মিয়ানমার সেনাবাহিনী কর্তৃক বাস্তচ্যুত হয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া প্রায় ১১ লাখ রোহিঙ্গাকে আশ্রয় এবং ভরণপোষণের ব্যয় দিনে দিনে বাড়ছে। কমছে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সহযোগিতা। হিসাব বলছে রোহিঙ্গা ঢলের ৩ বছরে এ খাতে প্রায় ৯০ হাজার কোটি টাকা ব্যয় হয়েছে। এদিকে রাখাইনে রোহিঙ্গাদের টেকসই প্রত্যাবাসনের চলমান উদ্যোগ বা প্রক্রিয়া থমকে যাওয়ার প্রেক্ষিতে আপাতত ১ লাখ বাস্তুচ্যুতকে ভাষানচরেই পুনর্বাসনের সিদ্ধান্ত হয়েছে। গভীর সমুদ্র থেকে ক’মাস আগে উদ্ধার হওয়া কয়েক শ’ রোহিঙ্গাকে সরাসরি ভাষানচরে পুনর্বাসন করায়, সেখানে তারা বেশ স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করায় কক্সবাজারের ক্যাম্পে গাদাগাদি করে বসবাসরতরা উৎসাহিত হয়েছে বলে রিপোর্ট পাওয়া গেছে। চলমান বর্ষা শেষে রোহিঙ্গাদের ব্যাপক হারে ভাসানচরে পাঠাতে চায় সরকার।
এ প্রসঙ্গে পররাষ্ট্র সচিব মাসুদ বিন মোমেন স্পষ্ট করে বলেন,রোহিঙ্গাদের ভাসানচরে পুনর্বাসনের চিন্তা সাময়িক। তাদের চূড়ান্ত গন্তব্য হবে রাখাইন। সচিব বাংলাদেশে রোহিঙ্গাদের আত্তীকরণের সম্ভাবনাও নাকচ করে দেন।
বলেন, এমন চিন্তার কোনো অবকাশ নেই। রোহিঙ্গাদের জন্য বিপুল অর্থ বিনিয়োগে বাংলাদেশ আগ্রহী নয়, জানিয়ে তিনি বলেন- এতে রোহিঙ্গারা দলে দলে আবার বাংলাদেশে পালিয়ে আসতে উৎসাহিত হবে। তবে রাখাইনে প্রত্যাবাসনের পর রোহিঙ্গারা যেন জীবন-জীবিকা অর্জন করতে পারে, সেজন্য ষষ্ঠ থেকে নবম শ্রেণি পর্যন্ত মিয়ানমারের কারিকুলামে শিক্ষাব্যবস্থা চালু করেছে বাংলাদেশ।
এ ব্যাপারে কূটনৈতিক সূত্র বলছে, কক্সবাজারের বিভিন্ন ক্যাস্প মানবিক কারণে অস্থায়ী আশ্রয় পাওয়া ১১ লাখ রোহিঙ্গার দুই বছরের দৈনন্দিন প্রয়োজন মেটাতে বাংলাদেশ সরকারসহ বিভিন্ন সূত্র থেকে ব্যয়ের জোগানে হিমশিম খেতে হয়েছে। এছাড়া ত্রাণ বা সহায়তা বাবদ রোহিঙ্গাদের পেছনে দাতা গোষ্ঠী বা অন্য কোনো সূত্র থেকে আর্থিক সহায়তা পাওয়ার বাইরেও সরকারের নিজস্ব তহবিল থেকে অনেক টাকাই ব্যয় হয়েছে এবং হচ্ছে। রোহিঙ্গাদের পেছনে সরকারের ব্যয় প্রসঙ্গে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী গণমাধ্যমে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে জানিয়েছেন রোহিঙ্গাদের জন্য বাংলাদেশ সরকার প্রতিমাসে ব্যয় করছে তিনশ’ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। যা বাংলাদেশি টাকায় প্রায় আড়াই হাজার কোটি টাকারও বেশি। পররাষ্ট্রমন্ত্রীর দেয়া হিসাব মতে, গত তিন বছরে (৩৬ মাসে) রোহিঙ্গাদের পেছনে সরকারের সরাসরি ব্যয়ের পরিমাণ ৯০ হাজার কোটি টাকা। এক হিসাব বলছে, রোহিঙ্গাদের জন্য খাবারসহ ক্যাম্পে বসবাসকারী রোহিঙ্গা নারী-পুরুষ ও শিশুদের জন্য স্বাস্থ্য শিক্ষা বিষয়ক সহায়তা দিচ্ছে সরকার। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের তত্ত্বাবধানে ইউএনএইচসিআর, জাতিসংঘের বিভিন্ন সংস্থাসহ আন্তর্জাতিক ও দেশীয় এনজিও’র সহায়তায় রোহিঙ্গাদের জন্য মানবিক সহায়তায় পরিচালিত হচ্ছে। বর্তমানে বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচির আওতায় দুই থেকে তিন সদস্য বিশিষ্ট পরিবারের জন্য প্রতিমাসে ৩০ কেজি চাল, নয় কেজি ডাল ও তিন লিটার ভোজ্য তেল দেয়া হচ্ছে। চার থেকে সাত সদস্যের পরিবারের জন্য জনপ্রতি মাসে ৬০ কেজি চাল, ১৮ কেজি ডাল ও ছয় লিটার ভোজ্য তেল এবং আট এর অধিক সদস্যের পরিবারের জন্য প্রতি মাসে ১২০ কেজি চাল, ২৭ কেজি ডাল এবং ১২ লিটার ভোজ্য তেল সরবরাহ করা হচ্ছে। বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি প্রতি মাসে দুই রাউন্ডে খাদ্য সামগ্রী বিতরণ করে। এর বাইরেও ক্যাম্পে বসবাসকারী রোহিঙ্গা শিশুদের জন্য বিভিন্ন প্রকার শিশুখাদ্য সরবরাহ করা হয়। দেয়া হয় প্রয়োজনীয় ওষুধ। কক্সবাজার জেলা প্রশাসন এর যাবতীয় ব্যবস্থাপনা করে।
অপরদিকে ২০১৮ সালের জুন মাসে জাতিসংঘের এক রিপোর্টে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গার পেছনে বছরে খরচ হতে পারে অন্তত ৬০ কোটি ডলার। দুই বছরের হিসাবে যার পরিমাণ দাঁড়ায় ১২০ কোটি ডলার। যেটি কিনা বাংলাদেশের অর্থনীতির চাকাকে সচল রাখার ক্ষেত্রে বড় ধরনের একটি প্রতিবন্ধকতা। জাতিসংঘের ওই রিপোর্টে আরো বলা হয়, বাংলাদেশের মানুষের পেছনে সরকারের মাসিক ব্যয় মাথাপিছু ৭০০ ডলার। অথচ এ বিপুল পরিমাণ রোহিঙ্গাদের জীবনযাত্রার চাহিদা মেটাতে একই পরিমাণ অর্থ ব্যয় হচ্ছে বাংলাদেশ সরকারের। কিন্তু এই ব্যয়ভার বহনের জন্য আয়ের কোন সুনির্দিষ্ট উতস নেই। তবুও ব্যয় থেমে নেই। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে বাংলাদেশের বাজেটে আলাদা করে রোহিঙ্গাদের জন্য ৪শ’ কোটি টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। এ বছরেও রোহিঙ্গাদের পেছনে সরকারের দেয়া বরাদ্দের পরিমাণ ৪শ’ কোটি টাকার কমবেশি। তবে ওই অর্থবছরের বাজেটে রোহিঙ্গা পুনর্বাসন খাতে সরকার ২ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ দিয়েছিল।
এদিকে জাতিসংঘের হিসাব অনুযায়ী ২০১৭ সালের ২৫শে আগস্ট থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে ৭ লাখ ৪৫ হাজার রোহিঙ্গা। তাছাড়া ১৯৭৮-৭৯, ১৯৯১-৯২ ও ১৯৯৬ সালে আসা রোহিঙ্গাদের মধ্যে কয়েক লাখ রয়ে গেছে এখনও। বাংলাদেশে জন্ম নিয়েছে আরও প্রায় ৬০ থেকে ৬৫ হাজার রোহিঙ্গা শিশু। সবমিলে বাংলাদেশের আশ্রয়ে থাকা রোহিঙ্গার পরিমাণ ১১ লাখের বেশি।
সানবিডি/এনজে