পিই নয়; বরং পিইজি দেখে শেয়ার কিনুন
:: আপডেট: ২০২০-০৮-৩১ ০৯:৪২:৫৩
বাংলাদেশের স্টক মার্কেটে দীর্ঘদিন ধরে অতি মন্দা অবস্থা বিরাজ করছিল। বিগত জুলাই ২০২০ মাসের শেষ সপ্তাহ থেকে মার্কেট আস্তে আস্তে ঘুরে দাঁড়াচ্ছে। মার্কেট পরিস্থিতির উন্নতির সাথে সাথে লক্ষ্য করা যাচ্ছে যে, মৌল্ভিত্তিসম্পন্ন নহে এমন অনেক কোম্পানীর দাম তরতর করে বেড়ে চলছে যার ফলশ্রুতিতে সেসব কোম্পানীর প্রাইস আর্ণিংস (পিই) রেশিও অনেক বেড়ে গেছে। সে অবস্থা বিনিয়োগকারী তথা মার্কেটের জন্য ক্রমেই বিপদজনক হয়ে পড়ছে।
পিই রেশিও কিঃ কোন শেয়ারের বাজার মূল্যকে শেয়ারপ্রতি আয় দিয়ে ভাগ করলে যে সংখ্যা পাওয়া যায় সেটাই পিই রেশিও। যে কোন কোম্পানীর শেয়ারপ্রতি আয়ের তুলনায় ঐ শেয়ারটির দাম কতগুণ তা বুঝাতে প্রাইস-আর্নিংস বা পিই রেশিও ব্যবহার করা হয়। মার্কেটে সার্বিক মূল্যসূচকের তুলনায় কোন শেয়ার অতি মূল্যায়িত (ওভারভ্যালুড) না অবমূল্যায়িত (আন্ডারভ্যালুড) তা ঐ কোম্পানীর পিই রেশিও দ্বারা বুঝা যায়। যদি তা ডিএসই ইন্ডেক্স বা কোম্পানী যে খাতের আওতাধীন সেই খাতের গড় পিই এর তুলনায় বেশী হয় তবে তা ওভারভ্যালুড এবং কম হলে আন্ডারভ্যালুড। তাই শেয়ার ভ্যালুয়েশনের ক্ষেত্রে পিই রেশিওকে সারা দুনিয়াতেই একটি কার্যকরী অস্ত্র হিসাবে গণ্য করা হয়ে থাকে।
পিই রেশিও ও মার্কেট বাস্তবতাঃ বাংলাদেশের কোম্পানীগুলোকে মোটামুটি গ্রোথ স্টক এবং ভ্যালু স্টক এরুপ দু’ভাবে ভাগ করা যায়। ভ্যালু স্টক এর তুলনায় গ্রোথ স্টকের পিই রেশিও একটু বেশী হতে পারে। গ্রোথ কোম্পানীর পিই তুলনামূলকভাবে বেশী থাকার কারণ হচ্ছে কোম্পানী শুরুর প্রথমদিকে আর্নিংস কম থাকে এবং কোম্পানী যেহেতু দ্রুত বর্ধনশীল সেহেতু আশা করা হয় যে আগামীতে ইপিএস বাড়লে পিই কমে আসবে। তবে ইপিএস বৃদ্ধিরও একটা যৌক্তিক সীমা থাকা সংগত ।
সাধারনভাবে বলা হয়ে থাকে যে পিই রেশিও ২০ এর বেশী হলেই শেয়ারটির দাম তুলনামূলকভাবে বেশী ও ঝুঁকিপূর্ণ। বাস্তবে বাংলাদেশের শেয়ার মার্কেট কি সেটা আদৌ অনুসরণ করা হয়? অনেক কোম্পানীর পিই রেশিও আকাশচূম্বী। আবার এক এক খাতের পিই রেশিও এক এক রকম। যেমন ২০১৮-১৯ অর্থবছরে মিউচুয়াল ফান্ড খাতের পিই রেশিও ছিল ৭ দশমিক ৩, যেখানে ব্যাংকের পিই ছিল ৮ দশমিক ২৬, সিরামিক এর ২৩ দশমিক ৯৫, জুট এর ৩০ দশমিক ৫। আবার একই খাতের বিভিন্ন কোম্পানীর মধ্যে পিই রেশিওর মধ্যে আকাশ পাতাল পার্থক্য।
যেমন ফার্মাসিউটিক্যাল খাতের অন্তর্ভূক্ত স্কয়ার ফার্মার ২৭ আগষ্ট ২০২০ তারিখে পিই ছিল ১৩ দশমিক ৫ এবং সিলকো ফার্মার ১১ দশমিক ৪৫। পক্ষান্তরে ঐদিন একই খাতের বিকন ফার্মার পিই ছিল ১৫২ দশমিক ৫৫ এবং সেন্ট্রাল ফার্মার ২৭ দশমিক ৭১।
