সমতল ভূমি থেকে বেশ খানিকটা জায়গা উঁচু করে বাঁধানো। চারদিকটা বাহারি ফুলের অপরুপ শোভা ও গাছের নরম সবুজ পাতা দিয়ে ঘেরা। তার ভেতরে একটি বড় কূপকে ঘিরে বানানো হয়েছে কংক্রিটের গোলাকার বেদি। কূপের গভীর থেকে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে ৪২ ফুট উচ্চতার চৌকোনা ইটের স্তম্ভ। শিউলি ফুলের মিষ্টি গন্ধমাখা মনোরম সেই স্মৃতিস্তম্ভের সামনে দাঁড়িয়ে যেকোনো দর্শনার্থীর চোখে ভেসে ওঠে বাঙালির মুক্তিযুদ্ধের এক টুকরো ইতিহাস; পাকিস্তানি মিলিটারি আর তাদের এদেশীয় দোসরদের নারকীয় হত্যাযজ্ঞের ভয়াল স্মৃতি। নাম না জানা অসংখ্য শহীদের আত্মত্যাগের স্বাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের বধ্যভূমি স্মৃতিস্তম্ভ।
বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ শামসুজ্জোহা হল থেকে প্রায় আধা কিলোমিটার পূর্বদিকে অবস্থিত এই স্মৃতিস্তম্ভটি। প্রতিদিন কয়েকশ দর্শনার্থী একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে নিহত শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে বধ্যভূমি স্মৃতিস্তম্ভে আসেন। বিকেল গড়ালেই তরুন-তরুণীরা দল বেঁধে হাজির হন এখানে। বিজয়ের মাস ডিসেম্বরে হালকা শীতের আবেশ মাখানো বিকেলে বধ্যভূমিতে ভীড় যেন অন্য সময়ের তুলনায় কিছুটা বেশি।
অনেকে ঘুরতে এসে মুক্তিযুদ্ধের শহীদদের শ্রদ্ধা জানিয়ে যাচ্ছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনফরমেশন এন্ড কমিউনিকেশন ইঞ্জিনিয়ারিং (আইসিই) বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী আল মামুন সাগর বলেন, আড্ডা দিতে বধ্যভূমিতে এসেছিলাম। এখানে এসে বুঝতে পারলাম এটা হৈ-হল্লা বা আড্ডাবাজির জায়গা নয়। যাদের ত্যাগ আর বুকের তাজা রক্তের বিনিময়ে আজকের এই লাল-সবুজ পতাকা পেয়েছি তাদের প্রতি শ্রদ্ধা আর ভালোবাসায় মনটা ভরে গেলো।
কক্সবাজারের কুতুবদিয়ার দুই বোন কোরশেদা জান্নাত ও আরশেদা জান্নাত। রাজশাহীতে রেলওয়ে পরীক্ষার সাক্ষাৎকার দিতে এসেছেন তারা। সুযোগ পেয়ে চলে এসেছেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় বধ্যভূমিতে। তারা দুজন আবেগঘন কণ্ঠে বলেন, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ দেখিনি।
সাধারণ জ্ঞান ও বিভিন্ন বই পড়ে রাজশাহীর এই বধ্যভূমির কথা জেনেছি। মুক্তিযুদ্ধের সময় এখানকার যত মুক্তিকামী মানুষদের নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছে, তাদেরই স্মৃতি বিজড়িত এই বধ্যভূমি। লাখো শহীদের আত্মত্যাগের করুণ কাহিনী প্রাণ পেয়েছে এখানে। ঘুরতে এসে মনের ভেতর দেশাত্মবোধ জন্ম নিয়েছে।
রাবির এই বধ্যভূমিতে সব সময় নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকেন তিন পুলিশ সদস্য। পেশাগত দায়িত্ব পালনের মধ্য দিয়ে বাঙালির মহান নায়কদের স্মরণ করার সুযোগ পেয়ে গর্ব প্রকাশ করেন তারাও।
বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ স্মৃতি সংগ্রহশালা সূত্রে জানা যায়, ১৯৭২ সালের ২৩ এপ্রিল আবিষ্কৃত একটি গণকবরের ওপর স্মৃতিস্তম্ভটি নির্মাণ করা হয়। সেসময় মুক্তিযোদ্ধা নুরুল ইসলাম এবং স্থানীয় কন্ট্রাক্টর জেবর মিয়া গণকবরটি খনন করেন। মৃত্যকূপের গভীর থেকে বেরিয়ে আসে হাজারো মানুষের মাথার খুলি ও কঙ্কাল। ২০০২ সালের ডিসেম্বর মাসে স্মৃতিস্তম্ভটির নির্মাণ কাজ শুরু হয়।
মুক্তিযুদ্ধের সময়কালে শহীদ শামসুজ্জোহা হল ছিলো পাকিস্তানি মিলিটারির ক্যান্টনমেন্ট। দীর্ঘ নয় মাস ধরে পাক বাহিনী এবং রাজাকার ও আল-বদররা বিশ্ববিদ্যালয়ের পার্শ্ববর্তী কাঁটাখালি, মাসকাটা দীঘি, চৌদ্দপাই, শ্যামপুর, ডাশমারী, তালাইমারী, রানীনগর এবং কাজলার কয়েক হাজার নারী-পুরুষকে এখানে ধরে এনে হত্যা করে। নরপিশাচদের নিষ্ঠুরতার হাত থেকে রেহাই পান নি, বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক, ছাত্র, কর্মচারী এবং তাদের পরিবারের সদস্যরাও।
নৃশংসভাবে হত্যা করা হয় রাজশাহী সাংবাদিক ইউনিয়নের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ আবু সাঈদ, রাবির সংস্কৃত ভাষা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক সুখরঞ্জন সমাদ্দার এবং মনোবিজ্ঞান বিভাগের প্রভাষক মীর আবদুল কাইয়ুমকে। পাক সেনারা রাবির তৎকালীন উপাচার্য সৈয়দ সাজ্জাদ হোসাইনের সহযোগিতায় গণিত বিভাগের প্রভাষক মুজিবর রহমান দেবদাস (২০১৫ সালে মুক্তিযুদ্ধে বিশেষ অবদানের জন্য একুশে পদকপ্রাপ্ত), পরিসংখ্যান বিভাগের কাজী সালেহ, ফলিত পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের ড. রকীব এবং বাংলা বিভাগের ড. আবু হেনা মোস্তফা কামালসহ অসংখ্য বাঙালিকে ধরে নিয়ে এসে জোহা হলে দিনের পর দিন অমানুষিক নির্যাতন চালায়। নরপিশাচদের লালসার শিকার হন অসংখ্য নারী। এই হলের পেছনে এক বর্গমাইল এলাকাজুড়ে ছিলো বধ্যভূমি। এছাড়া রাবি সংলগ্ন কাজলা এলাকা এবং রেলওয়ে স্টেশন এলাকায় পাওয়া যায় আরো কয়েকটি গণকবর।
দশ বছর ধরে বধ্যভূমি ও বাগানের পরিচর্যা করে আসছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মচারী মনসুর আলী। তিনি বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধের সময় খুব ছোট ছিলাম। এখানে যুদ্ধের শহীদদের খেদমত করার সুযোগ পাওয়ায় ভালো লাগে। সারা দিনে তিনশর বেশি দর্শনার্থী আসে বধ্যভূমি দেখতে। দূরের জেলাগুলো থেকেও অনেকে এই বধ্যভূমি দেখতে আসে। অনেকে এসে এর ইতিহাস জানতে চায়। আমি যতটুকু জানি তাদের বলি।তবে পঞ্চাশোর্ধ এই মালি দুঃখ প্রকাশ করে বলেন, ’৭১ এ গোটা রাবি ক্যাম্পাস পরিণত হয়েছিলো হত্যা আর র্নিযাতনের নগরীতে । অথচ এখনকার ছেলেমেয়েদের কাছে দিনদিন এ জায়গার গুরুত্ব যেন হারিয়ে যাচ্ছে। অনেকেই এসে বেদিতে বসে আড্ডা দেয়। জুতা পায়ে ওপরে ওঠে। আবার ফুলও ছিঁড়ে। এছাড়া গাছ চুরি হয় এখান থেকে। দেখে খুব খারাপ লাগে। যারা দেশের জন্য নিজের জীবন দিয়েছে তাদের স্মৃতি রর্ক্ষাথে নির্মিত স্মৃতিস্তম্ভে এগুলো হলে খুব অসহায় মনে হয়।’
সানবিডি/ঢাকা/হৃদয়/এসএস