যে কারণে প্রয়োজন উন্নত পুঁজিবাজার
:: আপডেট: ২০২০-১০-০৫ ০৮:০৪:৫৮
আমাদের মত দেশে স্টক মার্কেট তথা ক্যাপিটাল মার্কেট নিয়ে অনেকেই ভ্রূ কুঁচকায় এবং যারা শেয়ার ব্যবসা করে তাদেরকে ভাল চোখে দেখে না। অনেকেই এটিকে জুঁয়ার আড্ডার সাথে তুলনা করতেও দ্বিধা করে না। কিছু মানুষ আবার শেয়ার মার্কেটের আয় ইসলামী শরীয়তসম্মত কিনা সে ব্যাপারে সন্দেহ পোষণ করে থাকে। এক শ্রেণীর মানুষ ভাবে যে এ মার্কেটের মাধ্যমে একজনের টাকা অন্যজনের পকেটে যায়, যা কিনা দেশের বৃহত্তর উন্নয়নে কোন কাজে আসে না। অথচ তাঁরা সবাই বিভ্রান্তিতে আছেন।
উন্নয়নের সামগ্রিক প্রেক্ষাপট তাঁদের সামনে থাকে না বিধায় সংকীর্ণ দৃষ্টিভংগী দিয়ে সবকিছু দেখার ফলে সেরুপ বিভ্রান্তি তৈরী হয়ে থাকে। আসলে যে কোন দেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতির সাথে ক্যাপিটাল মার্কেটের উন্নয়ন সরাসরি জড়িত। উন্নয়নের জন্য প্রয়োজন হয় নানা সেক্টরে ব্যাপক পরিমাণ বিনিয়োগ, আর বিনিয়োগের জন্য মূল্ধন বা পুঁজি। সে পুঁজি নানাভাবে যোগাড় হতে পারে। তবে পুঁজির অন্যতম বড় যোগানদার হচ্ছে ক্যাপিটাল মার্কেট।
বন্ড মার্কেট, ডেরিভেটিভস মার্কেট আর শেয়ার মার্কেট মিলে হয় ক্যাপিটাল মার্কেট। ক্যাপিটাল মার্কেটের ব্যাপ্তি বাড়লে ব্যাংকিং সেক্টরের বাইরে একটি বিকল্প অর্থায়নের উৎস তৈরী হয়। সেরুপ উৎসের বিকাশ ঘটলে শিল্প উদ্যোক্তাদের পক্ষে প্রয়োজনীয় মূলধন সংগ্রহের জন্য শুধুমাত্র ব্যাংকের দিকে চেয়ে থাকতে হয় না। এতে করে একদিকে যেমন ব্যাংকের উপর চাপ কমে, অন্যদিকে শেয়ার মার্কেটে অর্থের যোগানদাতা অগনিত বিনিয়োগকারীগণ আর্থিকভাবে লাভবান হন এবং সেইসাথে দেশের শিল্পোন্নয়নে সম্পৃক্ত হওয়ার সুযোগ পান। আর শিল্পোন্নয়ন তো দরকার দেশের জনগনের কর্মসংস্থান ও আয় বৃদ্ধির মাধ্যমে নাগরিকদের জীবনযাত্রার মান বাড়ানোর লক্ষ্যে। ফলে সংগতভাবেই অসংখ্য গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে যে অর্থনৈতিক অগ্রগতি ও ক্যাপিটাল মার্কেটের উন্নয়ন প্রত্যক্ষভাবে সম্পৃক্ত। তাই বলা যায় যে অর্থনৈতিক উন্নয়নের স্বার্থেই দেশের ক্যাপিটাল মার্কেট তথা শেয়ার মার্কেটের প্রসার দরকার।
পৃথিবীর প্রায় সব উন্নত দেশে এবং অগ্রসর উন্নয়নশীল দেশগুলোতে ক্যাপিটাল মার্কেটের ট্রাঞ্জেকশন তথা অংশগ্রহণ মোট জিডিপি’র কয়েকগুন। সেদিক দিয়ে বাংলাদেশ অনেক পিছনে পড়ে আছে। এখানে কোন ডেরিভেটিভস মার্কেট এখন পর্যন্ত গড়ে ওঠেনি। বন্ড মার্কেট যেটা আছে তা না থাকার নামান্তর। কারণ সেখানে তেমন কোন লেনদেন হয় না। শেয়ার মার্কেট একটা আছে বটে এবং তার বয়সও কম নয় – প্রায় ৬৫ বছর। তদসত্বেও বলা যায় যে সময়ের অগ্রগতির সাথে শেয়ার মার্কেটের উন্নয়ন ঘটেনি। দেশের শেয়ার মার্কেট সম্পর্কে সাধারন মানুষের ধারণা অত্যন্ত নেতিবাচক।
