করোনাকালীন সময়ে বিভিন্ন দেশ থেকে ফেরত আসা প্রবাসী কর্মীরা সরকার ঘোষিত প্রণোদনা প্যাকেজ থেকে এক টাকাও ঋণ পাননি।তাদের অভিযোগ, বিভিন্ন শর্তের বেড়াজালে তারা প্যাকেজ থেকে নিজেদের পুনর্বাসনে ঋণ পাচ্ছেন না। প্রবাসীকল্যাণ ব্যাংক বলছে, নীতিমালা না মেনে ঋণ দেওয়া সম্ভব নয়। প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয় বলছে, ঋণ বিতরণ সহজ করতে অতিসম্প্রতি নীতিমালা নমনীয় করা হয়েছে।
মহামারি করোনায় কাজ হারিয়ে দেশে ফেরা এবং বিদেশে মৃত্যুবরণকারীদের পরিবারের জন্য গত এপ্রিলে ২০০ কোটি টাকার প্যাকেজ ঘোষণা করে সরকার। কর্মী বিদেশ যাওয়ার সময় দেওয়া ফি থেকে ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ বোর্ডের তহবিলে জমা টাকা থেকে এ প্যাকেজ ঘোষণা করা হয়। ৪ শতাংশ সুদে বিদেশফেরতদের পাঁচ লাখ টাকা পর্যন্ত ঋণ দিতে গত ১৩ জুলাই প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয় এবং সরকার মালিকানাধীন প্রবাসীকল্যাণ ব্যাংকের মধ্যে সমঝোতা স্মারক (এমওইউ) সই করে। এর মধ্যে সমঝোতা অনুযায়ী দুই লাখ টাকা পর্যন্ত বিনা জামানতে ঋণ পাওয়ার কথা। গত ১৫ জুলাই থেকে ঋণ বিতরণ প্রক্রিয়া শুরু হয়। কিন্তু দুই মাসে একজনও ঋণ পাননি।
করোনার বিস্তার ঠেকাতে মালয়েশিয়ায় লকডাউন শুরুর পর গত ১১ মার্চ দেশে ফেরেন মুন্সীগঞ্জের শ্রীনগরের সাব্বির হোসাইন। দেশটিতে তিন বছর ছিলেন তিনি। মালয়েশিয়ায় যে প্রতিষ্ঠানের চাকরিতে প্রথমে গিয়েছিলেন, তা বদল করে বেশি বেতনে যে কাজ পেতেন তা-ই করতেন। করোনার সময় কাজ না থাকায় দেশে ফেরত আসেন সাব্বির হোসাইন। লাখ দেড়েক টাকা খরচ করে আবার বিদেশ ফিরে কাজ পাওয়ার নিশ্চয়তা নেই। তাই দেশে দোকান দেওয়ার পুঁজি জোগাতে ঋণের জন্য আবেদন করেন প্রবাসীকল্যাণ ব্যাংকের ঢাকার দোহার শাখায়; কিন্তু ব্যাংকের নানা শর্তের বেড়াজালে ঋণ পাননি। আরও বহু প্রবাসী কর্মীর একই অভিযোগ।
এ ব্যাপারে প্রবাসীকল্যাণমন্ত্রী ইমরান আহমদ বলেন, প্রবাসীকল্যাণ ব্যাংক নতুন একটি ব্যাংক। করোনা আসবে, তা কারও জানা ছিল না। ব্যাংকেরও ঋণ বিতরণের মতো তেমন প্রস্তুতিও ছিল না। এমন তাড়াও ছিল না। এখন ঋণের শর্ত অনেক শিথিল করা হয়েছে। নীতিমালা নমনীয় করা হয়েছে। এখন থেকে ঋণ পাবেন প্রবাসীরা। সোমবার রংপুর শাখার মাধ্যমে ঋণ বিতরণের উদ্বোধন করা হবে। মন্ত্রী বলেন, ২০০ কোটির প্যাকেজের সঙ্গে আরও ২৫০ কোটি টাকা যোগ হয়েছে। আগামী জানুয়ারির মধ্যে আরও ২৫০ কোটি টাকা আসবে। সব মিলিয়ে ৭০০ কোটি টাকার প্যাকেজ। আগামী মার্চ-এপ্রিলে বিশ্বব্যাংকের কাছ থেকে আরও ৪৫০ কোটি টাকার তহবিল পাওয়ার আশা করছেন। বিদেশফেরতদের পুনর্বাসনে টাকার অভাব হবে না বলে তিনি মনে করেন।
