব্যয় হ্রাস পাবে এবং যে কোনও জায়গা হতে যে কোনো সময়ে অনলাইনে প্রয়োজনীয় তথ্য সহজেই পাওয়া সম্ভব হবে।
ব্যাংক-কোম্পানি আইনের প্রস্তাবিত সংশোধনী অবশ্যই আন্তর্জাতিক মান এবং নীতি বজায় রেখে পূর্ববর্তী আইনের বেশিরভাগ সমস্যাকে সমাধানের চেষ্টা করেছে। যেহেতু, পরিচালক, ব্যবস্থাপনা পরিচালক, প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা এবং অন্যান্য সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের জরিমানা ও অযোগ্যতার বিষয়ে কয়েকটি কঠোর বিধান মানবাধিকারের নীতিগুলির সাথে সরাসরি সাংঘর্ষিক, সুতরাং, আইন প্রণয়ন কর্তৃপক্ষ কর্তৃক এই আইনসমূহ পুনর্বিবেচনা করাই শ্রেয়। সামগ্রিকভাবে, ব্যাংক কোম্পানি আইনের নতুন সংশোধনী “স্বেচ্ছাকৃত খেলাপী ঋণ গ্রহীতা” এবং এই সংক্রান্ত কিছু বৃহৎ সমস্যা, একক শিল্প গোষ্ঠী বা পরিবারের একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণ এবং পূর্ববর্তী ব্যাংক-কোম্পানি আইন ১৯৯১ এর কিছু দুর্বলতার কারণে ব্যাংকিং খাতের সাধারণ মানুষের আস্থা হ্রাস পুনরুদ্ধারে সাফল্যের সাথে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারবে এবং দেশের ব্যাংক কোম্পানির সুশাসন এবং দক্ষ পরিচালনা নিশ্চিত করে একটি সুসম ভাবে দীর্ঘ পথ অতিবাহিত করতে ভূমিকা রাখবে বলে আশা করা যায়।
- ব্যারিস্টার শাফায়াত উল্লাহ
লিঙ্কন’স ইন, যুক্তরাজ্য
এডভোকেট, সুপ্রিম কোর্ট, বাংলাদেশ