অন্যান্য খাতেও পিই বিবেচনায় বৈষম্যমূলক অবস্থা মোটামুটি একই রকম। যেমন, ইঞ্জিনিয়ারিং খাতের কোম্পানী কেএন্ডকিউ এর পিই ২৫৪ দশমিক ২৭, রেনউইক যগেস্বর এর ৩৫২ দশমিক ৮৫, মন্নু স্টাফলার এর ৩৩৩ দশমিক ৩৯; আবার আরএসআরএম স্টিলের মাত্র ৪ দশমিক ৯৫। কেন এমন অস্বাভাবিক তারতম্য? লক্ষ্যণীয় যে যেসব কোম্পানীর পিই রেশিও অস্বাভাবিকভাবে বেশী তাদের বেশিরভাগই অত্যন্ত দূর্বল মৌল্ভত্তিসম্পন্ন কোম্পানী। তুলনামূলক ভাল মৌলভিত্তিসম্পন্ন কোম্পানীর তুলনায় আপাতঃদৃষ্টিতে দূর্বল কোম্পানীর পিই কেন এত বেশী? সে প্রশ্নের উত্তরই বলে দেয় যে বাংলাদেশের শেয়ার মার্কেট চলে আবেগের উপর- অর্থনৈতিক যুক্তির ভিত্তিতে নয়। এখানে স্বল্পমূলধনী কোম্পানী হলেই তথাকথিত সিন্ডিকেটের পক্ষে সুবিধা হয় বাজার ম্যানিপুলেশন করতে। তারা তখন ক্রয় চাপ বাড়িয়ে শেয়ারদাম অনেক উপরে তুলতে সক্ষম হয়- তারপর সুযোগ বুঝে নিজেদের শেয়ার উচ্চমূল্যে বিক্রি করে সটকে পড়তে সক্ষম হয়।
বাংলাদেশের শেয়ার মার্কেট এক আজব জায়গা। দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের চিত্রের সাথে শেয়ার মার্কেট চিত্রের কোন মিল নেই; অনেকক্ষেত্রে তা বিপরীতধর্মী। মার্কেটের গভীরতা যথেষ্ট কম। ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীগন মার্কেটে আসে রাতারাতি ধনী হবার প্রত্যাশায়। রেগুলেটরী সংস্থাগুলোর দক্ষতাও অনেক কম। সব মিলিয়ে অবস্থা এমন যে কোন কোম্পানীর যে মূল্য থাকার কথা বাস্তবে তা নেই। মার্কেটে কিছু কোম্পানীর শেয়ার নিয়ে প্রতিনিয়ত কারসাজি হয়। সাধারন বিনিয়োগকারীদের অধিকাংশই মার্কেটে আসে ডিভিডেন্ড পাওয়ার প্রত্যাশা নিয়ে নয় বরং ক্যাপিটাল এপ্রিসিয়েশনের আশায়। কিছু স্বল্পমূলধনী কোম্পানী যার মৌলভিত্তি নেই তার শেয়ারে দেখা যায় ব্যাপক আগ্রহ। স্বল্পমূল্ধনী কোম্পানীর শেয়ারসংখ্যা কম থাকায় বিশেষভাবে কিছু গোষ্ঠী বা সিন্ডিকেট তাকে টার্গেট করে এবং কৃত্রিমভাবে শেয়ার দাম বাড়াতে থাকে। তখন প্রাইস বাড়ে কিন্ত আর্নিংস তো আর বাড়ে না। ফলে সংগত কারণেই সে কোম্পানীর পিই রেশিও অনেক বেড়ে যায়।
কোম্পানী ম্যানেজমেন্টের ডিভিডেন্ড পলিসিও পিই রেশিওকে বিশেষভাবে প্রভাবিত করে থাকে। কোন কোন কোম্পানী শুধুই স্টক ডিভিডেন্ড দেয়, কিছু কোম্পানী সবসময় ক্যাশ ডিভিডেন্ড দেয়, আবার কিছু কোম্পানী ক্যাশ ও স্টক ডিভিডেন্ড একসাথে দেয়। স্টক ডিভিডেন্ড দিলে শেয়ার সংখ্যা বেড়ে যায় যার ফলে পরবর্তীতে ইপিএস ধরে রাখাটা চ্যালেঞ্জিং হয়ে পড়ে। আর ইপিএস কমে গেলে পিই রেশিও বেড়ে যায়।
পুঁজিবাজারের সব খবর পেতে জয়েন করুন
ক্যাপিটাল নিউজ–ক্যাপিটাল ভিউজ–স্টক নিউজ
