বিসিএস না হলে কি জীবন বৃথা?:জি এম কিবরিয়া

:: প্রকাশ: ২০২০-০৭-০৬ ১১:৩৪:২৪


একদিন আমাদের স্কুলে কামাল স্যার সবাইকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, কি হতে চাই? আমরা ডাক্তার, পাইলট, ইঞ্জিনিয়ার, শিক্ষক, বিজ্ঞানীর বাইরে কিছুই বলতে পারিনি। তাছাড়া বিসিএস ক্যাডার যে কোন স্বপ্ন হতে পারে তা তখনকার ছেলে-মেয়েদের জানা ছিল না!

কি জানি, আমরা হয়তো অতটা মেধাবী ছিলাম না!

কিন্তু আজকাল নাইন-টেন থেকেই ছেলেমেয়েরা বিসিএস গাইডের ঘ্রাণ নিতে শুরু করে। আর মাস্টার্স শেষে-তো একে বারে আদা-জল খেয়ে আঠারো ঘন্টাই লেগে যায় পাল আমল, সেন আমল, মুঘল ও সামন্ত রাজাদের ইতিহাস ভাঁজতে। শুধু কি তাই? তারা ভাঁজা ভাঁজা করে ফেলে নবম-দশম শ্রেণীর গণিত ও ব্যাকরণ। তাদের নখদর্পণে চলে আসে পদ্মা সেতুর পিলার কয়টি কিংবা বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট কবে কতটা কয় সেকেন্ডে উৎক্ষেপন হয়েছিল।

আজ কালকের ছেলে-মেয়েদেরকে এমনিতেই ফেসবুক, ইউটিউবের দৈরাত্বে বিশ্ববিদ্যালয়ের সবুজ প্রকৃতি, গান, নাটক, আবৃত্তি, বিতর্ক, আড্ডা কিংবা ঝোপের পাশে চুপচাপ নিরিবিলি বসা ইত্যাদিতে আকৃষ্ট করে না। রাজনীতি সেতো তাদের জন্য নয়! তারপর যদি বিসিএস এভাবে হাতছানি দেয় বা দিতে থাকে, তবে তাদের হুঁশ থাকবেই বা কিভাবে?

তাই তারা ব্যাপকভাবে এখন লাইব্রেরিমুখী হয়েছেন! শাহবাগের পাবলিক লাইব্রেরিতে ভোর পাঁচটায় গিয়ে লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতেও কোন কষ্ট হয় না। সেই লাইন সাপের মতো পেঁচিয়ে দুই হাজার ছেলে-মেয়েকে জায়গা করে দেয়। অবশেষে সারাদিন লাইব্রেরিতে কাটিয়ে তারা রাতে বাসায় ফিরে! স্বপ্ন একটাই ঐ নিশ্চিত নিরাপদ জীবন!

বাহ্ চমৎকার তো! পড়াশোনা করার মধ্যে খারাপের কি দেখলেন?

কিন্তু মশাই লাইব্রেরিতে তারা কি পড়ে তা কি জানেন?

তারা কেবল বিসিএস গাইড পড়ে! বিশ্বাস না হলে পরখ করুন, দেখবেন সাহিত্য, দর্শন, জ্ঞান বিজ্ঞানের বইয়ে কয় ইঞ্চি ধূলা জমেছে, দেখে আসুন!

এবার একটি পরিসংখ্যান দেখুন,

৪১তম বিসিএসে মোট ৪ লক্ষ ৭৫ হাজার আবেদন পড়েছে। যা বিশ্বের ৪৯ টি দেশের জনসংখ্যার চেয়েও বেশি। অথচ পদ সংখ্যা মাত্র ২১৩৫ টি। প্রতি ২২২২ জনে একটি পদ।

এখন প্রশ্ন হলো বাকী ২২২১ জনের কি হবে?

রা বি তে একটি সেশনে ছাত্রদের জিজ্ঞাসা করেছিলাম।
তারা বলেছে, একবার না হলে ৫/৬ বছর ব্যাপী চেষ্টা করবে তারা।

আমি পাল্টা প্রশ্ন করেছিলাম, এর পরও যদি না হয়, তবে কি পড়াশোনা শেষ করার পর খুবই মূল্যবান ৫/৬ টি বছর জীবন থেকে বৃথায় চলে যাবে না?

তখন পিন পতন নীরবতা লক্ষ করেছিলাম।

এবার আপনাদেরকে একটি অবাক করা তথ্য দিচ্ছি:

২০১৯ সালে বাংলাদেশের ১ কোটি ২০ লাখ রেমিটেন্স যোদ্ধা দেশে রেমিটেন্স পাঠিয়েছেন ১৮.১২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার।

অপরদিকে এই রেমিটেন্সের ২/৩ অংশ নিয়ে গেছে ভারত, শ্রীলঙ্কাসহ কয়েকটি দেশের মাত্র ২/৩ লক্ষ বিদেশী কর্মী। শুধুমাত্র ২০১৭ সালে ভারত এদেশ থেকে রেমিটেন্স নিয়ে গেছে ১০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার।

অথচ এদেশে শিক্ষিত বেকার সংখ্যা ৪০ লক্ষ।

তৈরি পোশাক খাতে ২৪% মিড লেভেল থেকে টপ লেভেল ম্যানেজমেন্ট এ বিদেশি লোক কর্মরত। এদেশে এমবিএ এইচ আরের অভাব নেই। হতাশার কথা হলো ৮৫% গার্মেনটসের HR এ এ দেশীয় এমবিএ নয়, বিদেশি কর্মীরা কাজ করছেন।

কারন কি?

