বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে পড়া করোনাভাইরাস মহামারীর কারণে বাংলাদেশ ও মালয়েশিয়ার আকাশপথে যোগাযোগ বন্ধ হয় গত মার্চে। পরবর্তী সময়ে গত জুলাই থেকে শর্তসাপেক্ষে ট্রানজিট যাত্রী এবং নির্দিষ্ট কিছু ক্যাটাগরির ভিসাধারীদের বাংলাদেশ থেকে মালয়েশিয়া যাওয়ার অনুমতি দেয়া হয়। তবে সংক্রমণ পরিস্থিতির উন্নতি না হওয়ায় এবার সব ধরনের ভিসায় বাংলাদেশীদের মালয়েশিয়া প্রবেশের নিষেধাজ্ঞা দেয়া হয়েছে।
এ ব্যাপারে ঢাকার মালয়েশিয়ার হাইকমিশন সূত্রে জানা গেছে, নভেল করোনাভাইরাস পরিস্থিতিতে বাংলাদেশসহ ২৩টি দেশের নাগরিকদের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে মালয়েশিয়া। গত ৪ আগস্ট হাইকমিশন এক নোটিসে জানায়, যেসব দেশে নভেল করোনাভাইরাসের প্রকোপ সবচেয়ে বেশি, সেসব দেশের নাগরিকদের মালয়েশিয়া প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে। এ তালিকায় থাকা দেশগুলোর মধ্যে রয়েছে বাংলাদেশ, ভারত, পেরু, কলম্বিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকা, আর্জেন্টিনা, মেক্সিকো, চিলি, ইরান, পাকিস্তান, তুরস্ক, জার্মানি, ইরাক, ফিলিপাইন, ইন্দোনেশিয়া, যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন, ব্রাজিল, স্পেন, ফ্রান্স, ইতালি, সৌদি আরব ও রাশিয়া। তাছাড়া এসব দেশ থেকে কোনো মালয়েশিয়ান নাগরিক নিজ দেশে ফেরার পর ১৪ দিন কোয়ারেন্টিনে থাকতে হবে বলে জানানো হয়েছে।
প্রসঙ্গত, এর আগে মালয়েশিয়া সরকার বিদেশী নাগরিকদের প্রবেশে কড়াকড়িতে রিকভারি মুভমেন্ট কন্ট্রোল অর্ডার আরএমসিও জারি করে। এ আরএমসিওর মেয়াদ গত ৩১ আগস্ট শেষ হওয়ার কথা ছিল। তবে গত সপ্তাহে এর মেয়াদ আগামী ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে। এ নিষেধাজ্ঞার ফলে যারা ছুটিতে বাংলাদেশে এসেছিলেন, তাদের আপাতত ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত মালয়েশিয়ায় প্রবেশে অপেক্ষা করতে হবে।
শনিবার পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী মো. শাহরিয়ার আলম সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এক পোস্টে জানান, এ নিষেধাজ্ঞার ফলে যারা ছুটিতে বাংলাদেশে এসেছিলেন, তাদের আপাতত ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত মালয়েশিয়ায় প্রবেশে অপেক্ষা করতে হবে। এ সময়ে কেউ দালালদের খপ্পরে পড়ে বা কারো কথায় প্ররোচিত হয়ে মালয়েশিয়ায় যাওয়ার চেষ্টা করবেন না। করলে চিরদিনের জন্য কালো তালিকাভুক্ত হয়ে যেতে পারেন। আমরা সার্বক্ষণিক আলোচনা চালিয়ে যাব। এ সিদ্ধান্তের পরিবর্তন হলে জানিয়ে দেয়া হবে।
এদিকে দেশের বিভিন্ন স্থানে থাকা মালয়েশিয়া প্রবাসীরা সংগঠিত হচ্ছেন। ৮ সেপ্টেম্বর ঢাকায় জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে মানববন্ধন করার উদ্যোগ নিচ্ছেন তারা। মালয়েশিয়ার সঙ্গে যোগাযোগ করে ছুটিতে আসা প্রবাসীদের ফিরে যেতে সরকারি উদ্যোগ ও আর্থিক ক্ষতিপূরণ, সহজ শর্তে ঋণ পাওয়ার দাবিতে তারা এ মানববন্ধন করবেন। এর আগে জুনে প্রায় ৫০০ জন মালয়েশিয়া প্রবাসীর স্বাক্ষরিত স্মারকলিপি প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থানমন্ত্রীকে দেয়া হয়।
