বিক্ষোভ, মানববন্ধন আর হাইকোর্টে চলমান রিটের মধ্যেই প্রকাশিত হলো মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি পরীক্ষার ফল। প্রকাশিত ফল অনুযায়ী শিক্ষার্থীরা ভর্তি হলে মানসম্পন্ন মেডিক্যাল কলেজগুলোর সুযোগ-সুবিধার অপচয় হবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। তাদের মতে, ফাঁস হওয়া প্রশ্নে পরীক্ষা দিয়ে যারা মেডিক্যালে ভর্তি হবে, তারা আসলে কতটুকু মেধাসম্পন্ন ডাক্তার হবে—এ নিয়ে সংশয় রয়েছে।
মেডিক্যাল কলেজের ২০১৫–২০১৬ শিক্ষাবর্ষের এমবিবিএস ও বিডিএস কোর্সে ভর্তি পরীক্ষায় শতকরা ৫৮ দশমিক ৪ ভাগ শিক্ষার্থী পাস করেছে। অথচ এই পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস নিয়ে দেশের বিভিন্ন স্থানে বিক্ষোভ করেছে মেডিক্যাল শিক্ষার্থীরা। এছাড়া, পরীক্ষা বাতিলের দাবিতে মানববন্ধন-প্রতিবাদ সমাবেশও করেছে তারা। এরই মধ্যে ফল যেন প্রকাশ করা না হয়, সে জন্য হাইকোর্টে একটি রিটও দায়ের করা হয়েছে। ওই রিট শুনানি ও নিষ্পত্তির হওয়ার আগেই রবিবার এই ফল প্রকাশ করা হয়েছে।
২০ সেপ্টেম্বর ২০১৫ রবিবার দুপুরে ফল প্রকাশ অনুষ্ঠানে স্বাস্থ্য প্রতিমন্ত্রী জাহিদ মালেক বলেছেন, প্রশ্ন ফাঁসের অভিযোগ ভিত্তিহীন। এখন থেকে প্রস্তুতি নিয়ে শিক্ষার্থীরা আগামীতে পরীক্ষা দেওয়ার সুযোগ পাবে।
এদিকে, এ পরীক্ষাকে জাল পরীক্ষা হিসেবে আখ্যায়িত করেছে বিএনপি। পাশাপাশি তারা ফের পরীক্ষা নেওয়ারও আহ্বান জানিয়েছে।
হাইকোর্টে রিটকারী আইনজীবী ইউনুছ আলী আকন্দ বলেন, আমি আশা করি, হাইকোর্ট ভর্তি পরীক্ষা বাতিল করবে। আর যেহেতু পরীক্ষার ফল প্রকাশিত হয়েছে আজ, তাই ভর্তির বিষয়ে হাইকোর্ট স্থগিতাদেশ দেবে বলেও তিনি আশা প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, প্রশ্ন ফাঁসের বিষয়ে সম্পূর্ণ দায় স্বাস্থ্য অধিদফতরের পরিচালক ও মহাপরিচালকের। এ পরীক্ষার প্রশ্ন তারা তৈরি করেন, তারা সংরক্ষণ করেন। সুতরাং প্রশ্ন ফাঁস হলে তারা দায়ী। আইনজীবী ইউনুছ আকন্দ পরিচালক এবং মহাপরিচালকের বিরুদ্ধে বিচার বিভাগীয় তদন্ত দাবি করেন।
প্রশ্ন ফাঁসের ফলে দেশ মেধাশূন্য হচ্ছে মন্তব্য করে ইউনুছ আলী আকন্দ বলেন, প্রশ্ন ফাঁসের ফলে মেধাবীরা সুযোগ পাচ্ছে না। কম মেধাবীরা ভর্তির সুযোগ পাচ্ছে। এতে দেশ মেধাশূন্য হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। ভবিষ্যতে আমরা মেধাবী ডাক্তার থেকে বঞ্চিত হব।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন চিকিৎসক বলেন, যারা প্রকৃত মেধাবী, তারা এতে বঞ্চিত হলো, আর যারা প্রশ্ন পেয়েছিল, তারা নানা সুযোগ সুবিধা পেয়ে গেল। তারা ঢাকা মেডিক্যালের রিসোর্সকে অ্যাবিউজ করল। এটা খুব দুঃখজনক। তিনি বলেন, প্রশ্ন হাতে পেয়ে যে শিক্ষার্থী পাস করে ঢাকা মেডিক্যালে পড়বে সে সবচেয়ে বেশি সুবিধা পাবে। আর প্রকৃত মেধাবীটি হয়তো ঢাকার বাইরে কোনও মেডিক্যালে আধুনিক যন্ত্রপাতি, ভালো শিক্ষক, বেশি রোগী থেকে বঞ্চিত হবে।
এবারের ভর্তি পরীক্ষায় হলে কর্তব্যরত কয়েকজন শিক্ষক জানান, পরীক্ষার ৩০–৪০ মিনিট পর যখন তারা পরীক্ষার্থীদের খাতায় স্বাক্ষর করার জন্য যান তখন দেখেছেন যে, শিক্ষার্থীরা চুপচাপ বসে আছে। অথচ তাদের খাতা সম্পূর্ণ ফিলাপ করা। এটা যথেষ্ট পরিমাণে বিস্ময়কর।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বঙ্গবন্ধু মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন চিকিৎসক বলেন, ২০০৬ সালেও একবার মেডিক্যালের প্রশ্ন ফাঁস হয়েছিল। তখন রাষ্ট্রপতি অধ্যাপক ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদের সময়, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমল ছিল। ওই সময়ে ব্যাপকভাবে মেডিক্যাল ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁস হয়েছিল। যারা সারারাত ফাঁসকারীদের ফ্ল্যাটে অভিভাবকসহ অবস্থান করে কয়েক লাখ টাকার বিনিময়ে প্রশ্ন পেয়েছিল, তারা পরের দিন পরীক্ষা দিয়ে ভালো মেডিক্যালগুলোয় ভর্তির সুযোগ পেয়েছিল। তিনি বলেন, শোনা গিয়েছিল, তখন স্বাস্থ্য উপদেষ্টা কার্ডিওলজিস্ট ডা. সুফিয়া খাতুন নিজ কোচিং সেন্টারগুলোর দুর্নীতির বিনিময়ে টাকার ভাগ পেয়েছিলেন। ওই পরীক্ষার ফল বাদ হতে গিয়েও ডা. সুফিয়ার কারণে সেটা আর বাদ দেওয়া হয়নি। তবে পরবর্তী সময়ে শিক্ষকেরা বলেছেন, ওই ব্যাচের মতো মেধাহীন শিক্ষার্থীদের তারা এর আগে কখনও পড়াননি।
প্রশ্ন ফাঁস ও মেডিক্যালে ভর্তি বিষয়ে জানতে স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক ডা. দীন মোহাম্মদ নুরুল হক এবং পরিচালক (শিক্ষা) এবিএম আবদুল হান্নানকে একাধিকবার ফোন করা হলেও তারা ফোন রিসিভ করেননি।