গার্মেন্টস মালিকের বক্তব্যে বার বার উঠে আসে এদেশের তরুণদের কারিগরি দক্ষতা, বাস্তব ভিত্তিক জ্ঞান ও ইংরেজি ভাষার দুর্বলতার কথা।

তারুণ্য মানুষের জীবনের সবচেয়ে মূল্যবান সময়। কিন্তু বাংলাদেশের শিক্ষিত মেধাবী তরুণ-তরুণীদের জীবনের একটা বড় অংশ যদি এভাবে বিসিএস বিসিএস করে কাটিয়ে দেয়, তাহলে রাজনীতিবিদ, উদ্যোক্তা, ব্যবসায়ী, গবেষক, বিজ্ঞানী, লেখক-সাহিত্যিক, সাংবাদিক, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব কোথা থেকে আসবে?

এসব মানুষ কি বিদেশ থেকে আমদানি করা যাবে?

তারচেয়ে ভয়ঙ্কর তথ্য হলো, এবারের বিসিএসে বিপুল সংখ্যক ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, কৃষিবিদ সাধারণ ক্যাডারে প্রশাসন বা পুলিশের চাকুরির জন্য সুপারিশ প্রাপ্ত হয়েছেন!

এটা কিসের আলামত! জাতি ধবংসের জন্য এর চেয়ে উৎকৃষ্ট উদাহরণ আর কি হতে পারে!

একজন ডাক্তার বা বুয়েটের ইঞ্জিনিয়ার তৈরির টাকা জোগাড় করতে একজন কৃষক শ্রমিককে কতটা ঘাম ঝড়াতে হয়, তা আপনারাই ভাল বলতে পারবেন!

অথচ এত টাকা খরচ করে যাকে ডাক্তার বানানো হলো, তিনি বড় ডাক্তার না হয়ে স্বগৌরবে চলে গেলেন বা যাচ্ছেন রাজা বাদশা হতে!

বিসিএস ফলাফল প্রকাশের পর মিডিয়া ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম তাদেরকে যেভাবে রাজা বাদশা বানিয়ে উপস্থাপন করতে দেখছি, তাতে তাদের ভাবনার রাজা বাদশা হতে আপত্তি আর থাকল না!

আর এভাবেই তারা নিজেদের চিন্তার মধ্যে একটা ভিআইপি ভাব নিয়ে আসে। নতুবা আমরা এক এসি ল্যান্ডকে দেখি, দিদি বলে ডাকায় এক মাছওয়ালার মাছের ডালা লাথি দিয়ে ফেলে দিতে; এক মহিলা ডাক্তারকে আপা বলে ডাকায়, তিনি বিসিএস পাশ করে এসেছেন মর্মে গর্জে উঠেছেন যা ভাইরাল হতে দেখি; দেখি বয়োজ্যেষ্ঠ মানুষদের কে কান ধরিয়ে দাঁড় করিয়ে রাখতে; কিংবা দেখি তিনি না আসা পর্যন্ত ফেরী ছাড়া যাবে না, তাই স্কুল ছাত্রের মৃত্যুর সংবাদ।

এসব দেখা-দেখির হাজারটা উদাহরণ আছে। কি লাভ হবে এসব উদাহরণ দিয়ে।

এই প্রতিযোগিতা, তীব্র তোষণ, প্রচারণা মাধ্যমে তাদেরকে সিভিল সার্ভেন্ট শব্দের অর্থটি ঘুরিয়ে শিখতে সাহায্য করছে কে? নিশ্চয়ই এই সমাজ।

আর সামাজিক এত ডিমান্ডের কারনেই তারা ভাবতে শিখে যাচ্ছে, সার্ভেন্ট অর্থ রাজা, সার্ভেন্ট অর্থ রাজা।

যদিও আমাদের দেশে হাজার হাজার নিবেদিত প্রাণ কর্মচারী সিভিল সার্ভিসে আছেন। তাদের প্রতি শ্রদ্ধা রেখেই বলছি, তরুণ প্রজন্মকে যে-কোনো মূল্যে বিসিএস ক্যাডার হতে হবে এই ভাবনাটা থেকে বেড় হয়ে আসতে হবে নতুবা এই ট্রেন্ট জাতির জন্য বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে।

অনেকেই মনে করছেন, বিসিএস হয়নি, আমার জীবন বৃথা। না জীবন কখনো বৃথা হয় না। জীবন অনেক মূল্যবান। বিসিএস সহ সব বিকল্প চিন্তা গুলো আমাদের তরুণদের মাথায় রাখতে হবে।

আমাদের কি বঙ্গবন্ধু, রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, সুভাষ বসু, সত্যজিত রায়, জয়নুল, আলাউদ্দিন খা, শাহ আবদুল করিম প্রমুখের মতো আর কাউকে দরকার নেই?

অথবা বিল গেটস, মার্ক জাকারবার্গ কিংবা জাবেদ করিম?

কে হবে আগামীর নায়ক? অবশ্যই তরুণদের কেউ।

কিন্তু শুধু বিসিএস বিসিএস করলেই কি মহান হওয়া যাবে? হয়তো বড় আমলা হবেন! কিন্তু মহান বা বড় কিছু?

জি এম কিবরিয়া
প্রধান সমন্বয়কারী
ক্লিন গ্রিণ বাংলাদেশ।