বাবা আমরা তোমার কেমন সন্তান!
প্রকাশ: ২০১৭-০৭-১৯ ১৭:১৫:১১
স্যোসাল মিডিয়ায় আজ একটা খবর দেখে মনটা খুব খারাপ লাগছে। বাবার মৃত্যু খবর পেয়ে সন্তান বলে ‘জরুরি মিটিংয়ে আছি,বাবার লাশ আঞ্জুমান মোফিদুলে দিয়ে দেন।’ একথা শুনার পর কি বলবো,তার কোন ভাষা খুঁজে পাই না।
বাবা শুধু একজন মানুষ নন, স্র্র্রেফ একটি সম্পর্কের নাম নয়। বাবার মাঝে জড়িয়ে আছে বিশালত্বের এক মায়াবি প্রকাশ। প্রতিবছর জুনের তৃতীয় রোববার বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বাবা দিবস পালিত হয়। আমাদের দেশেও আজকাল বেশ ঘটা করেই বাবা দিবস পালিত হয়ে থাকে।
বাবার প্রতি সন্তানের ভালবাসা প্রকাশের জন্য দিনটি বিশেষভাবে উৎসর্গ করা হয়ে থাকে। যদিও বাবার প্রতি সন্তানের ভালবাসা প্রকাশের জন্য দিনটি বিশেষভাবে উদযাপনের প্রয়োজন হয় না। তার পরেও পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের মতো বাংলাদেশে এখন বাবা দিবস পালন করা হয়। তখন ফেসবুকসহ সকল স্যোসাল মিডিয়া বাবার প্রতি ভালবাসায় ভাসে। বাস্তবে অনেক বাবা এই লোকটির মত সন্তানের ঘরে ঠাই পায় না। বৃদ্ধাশ্রমে ধুকে ধুকে এই পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করেন। তখন নিজেদেরকে ধিক্কার দিয়ে বলতে ইচ্ছে করে “বাবা আমরা তোমার কেমন সন্তান”।
এই বাবাই ছোটবেলা নিজের বুকের উপর রেখে এই সন্তানকে ঘুম পারিয়েছেন, নিজে না খেয়ে সন্তানকে খাইছেন। মাথার ঘাম পায়ে ফেলে প্রত্যেককে মানুষের মত মানুষ করেছেন। আমরা নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবাবে বসবাস করি। আমার বাবার কথাই বলি তিনি জীবনে অনেক কষ্ট করেছেন আমাদের, এখনো করছেন। রোদ-বৃষ্টিতে ভিজে আমাদের কাজ করে যান অভিরাম, ক্লান্তিহীনভাবে। নিজের সুখের কথা মোটেও চিন্তা করেন না। অসুখ হলে যতক্ষন সম্ভব ঔষধ না খেয়ে পারা যায় খান না। এই পিতা যদি মসজিদের বারান্দায় বা অন্য জায়গায় ধুকে ধুকে বিনা চিকিৎসায় মারা যায় এর চেয়ে মানবতা বিরোধী কাজ আর কি হতে পারে।
রিজেন্ট হাসপাতালের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ সাহেদ তার ফেসবুকে গত সোমবার রাত ১০টায় এমনই এক মর্মান্তিক ঘটনা পোস্ট করে সবাইকে পড়ার অনুরোধ করেছেন।
তিনি তার ফেসবুকে লিখেছেন, লোকটির নাম হামিদ সরকার। তিনি সরকারি কর্মকর্তা ছিলেন। আমি যখন উত্তরায় রিজেন্ট হাসপাতালের প্রথম শাখা উদ্বোধন করি, তখন উত্তরা পশ্চিম থানার তৎকালীন ওসি এবং মসজিদের ইমাম সাহেব আমার কাছে আসেন। তারা বললেন যে, একজন লোক অনেকদিন ধরে মসজিদের বাইরে পড়ে আছে। অনেকে ভিক্ষুক ভেবে তাকে দু-চার টাকা ভিক্ষা দিয়ে যাচ্ছেন।
