অনুপম চরিত্রের অধিকারী রাসূল মুহাম্মদ সা.

সান বিডি ডেস্ক প্রকাশ: ২০২০-০৯-৩০ ২২:১০:৪০


মুহাম্মদ জাফর উল্লাহ্

বিশ্বমানবতার অনুসরণযোগ্য অনুপম চরিত্রের অধিকারী ছিলেন মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা)। আল্লাহ প্রেরিত পুরুষদের মধ্যে তিনি ছিলেন সর্বশ্রেষ্ঠ। তিনি ছিলেন সর্বশেষ নবী। তাঁর আগমনের মধ্য দিয়ে মানবজাতিকে সত্যপথ প্রদর্শনের উদ্দেশ্যে আল্লাহ্ কর্তৃক নবী প্রেরণ সমাপ্ত হয়। চারিত্রিক মাধুর্যে তিনি ছিলেন অতুলনীয়। প্রখ্যাত ইউরোপীয় চিন্তাবিদ কার্লাইল, ঐতিহাসিক এডওয়ার্ড গিবন, এইচ জি ওয়েলস মহানবী (সা)-এর উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেছেন। মানব চরিত্রের সকল প্রকার মহৎ গুণের অনন্য সমন্বয় ছিল মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা)-এর পবিত্র জীবনে।

পবিত্র কুরআনে আল্লাহ্ তাঁর সম্বন্ধে বলেন, “হে মুহাম্মদ! নিশ্চয়ই আপনি অনুপম চরিত্রের অধিকারী।” তাঁর নিষ্কলুষ চরিত্রে সকল প্রকার গুণ ও মহত্ত্বের ছাপ পরিস্ফুটিত হয়েছে। তার স্বভাবজাত সদাচার, কোমলতা, মহানুভবতা, কর্তব্যনিষ্ঠা, ন্যায়পরায়ণতা ও সহিষ্ণুতা ছিল সত্যিই বিস্ময়কর। তিনি ছিলেন একাধারে শিশুদের খেলার সাথী, স্নেহবৎসল পিতা, প্রেমময় স্বামী, বিশ^স্ত ব্যবসায়ী, রিক্তের বন্ধু, সত্যের দিশারি, ন্যায়পরায়ণ বিচারক, দক্ষ সমরকুশলী ও চিন্তাশীল দার্শনিক। বস্তুত তাঁর জীবনাদর্শ গোটা মানবকুলের জন্য আশীর্বাদস্বরূপ। রেনেসাঁর কবি ফররুখ আহমদ কত সুন্দরভাবেই না বলেছেন :

তুমি না আসিলে মধুভাণ্ডার ধরায় কখনো হ’ত না লুট,

তুমি না আসিলে নার্গিস কভু খুলতোনা তার পর্ণপুট,

বিচিত্র আশা-মুখর মাশুক খুলতোনা তার রুদ্ধ দিল;

দিনের প্রহরী দিত না সরায়ে আবছা আঁধার কালো নিখিল।

দেখেছি তোমার মানবতা চলে সাথে জনগণ বিপুল দেহ

ক্লেদাক্ত পথে ফোটায়ে মুকুল সাজালো তাদের ধরণী গেহ,

যে মরুতে জানি ফুল ফোটেনাকো, যেখানে ঊষর পৃথ্বীতল,

সেখানেও তুমি জাগালে শস্য, আনলে অঝোর ধারা বাদল।

আল্লাহর প্রতি অবিচলিত ঈমানের মূর্ত প্রতীক ছিলেন হজরত মুহাম্মদ (সা)। সুদৃঢ় ঈমানই ছিল তাঁর মহৎ চারিত্রিক গুণাবলির উৎস। তাঁর প্রতিটি কাজে আল্লাহর নির্দেশের প্রতিফলন ছিল। কুরাইশদের হাতে তিনি অশেষ যাতনা ভোগ করেছিলেন, লাঞ্ছিত হয়েছিলেন। প্রতিকূল পরিবেশের বিরুদ্ধে তাঁকে সর্বক্ষণ সংগ্রাম করতে হয়েছে। কিন্তু কখনো তিনি আল্লাহ্র নির্দেশিত সত্য পথ হতে বিচ্যুত হননি; বরং দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে বলেছিলেন, “তারা যদি আমার ডান হাতে সূর্য এবং বাম হাতে চন্দ্র এনেও দেয়, তথাপি মহাসত্যের সেবা ও স্বীয় কর্তব্য হতে বিন্দুমাত্র বিচ্যুত হব না।”

মহানবী (সা) সরল, সাধারণ এবং অনাড়ম্বর জীবনযাপন করতেন। স্বহস্তে তিনি গৃহের যাবতীয় কাজকর্ম, এমনকি দুগ্ধদোহন, ঘরবাড়ি পরিষ্কার, জুতা মেরামতও করতেন। তার বেশভূষায় আড়ম্বরতা প্রকাশ পায়নি।

