একটি প্রস্তাবনা
স্টক মার্কেটে সিলিং প্রাইস আরোপ করা প্রয়োজন
:: আপডেট: ২০২০-০৯-১৪ ০৮:৪৪:৫৮
বাংলাদেশের শেয়ার বাজারে এখন নাটকীয় পূন্রুথান ঘটে চলছে। মাত্র ক’দিন আগেও বিনিয়োগকারী, ব্রোকার হাউজ, মার্চেন্ট ব্যাংক এবং এমনকি রেগুলেটরী সংস্থাগুলো পর্যন্ত সকল অংশীজনেরা ছিল চরমভাবে হতাশ। দীর্ঘদিন ধরে বাজার মন্দা থাকার কারণে ছিল সে হতাশা। কিন্ত জুলাইয়ের মাঝামাঝি সময় থেকে বাজারে উলটো হাওয়া বইতে শুরু করে। সূচক ক্রমাগতভাবে লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে। বিগত ১২ জুলাই ২০২০ তারিখে ডিএসইএক্স ইন্ডেক্স যেখানে ছিল মাত্র ৪০৯৯ এর কাছে, সেটা দুই মাসের মধ্যে গত ১৩ সেপ্টেম্বর ২০২০ তারিখে বেড়ে দাঁড়ায় ৫০৯৪ এর উপরে অর্থাৎ ১০০০ পয়েন্টের কাছাকাছি সূচক বেড়েছে। প্রায় প্রতিদিনই সেটা বাড়ছে এবং বিগত ২ দিনে বিশেষভাবে বেড়েছে। প্রতিদিনই বাজারে নতুন বিনিয়োগকারী ঢুকছে এবং নিস্ক্রিয়রা সক্রিয় হচ্ছে। দীর্ঘদিন পরে ডিএসইতে ধারাবাহিকভাবে দৈনিক এক হাজার কোটি টাকার উপরে লেনদেন হচ্ছে। তার প্রভাবে যারা পূর্বে শেয়ার কিনে লোকসানে ছিল তাদের অনেকেই লাভের মুখ দেখছে। এটি নিশ্চয়ই সুখবর। কিন্ত যে ধরনের কোম্পানীর মূল্যবৃদ্ধি অস্বাভাবিকভাবে বেশি ঘটছে সেটাই মার্কে্টের টেকসই হওয়া সম্পর্কে দুশ্চিন্তা ও আশংকার কারণ। মৌল্ভিত্তিসম্পন্ন শেয়ারের চেয়ে দূর্বল কোম্পানীর এবং বিশেষতঃ স্বল্পমূলধনী লোকসানী কোম্পানীর শেয়ারদর অনেক বেশী হারে বাড়ছে।
পুঁজিবাজারের সব খবর পেতে জয়েন করুন
ক্যাপিটাল নিউজ–ক্যাপিটাল ভিউজ–স্টক নিউজ
বিগত দুই মাসে মার্কেট সূচক এবং কতিপয় কোম্পানীর দাম বৃদ্ধির চিত্র নীচের টেবিলে দেখা যায়। এর মাধ্যমে মার্কেট ট্রেন্ড এবং বিশেষতঃ বিভিন্ন ক্যাটাগরীর দাম্ বৃদ্ধির প্রকৃতি সম্পর্কে ধারনালাভ করা যেতে পারে।
অন্য কিছু ক্রাইটেরিয়া দিয়েও সার্বিক বাজার পরিস্থিতি কেমন তা যাচাই করা যেতে পারে। প্রাইস-আর্ণিংস (পি-ই) রেশিও দিয়ে শেয়ারের বর্তমান দাম এবং কোম্পানীর আয়ের অনুপাত বুঝা যায়। এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ইন্ডিকেটর এবং তা যুক্তিসংগত সীমার মধ্যে থাকা বাঞ্চনীয়। কোন কোম্পানীর আর্নিংস খুব ভাল হওয়া সত্বেও বাজারে সে কোম্পানীর শেয়ারদর অত্যধিক হলে প্রাপ্ত ল্ভ্যাংশের হার বা ডিভিডেন্ড ইল্ড কম হবে। এই রেশিও যত হবে বেশী হবে বিনিয়োগ তত বেশী ঝুঁকিপূর্ণ হবে। সাধারনভাবে বলা যায় যে পি-ই যত হবে তত টাকার বিনিময়ে ১টি শেয়ার ক্রয় করে বছরশেষে ১ টাকা ফেরত পাওয়া যাবে। উদাহরনস্বরুপ এটি ২০ হলে ২০ টাকার বিনিময়ে বছরশেষে ঐ কোম্পানীর শেয়ারপ্রতি আয় ১ টাকা আশা করা যায়। আবার অন্যভাবেও বলা যায়- কোম্পানীর আয় বর্তমান হারে অব্যাহত থাকলে আজ যে দামে শেয়ারটি কেনা হলো তা ফেরত পেতে ২০ বছর সময় লাগবে। এক্ষেত্রে ধরে নেয়া হয় যে কোম্পানীর আয় ভবিষ্যতেও একই থাকবে। ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে যেখানে ২০১৯- ২০২০ অর্থবছরে গড় প্রাইস-আর্ণিং রেশিও (পি-ই) ছিল মাত্র ৯ এর মত, সেখানে বিগত ১৩ সেপ্টেম্বর ২০২০ তারিখে অন্তত ১৭টি কোম্পানীর সর্বশেষ অডিটেড হিসাব মোতাবেক পি-ই রেশিও রয়েছে ১০০ এর উপরে। ডিএসই ওয়েবসাইটের তথ্য মোতাবেক গত ১৩ সেপ্টেম্বর ২০২০ তারিখে সিভিওপিআরএল এর পি-ই রেশিও ১০৭০, সমতা লেদারের ৪২৯.৬৪, রেইনউইক যগেশ্বর এর ৩৩৫.৮২, মন্নু স্টাফলার এর ৩৩২.৪৮ এবং কেএন্ডকিউ এর ২৮৩.৬। আর যেসব কোম্পানী লোকসানে রয়েছে তাদের আয় নেই বিধায় পি-ই রেশিও হিসাবের সু্যোগই নেই।
খুব স্পষ্টভাবে বুঝা যাচ্ছে যে বিনিয়োগকারীদের সবচেয়ে পছন্দের শেয়ার তালিকার উপরের দিকে এমন সব কোম্পানী যাদের ইপিএস হয় নেগেটিভ অর্থাৎ কোম্পানী লোকসানে রয়েছে কিংবা আয় হলেও তা যতসামান্য। ফলে তারা বিনিয়োগকারীদেরকে কোন লভ্যাংশ প্রদান করতে সক্ষম নহে। তাই সে ধরনের কোম্পানীর দাম এমন অস্বাভাবিকভাবে বাড়ার সুযোগ দিলে তা কোনক্রমেই মার্কেটকে টেকসই তথা সাস্টেইনেবল করতে সহায়তা করবে না। এরুপ অবস্থা চলতে থাকলে মার্কেট ক্রাস করতে বেশী সময় লাগবে না বলে অনেকেই আশংকা ব্যক্ত করতে শুরু করেছেন।
মৌলভিত্তিক কোম্পানীর অস্বাভাবিক মূল্য বৃদ্ধির বর্তমান যে ট্রেন্ড তা চলতে দিলে মার্কেট পতন হওয়া সময়ের ব্যাপার মাত্র। এরুপ হয়েছিল ১৯৯৬ এবং ২০১০ সনে। বর্তমান ট্রেন্ড চলমান থাকলে ২০২০ সালেও তার পুনরাবৃত্তির আশংকা উড়িয়ে দেয়া যাচ্ছে না। আর দূর্ভাগ্যক্রমে যদি সেটা ঘটে তবে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্থ হবেন তুলনামূলকভাবে অনভিজ্ঞ ও স্বল্প পুঁজির সাধারন বিনিয়োগকারীগণ। কারণ, সেসব ব্যক্তি দাম বৃদ্ধির পর বাজারে আসে এবং যথাসময়ে এক্সিট সম্পর্কে তাদের ধারনা কম থাকে। সেরুপ কোন পতনে পুঁজি হারালে মানুষ আবার শেয়ার বাজারবিমূখ হয়ে পড়বে। সেটা ক্যাপিটাল মার্কেট উন্নয়নের পথে হবে বড় ধরণের প্রতিবন্ধক। এমনকি সার্বিকভাবে মার্কেটের উর্ধগতির সময়েও জাংক শেয়ারে বিনিয়োগ করে পুঁজি হারিয়ে যেতে পারে। উদাহরণ হিসাবে বলা যায় যে বিগত ৯ সেপ্টেম্বর তারিখে ২১৭ টাকার কাছাকাছি দরে যারা জিল বাংলার শেয়ার কিনেছিল বা ৩ সেপ্টেম্বরে যারা ৩৪৮ টাকার কাছাকাছি দরে সাভার রিফ্রাক্টরীজের শেয়ার কিনেছিল তাঁরা ইতিমধ্যে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ লোকসানের স্বীকার হয়েছেন।