ঘোষিত প্যাকেজে টাকার পাহাড় জমলেও বিদেশফেরতরা বলছেন, ঋণ না পেলে লাভ কী- এমন প্রশ্নের উত্তরে প্রবাসীকল্যাণমন্ত্রী বলেন, আগের নীতিমালা অনুযায়ী গত ১ মার্চের পর যারা দেশে ফিরেছেন, তাদের ঋণ পাওয়ার যোগ্য মনে করা হয়। নতুন নীতিমালা অনুযায়ী গত ১ জানুয়ারি থেকে যারা ফিরেছেন, তারাও ঋণ পাবেন। ঋণ পাওয়ার জন্য জেলা কর্মসংস্থান ও জনশক্তি কার্যালয় থেকে প্রত্যয়নপত্র নেওয়ার বাধ্যবাধকতা বাতিল করা হয়েছে।
সংশ্নিষ্টরা জানান, আগের নীতিমালার ৪(ঘ) শর্তাবলিতে বলা হয়েছিল, ঋণের আবেদনকারী ক্ষতিগ্রস্ত অভিবাসী কর্মী, তা প্রমাণে জেলা কর্মসংস্থান ও জনশক্তি কার্যালয় থেকে প্রত্যয়নপত্র নিতে হবে। আবেদনকারীরা প্রমাণ করতে পারছিলেন না, তিনি ক্ষতিগ্রস্ত কর্মী। কারণ, দেশে ফেরত আসাদের কেউ চাকরি হারানোর সনদ দেখাতে পারেননি। গত ১৭ সেপ্টেম্বর ব্যাংকের জারি করা সংশোধিত নীতিমালা অনুযায়ী, বিদেশ গমন ও দেশে ফেরতের পাসপোর্টের ফটোকপি অথবা বিএমআইটির স্মার্টকার্ড সনদ অথবা বিদেশে চাকরির চুক্তিপত্র দিয়ে ঋণের আবেদন করা যাবে।
বিদেশফেরত প্রবাসীরা বলছেন, অনেক ক্ষেত্রে নীতিমালার বাইরে বিভিন্ন শর্ত জুড়ে দেওয়া হচ্ছে। নীতিমালায় কোথাও বলা হয়নি, আগে ব্যবসা চালু করে তারপর ঋণ নিতে হবে; বরং প্রকল্প ঋণ ও চলতি পুঁজি- দুই ধরনের ঋণের সুযোগই রাখা হয়েছে নীতিমালায়। কাতারফেরত প্রবাসী আতিকুল ইসলাম বলেন, খামার করার জন্য ঋণ আবেদন করার পর জানতে চাওয়া হয় খামার কোথায়। আগে খামার শুরু করতে হবে, তারপর ঋণ দেওয়া হবে। আতিকুলের প্রশ্ন, তার কাছে খামার শুরুর টাকা থাকলে কি ঋণের জন্য যেতেন।
এসব বিষয়ে প্রবাসীকল্যাণ ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মাহতাব জাবীন বলেন, ঋণ আবেদনকারীদের অনেকের প্রস্তাবনা পূর্ণাঙ্গ নয়। তিনি কীসের ব্যবসা করবেন, কত টাকা ঋণ লাগবে- এসবের তার বিস্তারিত থাকতে হবে আবেদনে। এ কারণে ঋণ বিতরণে বিলম্ব হচ্ছে।
মন্ত্রণালয় বলছে, ঋণের আরও আটটি শর্ত শিথিল করা হয়েছে। তবে পুরোনো ও সংশোধিত নীতিমালা বিশ্নেষণ করে দেখা গেছে, এর সাতটিতে সামান্যই পরিবর্তন এসেছে। উল্লেখযোগ্য পরিবর্তনের মধ্যে রয়েছে, সংশোধিত নীতিমালায় বিভিন্ন কাগজপত্রের সত্যায়িত কপির বদলে ফটোকপি দিয়ে ঋণ আবেদন করা যাবে। প্রশিক্ষণ সনদের পরিবর্তে প্রশিক্ষণ গ্রহণের অঙ্গীকার দিয়ে আবেদন করা হবে।