অনুপম চরিত্রের অধিকারী রাসূল মুহাম্মদ সা. চরম বিপদের সম্মুখীন হয়েও মহানবী (সা) কোনদিন ধৈর্যহারা হননি বা আত্মবিশ্বাস হারাননি। তৌহিদের বাণীকে বিশ্বে সুপ্রতিষ্ঠিত করতে এবং সামাজিক ন্যায়বিচার সুনিশ্চিত করতে তিনি বিরোধী শক্তি দ্বারা বাধাপ্রাপ্ত হয়ে অমানুষিক যন্ত্রণা ভোগ করেছেন, লাঞ্ছিত হয়েছেন, এমনকি প্রাণনাশের ভীতিপ্রাপ্ত হয়েছেন। কিন্তু এতদসত্ত্বেও তিনি তাঁর দৃঢ়বিশ্বাস ও উৎসাহ-উদ্দীপনা হতে এতটুকুও-বিচ্যুত হননি। তিনি সর্বদাই বিপদগ্রস্ত মানুষের নৈতিক ও আধ্যাত্মিক চরিত্র সংশোধনের সাফল্য সম্পর্কে আশাবাদী ছিলেন। অন্য ধর্মের প্রতিও সহিষ্ণু ছিলেন তিনি। জোরপূর্বক কাউকেও তিনি স্বধর্মে দীক্ষিত করেননি।

নবুয়ত প্রাপ্তির বহু পূর্ব থেকেই মহানবী (সা) তাঁর সত্যবাদিতা ও বিশ্বস্ততার জন্য আরব সমাজে সুপরিচিত ছিলেন। সেই জাহেলিয়া যুগেও তিনি ছিলেন অন্যান্য আরববাসী থেকে একটি ব্যতিক্রম চরিত্র। তাঁর চারিত্রিক মাধুর্যে মুগ্ধ হয়ে আরবগণ তাঁকে ‘আল-আমিন’ উপাধিতে ভূষিত করেছিল। কাবাঘরে হাজরে আসওয়াদ বা কালোপাথর প্রতিস্থাপনকে কেন্দ্র করে বিবদমান বিভিন্ন গোত্রের মধ্যে যে ভয়াবহ পরিস্থিতির উদ্ভব হয়েছিল যুবক মুহাম্মদ (সা) শান্তিপূর্ণভাবে এবং সকলকে সন্তুষ্ট করে এর সমাধান করেছিলেন। এ ধরনের গোত্রীয় কলহ ও সামাজিক অরাজকতা দমনের উদ্দেশ্যে তিনি মক্কার নিঃস্বার্থ যুবকদের নিয়ে ‘হিলফুল-ফুজুল’ নামে শান্তিসংঘ গঠন করেছিলেন।

মদিনায় হিজরতের পরও তিনি ইহুদি ও পৌত্তলিকদের বহু বিবাদ-বিসংবাদের শান্তিপূর্ণ মীমাংসা করেন। রচনা করেন শান্তির সংবিধান মদিনা সনদ। তিনি জীবনে কোনোদিন প্রতারণা, প্রবঞ্চনা ও মিথ্যার আশ্রয় নেননি। হুদায়বিয়ার সন্ধির অঙ্গীকার রক্ষা করতে গিয়ে তিনি মক্কা হতে মদিনায় আগত মুসলমানদেরকে গ্রহণ করতে অস্বীকার করেছিলেন।

হযরত মুহাম্মদ (সা) আর্তের সেবায় নিজেকে উৎসর্গ করেন। তাঁর বদান্যতার অসংখ্য প্রমাণ পাওয়া যায়। বিপদে ধৈর্য, দয়া-দাক্ষিণ্য, অনুকম্পা তাঁর চরিত্রের ভূষণ ছিল। তিনি বলতেন, “আমি শাস্তি প্রদানের জন্য আবির্ভূত হইনি, শান্তির দূত হিসেবে এসেছি।” তিনি ছিলেন নম্র ও মিষ্টভাষী। তিনি কাউকে আঘাত দিয়ে কখনো কথা বলেননি। দাস-দাসীদের প্রতিও তিনি সদয় ব্যবহার করতেন।

হজরত মুহাম্মদ (সা) ছিলেন ক্ষমার মূর্ত প্রতীক। তাঁর সংস্পর্শে আগত শত্রু-মিত্র সকলেই তাঁর নম্র বিনয়ী ও অমায়িক ব্যবহারে বিমুগ্ধ হয়েছে। তিনি কোনো দিন রূঢ় আচরণ দ্বারা কাউকে মনঃকষ্ট দেননি। যুদ্ধবন্দীদের প্রতি ক্ষমা প্রদর্শন ও উদার ব্যবহার দ্বারা তিনি শত্রুর মন জয়ের যে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন তা তুলনাহীন। স্বীয় ঘাতককে তিনি ক্ষমা প্রদর্শনে দ্বিধা করেননি। মক্কা ও তায়েফ বিজয়ের সময় তিনি যে ক্ষমার আদর্শ প্রদর্শন করেন, তা পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল। ঐতিহাসিক উইলিয়াম মুইর এর মতে, “যে মক্কাবাসীরা এতদিন ধরে মুহাম্মদ (সা)কে ঘৃণাভরে পরিত্যাগ করেছিল তাদের প্রতি তাঁর এ উদার ব্যবহার সত্যই প্রশংসনীয়।” বিদায়হজ উপলক্ষে তিনি আরাফাত ময়দানে যে ভাষণ দিয়েছিলেন তা সর্বকালে সর্বদেশের জন্য একটি মানবিক সনদ হয়ে থাকবে। কৌলীন্য, দাসপ্রথা, নরহত্যা প্রভৃতি অসামাজিক প্রথার বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ করে তিনি সাম্য ও মৈত্রীর এক নবযুগের সূচনা করেন।