বাংলাদেশের শেয়ার মার্কেটে নানা ধরনের অদক্ষতা ও সীমাবদ্ধতা বিদ্যমান। এখানে একাধিক সিন্ডিকেট নিজেদের মধ্যে যোগসাজসে কোন শেয়ারকে টার্গেট করে তার দাম অনেক উপরে তুলে। সাধারন বিনিয়োগকারীদের অসচেতনতার সুযোগে মৌলত্তিসম্পন্ন শেয়ারের চেয়ে দূর্বল আর্থিক ভিত্তিসম্পন্ন কিন্ত স্বল্পমূল্ধনী কোম্পানীর দাম বেশী বাড়ানো হয়। তারপর ক্রমাগতভাবে দাম বাড়তে দেখে সাধারন বিনিয়োগকারীরা সেসব শেয়ার ক্রয় শুরু করে যাতে শেয়ারটির দাম আরও বাড়ে। এভাবে বেড়ে যখন তা তুংগে উঠে তখন আসল খেলোয়াড়েরা নিজেদের শেয়ার অতি উচ্চ দামে বিক্রি করে এমনভাবে সটকে পড়ে যখন শেয়ারটি ক্রয়ের কোন লোক পাওয়া যায় না। তখন কাগজসর্বস্ব সেসব শেয়ার হাতে নিয়ে হায় হায় করা ছাড়া অন্য কোন বিকল্প থাকে না সাধারন ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের।
বর্তমান প্রেক্ষাপটে শেয়ার বাজারের সম্ভাব্য পতন থেকে রক্ষা করতে সিকিউরিটিজ এক্সচেঞ্জ কমিশনের বিরাট দায়িত্ব রয়েছে। বিগত মার্চ ২০২০ সময়ে দেশে করোনা প্রাদুর্ভাবের শুরুতে সূচকের ফ্রি ফল প্রতিরোধে বিএসইসি যুগান্তকারী পদক্ষেপ হিসাবে যেমন ফ্লোর প্রাইস ব্যবস্থা প্রবর্তনের মাধ্যমে মার্কেট টিকিয়ে রেখেছিল ঠিক তেমনিভাবে জাংক শেয়ারের অবাস্তব দাম বৃদ্ধি ঠেকাতে প্রয়োজনীয় পলিসি গ্রহণ করার চিন্তা করা যেতে পারে। সেটা ফ্লোর প্রাইসের সম্পূর্ণ বিপরীত এক ব্যবস্থা। নির্ধারিত ফ্লোর প্রাইসের নীচে কোন কোম্পানীর শেয়ার ট্রেড হওয়ার যেমন সুযোগ নেই, তেমনিভাবে বিএসইসি নির্ধারিত সিলিং প্রাইসের উপরে শেয়ার ট্রেডের সুযোগ থাকবে না মর্মে বিধান করা যায়। এটি হতে পারে প্রাইস-আর্ণিংস (পি-ই) রেশিও এর ভিত্তিতে। সেক্ষেত্রে নির্ধারিত পি-ই রেশিও’র উপরে ট্রেড করা যাবে না। আর যেসব কোম্পানীর আর্ণিংস বা আয় ঋণাত্বক তাদের ক্ষেত্রে বিগত ৫ বছরের গড় ইপিএস’কে বিবেচনায় নিয়ে সে অনুসারে সিলিং প্রাইস নির্ধারণ করে দেয়া যায়। বিগত ৫ বছরে আয় নেগেটিভ হলে কোম্পানীর নীট এ্যাসেট ভ্যালু (এনএভি) বিবেচনায় নিয়ে বিএসইসি সিলিং প্রাইস ঠিক করে দিতে পারে। ধরা যাক, কোন কোম্পানীর শেয়ার মূল্য তার পি-ই রেশিও ৫০ এর বেশী হতে পারবে না মর্মে সিদ্ধান্ত নেয়া হলো। এখন কোন কোম্পানীর বার্ষিক ইপিএস যদি ১ টাকা হয় তবে কোম্পানীটির শেয়ারমূল্য সর্বোচ্চ ৫০ টাকা পর্যন্ত উঠতে পারবে। যদি পরবর্তীতে কোম্পানীটির আয় ১ টাকা থেকে বেড়ে ২ টাকা হয় তবে তার শেয়ারদামও ১০০ টাকা পর্যন্ত হতে পারবে। এরুপ ব্যবস্থা স্থায়ীভাবে প্রচলন করা হলে তথাকথিত সিন্ডিকেট বা জুয়াড়ীরা আর তেমন সুবিধা করতে পারবে না। এতে করে মৌল্ভিত্তির শেয়ারের চাহিদা বাড়বে। কোয়ার্টারলি ফাইনান্সিয়াল স্টেট্মেন্ট যেহেতু আনঅডিটেড এবং সে কারণেই নির্ভরযোগ্য নয় সেহেতু সেটি বিবেচনায় না নিয়ে বিগত বছরের বার্ষিক রিপোর্টের ইপিএসকে আর্ণিংস ধরা যেতে পারে। প্রয়োজনে সে সংক্রান্ত বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহনের আগে চুলচেরা বিশ্লেষণের লক্ষ্যে একটি ওয়ার্কসপ আয়োজন করে বিএসইসি সকল সংশ্লিষ্ট স্টেকহোল্ডারদের মতামত নিতে পারে।