বিভিন্ন দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে এক শ্রেণীর সিন্ডিকেট মার্কেটকে ম্যানিপুলেশনের উর্বর ক্ষেত্র বানিয়েছে। ফলে পুঁজি হারানোর ভয়ে এ মার্কেটে বিনিয়োগ করা থেকে অনেকেই বিরত থাকে। শেয়ার মার্কেট মানেই কতিপয় সিন্ডিকেট চক্রের কারসাজিতে কৃত্রিমভাবে কোন বিশেষ কোম্পানীর দাম বৃদ্ধি ও পতনের খেলা – সেরুপ ধারনা সাধারন নাগরিকদের বড় অংশের মধ্যে সংক্রমিত। অবশ্য তার কারণও আছে। ১৯৯৬ এবং ২০১০ সালে মার্কেট ক্রাশের ফলে অসংখ্য ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারী পথে বসেছিল। তারপর দীর্ঘ সময় শেয়ার মার্কেট পতনের বৃত্তে ঘুরাফেরা করার পর অবশেষে এ বছরের জুলাই মাসের শেষার্ধ থেকে আস্তে আস্তে ঘুরে দাড়াতে শুরু করেছে।
কিন্ত উদ্বেগের বিষয় হলো সে ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টাও ত্রূটিমূক্ত এবং যৌক্তিক ধারার ভিত্তিতে হচ্ছে না। দেখা যাচ্ছে যে নামসর্বস্ব, লোকসানী অথচ স্বল্প মূলধনী কোম্পানীগুলোর দাম যে হারে বাড়ছে মৌলিক ভিত্তিসম্পন্ন প্রতিষ্ঠিত কোম্পানীর দাম সে হারে মোটেই বাড়ছে না। সে কারণেই দেখা যাচ্ছে যে অনেক দিনেই ডিএসইএক্স (DSE-X ) ইন্ডেক্স হয়তো পজিটিভ হওয়া সত্বেও ডিএসই-৩০ (DSE-30) ইন্ডেক্স হচ্ছে নেগেটিভ। অথচ তার বিপরীত অবস্থা হতে তেমন দেখা যায় না।
উল্লেখ্য, ডিএসই-এক্স ইন্ডেক্স ভাল মন্দ ছোট-বড় নির্বিশেষে তালিকাভূক্ত সব কোম্পানীর এবং ডিএসই-৩০ ইন্ডেক্স শুধুমাত্র মৌল্ভিত্তিসম্পন্ন ৩০টি ব্ল-চিপ কোম্পানীর প্রতিনিধিত্ব করে থাকে। তাছাড়া, অনেক স্বল্প মূলধনী কোম্পানীর প্রাইস-আর্ণিংস রেশিও (পি-ই) ১০০ এর উপরে যেটা নিশ্চিতভাবেই প্রমাণ করে যে বাংলাদেশের শেয়ার বাজার অনেকটাই ম্যানিপুলেটেড। প্রশ্ন হলো সেরুপ ম্যানিপুলেশনের দায় কার! এটা কি রেগুলেটেরের ব্যর্থতা, সাধারন বিনিয়োগকারীদের অসচেতনতা, আইনের দুর্বলতা, সুশাসনের ঘাটতি, না অন্য কিছু? সে প্রশ্নের উত্তর একেকজন এক এক ভাবে দিবে এবং তা নির্ভর করবে উত্তরদাতার মানসিকতা ও অবস্থানের উপর। তবে বোধ করি উল্লেখিত কারণগুলোর সবগুলোই প্রকৃতপক্ষে সে অবস্থার জন্য কম-বেশী দায়ী।
পুঁজিবাজারের সব খবর পেতে জয়েন করুন
ক্যাপিটাল নিউজ–ক্যাপিটাল ভিউজ–স্টক নিউজ
বাংলাদেশের কাপিটাল তথা শেয়ার মার্কেট এর উন্নয়ন ও গভীরতার অভাবে দেশের সাধারন নাগরিকদের জীবনমানে তার প্রভাব কি পড়ছে সে বিষয়ে গবেষণা হওয়া প্রয়োজন। তবে ফরমাল গবেষণার ফলাফল ব্যতিরেকেই এটা অনুমাণ করা কঠিন নয় যে সমৃদ্ধ স্টক মার্কেটের অনুপস্থিতিতে সাধারন মানুষই সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে। এখন মানুষের বিকল্প আয়ের সু্যোগ রুদ্ধ হয়ে গেছে। কারণ বিদ্যমান ব্যবস্থায় ব্যাংকের ফিক্সড ডিপোজিটের বিপরীতে প্রাপ্ত সুদ বা আয় যা পাওয়া যায় তার চেয়ে প্রকৃত মূল্যস্ফীতির হার বেশী অর্থাৎ সেরুপ বিনিয়োগে নিজের মূল্ধনের আসল ক্রয় ক্ষমতাও ঠিক থাকছে না- লাভ তো দূরের কথা।