মহানবী (সা) সরল, সাধারণ এবং অনাড়ম্বর জীবনযাপন করতেন। স্বহস্তে তিনি গৃহের যাবতীয় কাজকর্ম, এমনকি দুগ্ধদোহন, ঘরবাড়ি পরিষ্কার, জুতা মেরামতও করতেন। তার বেশভূষায় আড়ম্বরতা প্রকাশ পায়নি। বস্তুতপক্ষে সাদাসিধে জীবনযাত্রার আদর্শ দ্বারা তিনি ধর্ম ও কর্ম এবং ইহলৌকিক ও পারলৌকিক জীবনধারার আদর্শ সমন্বয় সাধন করেন।

আরবের অধিবাসীরা যখন জুলুম ও অবিচারে নির্যাতিত-নিষ্পেষিত, তখন হজরত মুহাম্মদ (সা) দুনিয়ায় এসেছিলেন মজলুম মানুষের ত্রাণকর্তা হিসেবে। মাত্র বাইশ বছর সময়ের মধ্যে তিনি সভ্যতাবিবর্জিত, কুসংস্কারাচ্ছন্ন, পৌত্তলিক আরব জাতিকে এক সুসভ্য জাতিতে পরিণত করে তাদেরকে নৈতিক ও আত্মিক পতনের অন্ধকূপ হতে তৌহিদ, নীতিবোধ ও ন্যায়পরায়ণতার উচ্চতম স্তরে উন্নীত করেছিলেন। সকল গোত্রীয়-কলহ দূরীভূত করে গোটা আরব জাতিকে তিনি ঈমানভিত্তিক ঐক্যের বন্ধনে বেঁধেছিলেন। তাঁর দৃষ্টিতে ও তার প্রণীত আইনের কাছে আপন-পর, মুসলিম-অমুসলিম সকলেই ছিল সমান। মহানবী (সা) ছিলেন দরিদ্র, অসহায়, দুর্বল ও মজলুমের বন্ধু। তিনি মানুষের হাসি-কান্নার শরিক ছিলেন। শোকার্ত ও দুঃখপীড়িত মানুষকে তিনি আন্তরিক সমবেদনা প্রদর্শন করতেন। তাদের দুঃখ ভোগের সঙ্গী হতেন। অভাবের সময় তিনি ক্ষুধার্তকে নিজ খাদ্যের ভাগ প্রদান করতেন। প্রতিবেশী প্রত্যেকটি মানুষের ব্যক্তিগত সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য আন্তরিকভাবে কামনা করতেন। তিনি দাস-দাসী ও অধীন লোকদের প্রতি সর্বাধিক মানবিক আচরণ করতেন।

অনুপম চরিত্রের মূর্ত প্রতীক মহানবী (সা) কুসংস্কারাচ্ছন্ন, পাপাসক্ত ব্যভিচারে লিপ্ত আরবদের সত্যপথে পরিচালিত করে পৃথিবীর ইতিহাসে একটি সুসংবদ্ধ, দিগ্বিজয়ী জাতিতে পরিণত করেছিলেন। মূলত তাঁর জীবনাদর্শ সর্বদেশে, সর্বযুগে ও সর্বমানুষের নিকট গ্রহণযোগ্য। তাঁর সীমাহীন প্রতিভা শুধু আরবদের স্থানীয় কার্যাবলিতেই প্রতিফলিত হয়নি, বহির্বিশ্বে ও আন্তর্জাতিক সমস্যাদির ক্ষেত্রেও সমভাবে প্রযোজ্য। স্বীয় চরিত্রের মাধুর্য ও তুলনাহীন কীর্তি-কলাপের জন্য তিনি ছিলেন বিশ্বের অনন্ত কল্যাণ, মানবজাতির পরম আদর্শ ও স্রষ্টার শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি।

হজরত মুহাম্মদ (সা)-এর চরিত্রের ভূয়সী প্রশংসা করতে গিয়ে প্রফেসর ড. জোসেফ হেল বলেন, ‘মুহাম্মদ (সা) এমনই একজন মহাপুরুষ ছিলেন, যাঁকে না হলে বিশ্ব অসম্পূর্ণ থেকে যেত। তিনি নিজেই নিজের তুলনা। তাঁর কৃতিত্বময় ইতিহাস মানবজাতির ইতিহাসে এক সমুজ্জ্বল অধ্যায় রচনা করেছে।’

সানবিডি/এনজে/১০:১০/৩০.০৯.২০২০