উপরের প্রস্তাবিত সিলিং প্রাইস আরোপ ধারনার বিষয়ে অনেকেই আপত্তি জানাতে পারে। তারা হয়তো যুক্তি দেখাবে যে মার্কেটকে স্বাধীনভাবে চলতে দেয়া উচিত কিংবা অন্যান্য দেশে তো এরুপ ব্যবস্থা নেই। পাল্টা যুক্তি হিসাবে বলা যায় যে অন্যান্য দেশে তো ফ্লোর প্রাইস ব্যবস্থাও নেই। আসলে আমাদের দেশের বাস্তবতা অনেক দেশ থেকেই যথেষ্ট ভিন্ন। আমাদের শেয়ার মার্কেট লিডারদের উপর সাধারন বিনিয়োগকারীদের যেরুপ আস্থাহীনতা রয়েছে তা সম্ভবত অন্য কোথাও নেই। এরুপ চরম আস্থাহীনতার কারণ কি? সে প্রশ্নের উত্তরও বোধ করি কঠিন নয়। যেদেশে বছরের পর বছর ধরে নানা কায়দায় ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদেরকে লোভের জালে ফেলা হয়, যেদেশে অনেক যুবক যখন আত্মীয় স্বজনের কাছ থেকে ধার নিয়ে শেয়ার ব্যবসা করতে এসে পুঁজি হারিয়ে আত্মহত্যার পথ বেছে নিতে বাধ্য হয়, যেদেশে একপ্রকার সিন্ডিকেটের নীলনকশায় কাগজ সর্বস্ব লোকসানী কোম্পানীর শেয়ার দাম আকাশচূড়ায় নিয়ে তারপর হঠাৎ নীচে ফেলে দেয়া হয় সেদেশে মার্কেট সিষ্টেমের উপর সাধারন বিনিয়োগকারীরা কতক্ষণ আস্থা ধরে রাখতে পারে! যখন মৌল্ভিত্তিসম্পন্ন কোম্পানীর শেয়ারের কদর নেই অথচ বছরের পর বছর কোন ল্ভ্যাংশ দেয় না বা লোকসান হয় এরুপ স্বল্পমূল্ধনবিশিষ্ট কোম্পানীর দাম আকাশচূম্বী থাকে তখন আখেরে আস্থাহীনতা তৈরী হবেই।
সে প্রেক্ষাপটে বিএসইসি’কেই প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে যাতে শেয়ার মার্কেট নিকট ভবিষ্যতে ক্রাশ না করে। বর্তমান চেয়ারম্যান মহোদয়ের নেতৃত্বে বিএসইসি ইতিমধ্যে যেসব পদক্ষেপ নিয়েছে তা যথেষ্ট প্রশ্ংসিত হয়েছে এবং সে কারণেই দীর্ঘদিন পর মার্কেট ঘুরে দাড়িয়েছে। এখন কোন কারণে বিদ্যমান উর্ধ্বমূখী মার্কেট ট্রেন্ড হঠাৎ ইউটার্ণ নিলে তা পর্যবসিত হবে বিএসইসির ব্যর্থতা হিসাবে যা কারোই কাম্য নহে। তাই সময় থাকতেই প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ অত্যাবশ্যকীয়। সেরুপ পদক্ষেপের অংশ হিসাবেই সিলিং প্রাইস আরোপের প্রস্তাব করা হলো যা বিএসইসি ভেবে দেখতে পারে।
লেখকের আরও লিখা পড়তে
পিই নয়; বরং পিইজি দেখে শেয়ার কিনুন
শেয়ারে ঝুঁকি কমানোর উপায়:শফিকুল ইসলাম
বাজার ট্রেন্ড দেখে শেয়ার পোর্টফোলিও সাজান
শেয়ার মার্কেটে স্টপ-লস ট্রেডিং স্ট্র্যাটেজীর প্রয়োগ
ফুয়েল এন্ড পাওয়ার সেক্টরে শেয়ার বাছাই
লেখক:শফিকুল ইসলাম
অতিরিক্ত সচিব (পিআরএল)
Email: msislam201386@gmail.com