নানা সরকারী বাঁধার কারণে সঞ্চয়প্ত্রেও মানুষ বিনিয়োগ করতে পারছে না। বন্ড বা ডিবেঞ্চারে পর্যাপ্ত তারল্য তথা লিকুইডিটি না থাকার ফলে সেখানেও বিনিয়োগের তেমন সুযোগ নেই। কমোডিটি এক্সচেঞ্জ বা ডেরিভেটিভস মার্কেট তো এখনো গড়েই ওঠেনি। তাই শেয়ার মার্কেট হতে পারতো সাধারন মানুষের বাড়তি আয়ের ভাল একটি উৎস, যদি সে মার্কেটের প্রতি মানুষের আস্থা অর্জন করানো সম্ভব হতো। তালিকাভূক্ত হতে ইচ্ছুক কোম্পানীগুলোও পেতে পারতো ব্যাংক বহির্ভূত মূল্ধন পাওয়ার বিকল্প উৎস। বর্তমানে দেশে খেলাপী ঋণ বেড়ে যাবার কারণে ব্যাংকগুলোও নতুন ঋণ বিতরণে পূর্বের চেয়ে অনেক বেশী কঞ্জারভেটিভ অবস্থানে রয়েছে। এতে করে নতুন উদ্যোক্তারা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছেন। সে অবস্থা নিশ্চয়ই দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের দিক থেকে প্রত্যাশিত নয়। তাই বলা যায় যে শেয়ার মার্কেটের প্রত্যাশিত উন্নয়নের অভাবে নতুন উদ্যোক্তারাও সম্ভাব্য সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন।
উপরোক্ত কারণে অর্থনৈতিক অগ্রগতির স্বার্থেই দেশের স্টক মার্কেটের উন্নয়ন দরকার। সে উন্নয়ন করতে হলে বিদ্যমান ব্যবস্থায় যেসব দূর্বলতা রয়েছে তা চিহ্নিত করে সমাধানের পথে পদক্ষেপ নেয়া প্রয়োজন। শেয়ার ব্যবসা যে অনৈতিক বা খারাপ কিছু নয় সে ব্যাপারে রাষ্ট্রীয়ভাবে প্রচারণা চালানো, দেশব্যাপী ফাইনান্সিয়্যাল লিটারেসী ক্যাম্পেইন পরিচালনা করা, শেয়ার বাজারের তথাকথিত সিন্ডিকেটের দৌরাত্ব্য কমানোর লক্ষ্যে সার্ভেলেইন্স কার্যক্রম জোরদার করা, জেড ক্যাটাগরির শেয়ারের উচ্চদাম বৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণে প্রাইস সিলিং ব্যবস্থা আরোপ করা, তালিকাভূক্ত কোম্পানীর আর্থিক প্রতিবেদন অধিকতর বস্তুনিষ্ট ও বিশ্বাসযোগ্য করার পদক্ষেপ নেয়া, এনলিষ্টেড অডিট ফার্মসমূহের কার্যক্রম মনিটর করা, দেশে কর্মরত সকল মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানীকে পুঁজিবাজারে তালিকাভূক্তির লক্ষ্যে প্রণোদনা দেয়া সহ নানা ব্যবস্থা হতে পারে সে প্রচেষ্টার অংশ।
সর্বোপরি আইনের শাসন প্রতিষ্টিত করতে হবে। অনেক কোম্পানী বা কোম্পানীর পরিচালকেরা সিকিউরিটিজ আইন লংঘন করে প্রয়োজনীয় শেয়ার নিজের নামে রাখতে ব্যর্থ হয়, বছরের পর বছর এজিএম না করে কিংবা লভ্যাংশ না দিয়েও পরিচালক পদে বহাল তবিয়তে থাকেন- তা কোনক্রমেই হতে দেয়া উচিত নয়। তবে আশার কথা হচ্ছে যে, সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) এর বর্তমান দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাগণ সচেষ্ট হয়েছেন সেসব অনিয়ম ও অব্যবস্থাপনা পর্যায়ক্রমে দূর করতে এবং তার মাধ্যমে দেশের স্টক মার্কেটকে মজবুত ভিত্তির উপর দাঁড় করাতে। তাঁদের সে কর্মতৎপরতার কিছু কিছু সুফল ফলতে শুরু করেছে এবং মানুষ ক্রমশ্ঃ মার্কেট সম্বন্ধে আশাবাদী হয়ে উঠছেন। কিন্ত মার্কেটকে দীর্ঘমেয়াদে স্থায়ী বা সাসটেইনেবল করতে হলে আইনের শাসনের সুপ্রতিষ্টা এবং সেইসাথে মার্কেটের কাঠামোগত দূর্বলতাসমূহ চিহ্নিত করে সমস্যাসমূহের স্থায়ী প্রতিকার করার বিকল্প নেই। তা করা সম্ভব হলে আশা করা যায় যে আগামীতে দেশের শেয়ার মার্কেট উন্নয়ন ঘটবে এবং তার ফলে সাধারন মানুষের অর্থনৈতিক অবস্থানে ইপ্সিত পরিবর্তন আসবে। স্বাধীনতার মহান সুবর্ণ জয়ন্তীতে সেটাই দেশবাসীর প্রত্যাশা।
শফিকুল ইসলাম
অতিরিক্ত সচিব (পিআরএল)
Email: msislam201386@gmail.com