তিনি আরো লিখেন, ইমাম সাহেব তার জন্য প্রেরিত খাবার থেকে কিছু অংশ লোকটিকে দিয়ে আসছেন প্রতিদিন। হঠাৎ লোকটি অসুস্থ হয়ে পড়ায় তারা আমার সরনাপন্ন হয়েছেন। এমতাবস্থায় আমি লোকটিকে আমার হাসপাতালে নিয়ে এসে চিকিৎসার ব্যবস্থা করি এবং দায়িত্বরত ডাক্তার ও অন্যান্য সকল কর্মকর্তা/কর্মচারীকে অবগত করি যে,এই লোকটির চিকিৎসার সকল দায়ভার আমার ও এর চিকিৎসায় যেন কোন ত্রুটি না হয়।
তিনি ফেসবুকে আরো লিখেন, হামিদ সরকার নামক লোকটির সম্পর্কে খোঁজ নিয়ে আমি রীতিমত অবাক হলাম। তিনি একজন অবসরপ্রাপ্ত জোনাল সেটেলম্যান্ট অফিসার। তার তিন ছেলের মধ্যে তিন জনই বিত্তশালী। উত্তরা তিন নম্বর সেক্টরে তার নিজস্ব বাড়ি আছে যা ছেলেদের নামে দিয়েছেন। তার বড় ছেলে ডাক্তার। নিজস্ব ফ্ল্যাটে স্ত্রী, শালী এবং শ্বাশুড়ী নিয়ে থাকেন, অথচ বৃদ্ধ বাবার জায়গা নেই।
মেঝ ছেলে ব্যবসায়ী, তারও নিজস্ব বিশাল ফ্ল্যাট আছে। যেখানে প্রায়ই বাইরের ব্যবসায়ীক অতিথীদের নিয়ে পার্টি হয়। অথচ বাবা না খেয়ে রাস্তায় পড়ে থাকে। ছোট ছেলেও অবস্থাসম্পন্ন। কিন্তু স্ত্রীর সন্তুষ্টির জন্য বাবাকে নিজের ফ্ল্যাটে রাখতে পারে না। সকল সন্তান স্বাবলম্বী হওয়া স্বত্তেও বাবার স্থান হয়েছে শেষে মসজিদের বারান্দায়। সেখান থেকে আমার হাসপাতালে।
আরও দুঃখজনক হলো, সর্বোচ্চ চেষ্টার পরেও পনের দিন পরে আরো একটা কার্ডিয়াক অ্যাটাকে হামিদ সাহেব মারা যান। তার মৃত্যুর পরে আমি তার বড় ছেলেকে ফোন করি। তিনি আমাকে প্রতি উত্তরে জানান যে, তিনি জরুরী মিটিংয়ে আছেন এবং লাশটি যেন আঞ্জুমান মফিদুল ইসলামে দিয়ে দেওয়া হয়।
আমরা যারা বাবা-মাকে অসম্মান,অবহেলা করি তারা কি একবারও ভেবে দেখি না যে, একদিন ওই জায়গাটাতে আমরা নিজেরা গিয়ে দাঁড়াবো। আমারা বাবা-মায়ের সাথে যে আচরণ করছি, তা যদি সেদিন আমার সন্তান আমার সাথে করে তবে? আজ আমাদের বাবা-মায়েরা সহ্য করছে। কাল আমরা কি সহ্য করতে পারব?’
একটা কথা মনে পড়ে গেল আমাদের দাদী নানীরা বলতেন, একদিন এক লাক তার সন্তানের সামনে পিতা-মাতাকে নোংরা মাটির বাসুনে ভাত দিতো, পিতা-মাতা মারা যাওয়া পর ঐ বাসুন ভেঙে ফেলতে চাইলো, তখন তার সন্তান বললো বাবা ভেঙো না ওটা ভবিষ্যতে কাজে লাগবে।
আসলেই আমরা যদি আমাদের পিতা-মাতার সহিত খারাপ আচারন করি, মৃত্যুর আগে হলেও তার ফল ভোগ করতে হবে। আসুন আমরা আমাদের পিতা-মাতাকে ভালবাসী, তাদের সেবা-শুশ্রূর্ষা করি, বৃদ্ধ বয়সে তাদের অবলম্বন হই।
লেখক: সাংবাদিক
sayeednews@gmail.com