মানববন্ধন আয়োজনের অন্যতম উদ্যোক্তা রুবেল ভুইয়া বলেন, বাংলাদেশ সরকার যদি মালয়েশিয়া সরকারের সঙ্গে যোগাযোগ করে আমাদের ফিরে যাওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করে, তাহলে আমরা কর্মহীন হয়ে পড়ব না। মালয়েশিয়া প্রবেশের অনুমতি এলে যেন সরকার সবাইকে দ্রুত সময়ে ফিরে যেতে সহায়তা করে এটা আমাদের প্রত্যাশা। এজন্য আমরা মানববন্ধনের কথা ভাবছি, তবে এখনো চূড়ান্ত হয়নি।
উল্লেখ্য, নভেল করোনাভাইরাস মহামারীর কারণে বাংলাদেশ ও মালয়েশিয়ার আকাশপথে যোগাযোগ বন্ধ হয় মার্চে। পরবর্তী সময়ে জুলাইয়ে শর্তসাপেক্ষে ট্রানজিট যাত্রী ও মালয়েশিয়ার রেসিডেন্স পারমিটধারী, পেশাজীবী, শিক্ষার্থীদের প্রবেশের অনুমতি দেয়া হয়। যার পরিপ্রেক্ষিতে গত ১৭ জুলাই থেকে ঢাকা-কুয়ালালামপুর ও কুয়ালালামপুর হয়ে বিভিন্ন গন্তব্যে কমার্শিয়াল ফ্লাইট চালু করে মালয়েশিয়া এয়ারলাইনস। পরবর্তী সময়ে বিভিন্ন সময়ে এয়ার এশিয়া, মালিন্দ এয়ার, ইউএস-বাংলা এয়ারলাইনস ও বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনস ঢাকা-মালয়েশিয়া রুটে ফ্লাইট চালু করে। মালয়েশিয়া সরকারের নতুন এ সিদ্ধান্তের ফলে ৬ সেপ্টেম্বরের পর থেকে বন্ধ হয়ে যাবে এসব ফ্লাইটও।
এ প্রসঙ্গে ইউএস-বাংলা এয়ারলাইনসের মহাব্যবস্থাপক (জনসংযাগ) মো. কামরুল ইসলাম বলেন, দীর্ঘ সময় বন্ধ থাকার পর গত মাসের মাঝামাঝি থেকে ঢাকা-কুয়ালালামপুর রুটের ফ্লাইট চালু করা হয়। ধীরে ধীরে যাত্রীদের চাহিদাও বাড়ছিল। কিন্তু নতুন এ নিষেধাজ্ঞার কারণে ৬ সেপ্টেম্বরের পর আবারো ফ্লাইট বন্ধ রাখতে হচ্ছে।
মধ্যপ্রাচ্যের পর বাংলাদেশের অন্যতম বড় শ্রমবাজার মালয়েশিয়া। বৈধ-অবৈধ মিলিয়ে সেখানে প্রায় ১২ লাখ বাংলাদেশী কর্মরত আছেন, যাদের বড় অংশই শ্রমিক। জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) তথ্য অনুযায়ী, ২০১৭ সালে মালয়েশিয়ায় গেছেন প্রায় এক লাখ কর্মী। ২০১৮ সালেও দেশটিতে গেছেন ১ লাখ ৭৫ হাজার ৯২৭ কর্মী। ওই বছরের সেপ্টেম্বর থেকে বাংলাদেশী কর্মী নেয়া বন্ধ হয়ে যায়। গত বছর দেশটিতে গেছেন মাত্র ৫৪৫ জন।
উল্লেখ্য, অবৈধ বিদেশীদের ফেরাতে মালয়েশিয়া সরকার ঘোষিত ‘ব্যাক ফর গুড (বি-ফোর-জি)’ কর্মসূচির মেয়াদ শেষ হয় গত বছরের ডিসেম্বরে। তবে এর পরও দেশটিতে রয়ে গেছেন অনেক প্রবাসী বাংলাদেশী; ভিসার মেয়াদ শেষ হওয়ায় যারা এখন অবৈধ হয়ে পড়েছেন, গত আগস্টে নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ জরিমানা দিয়ে এসব অবৈধ অভিবাসীকে নিজ দেশে ফেরার সুযোগ দিয়েছে মালয়েশিয়া সরকার। জরিমানা দিয়ে নিজ দেশে ফেরার সুযোগ পাবেন ছাত্র, পর্যটক ও ভ্রমণ ভিসায় গিয়ে অবৈধ হওয়া বিদেশীরা। তবে এ সুযোগ শুধু বাংলাদেশীদের জন্যই নয়, অন্যান্য দেশের অবৈধ হয়ে পড়া নাগরিকরাও এর আওতায় থাকবেন।