পিই রেশিও’র সীমাবদ্ধতাঃ পিই রেশিও দিয়ে শেয়ারমূল্য ভ্যালুয়েশনের সবচেয়ে বড় অসুবিধা হলো আর্নিংস বা ইপিএস সর্বদা স্থির না থাকা। কোন কোম্পানীরই ইপিএস প্রতি বছর এক থাকে না; এমনকি ট্রেন্ড এক থাকলেও তা বছর বছর যথেষ্ট উঠানামা করতে পারে। পিই রেশিওর আর একটি অসুবিধা হলো সেক্টরভিত্তিক পিই রেশিও একরকম নয়; বরং নানা সেক্টরের মধ্যে পিই রেশিও’তে যথেষ্ট গ্যাপ থাকে এবং সময়ের সাথে সাথে সেই অনুপাতও বদলায়। তাই শুধুমাত্র পিই রেশিও দ্বারা ভিন্ন সেক্টরের দু’টি কোম্পানীর মধ্যে তুলনা নির্ভরযোগ্য হতে পারে না। সে কারণেই পিই রেশিওর পরিবর্তে পিইজি (PEG) বা প্রাইস আর্নিংস গ্রোথ রেশিওকে অনেক বেশী নির্ভরযোগ্য মনে করা হয়।
পিইজি রেশিওঃ এটি পিই রেশিওর সাথে কোম্পানীর আর্নিংস বা ইপিএস প্রবৃদ্ধিকে তুলনা করে থাকে। পিই রেশিওকে ইপিএস প্রবৃদ্ধির হার দিয়ে ভাগ করলে পিইজি পাওয়া যায়। কোন কোম্পানীর পিই রেশিও ২০ হলে এবং ঐ কোম্পানীর ইপিএস প্রবৃদ্ধি ২০% হলে তার পিইজি রেশিও হবে ১। পিইজি রেশিও ১ এর কম হলে সে কোম্পানীকে আন্ডারভ্যালুড ধরা হয়, আর ১ এর বেশী হলে তা ওভারভ্যালুড বিবেচনা করা হয়। পিইজি রেশিও ১ দশমিক ৫ এর বেশী হলে সে কোম্পানী ঝুঁকিপূর্ণ বলে বিবেচিত হয়। আর পিইজি দশমিক ৫ থেকে ১ এর মধ্যে হলে সে কোম্পানীতে বিনিয়োগ উত্তম বিবেচিত হয়ে থাকে। পিইজি রেশিওর সুবিধা হলো যে এটি দিয়ে বেঞ্চমার্ক ইন্ডেক্সের সাথে কিংবা সেক্টর নির্বিশেষে যে কোন কোম্পানীর মধ্যে তুলনা করা সম্ভবপর। সেক্টরভিত্তিক ভিন্ন ভিন্ন পিই রেশিও থাকলেও পিইজি রেশিও দিয়ে ভিন্ন সেক্টরের মধ্যকার দু’টি কোম্পানীর মধ্যে তুলনা করা চলে এবং তা নির্ভরযোগ্য বিবেচিত হয়।
কিভাবে পিইজি পাবেনঃ ডিএসই ওয়েবসাইটে যেয়ে যে কোন কোম্পানীর টিকার বা নামের উপর ক্লিক করলে যে পেইজ আসে তাতে ঐ কোম্পানীর পিই রেশিও এবং বিগত ৪-৫ বছরের ইপিএস উল্লেখ থাকে। সেই ইপিএস থেকে বার্ষিক প্রবৃদ্ধি ক্যালকুলেট করে নিয়ে তা দিয়ে সর্বশেষ নিরীক্ষিত হিসাবের ভিত্তিতে প্রদত্ত পিই রেশিওকে ভাগ করে যে কেউ সহজেই কোম্পানীর পিইজি রেশিও বের করতে পারবেন।
পরিশেষে বলতে চাই যে বাংলাদেশের শেয়ার মার্কেটে অধিক পিই বিশিষ্ট দূর্বল কোম্পানীর শেয়ারে বিনিয়োগ করে অতীতে ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীগণের বড় অংশ পুঁজি হারিয়েছেন। অতীতের তুলনায় বর্তমান সময়ের বিনিয়োগকারীগণ অনেক বেশী সচেতন বলেই আমার বিশ্বাস। তাই তাঁদের উচিত হবে যথেষ্ট জেনে বুঝে সচেতনতার সাথে বিনিয়োগ করা। আর সে সচেতনতার প্রভাবেই তাঁরা অতি উচ্চ পিই রেশিওবিশিষ্ট কোম্পানী থেকে মুখ ফিরিয়ে নিবেন আর যেসব কোম্পানীর পিইজি রেশিও ১ এর কাছাকাছি রয়েছে সেখানেই বিনিয়োগ করবেন বলে আশা করি। সেরুপ স্ট্র্যাটেজীই বিনিয়োগ সুরক্ষা দিতে এবং অতি তীব্র প্রতিযোগিতামূলক শেয়ার মার্কেটে ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের টিকে থাকতে সহায়তা করতে পারে।
লেখক:শফিকুল ইসলাম
অতিরিক্ত সচিব (পিআরএল)
Email: msislam201386@gmail.com