ভাল মিউচুয়াল ফান্ড চেনার কৌশল

:: আপডেট: ২০২০-১০-১৮ ১৭:৪৪:৫১


আমরা সবাই জানি যে শেয়ার মার্কেটে তালিকাভূক্ত কোম্পানীভিত্তিক খাতগুলোর পাশাপাশি মিউচুয়াল ফান্ড নামক একটি খাত রয়েছে। যার ইউনিট প্রতিদিন বেচাকেনা হয়ে থাকে। বাজারের চাহিদা ও সরবরাহের পারস্পরিক প্রভাবে তার দাম নির্ধারিত হয়ে থাকে। উন্নত ক্যাপিটাল মার্কেটে মিউচুয়্যাল ফান্ডের অংশ অনেক বেশী থাকলেও নানা কারণে আমাদের দেশে মিউচুয়্যাল ফান্ডের বিকাশ সেভাবে ঘটেনি। অথচ সেটা দরকার। কারণ বিনিয়োগে ঝুঁকি কমানো, তুলনামূলকভাবে নন-প্রফেশনাল বিনিয়োগকারীর স্বার্থ রক্ষা এবং মার্কেটকে স্থিতিশীল করতে মিউচুয়্যাল ফান্ড বিশেষভাবে সহায়ক হয়।

প্রসংগত উল্লেখ্য যে মিউচুয়্যাল ফান্ড মেয়াদী (Close Ended) বা বেমেয়াদী (Open Ended) – এ দু’রকমের হলেও শুধুমাত্র মেয়াদী ফান্ডগুলোই সেকেন্ডারী মার্কেটে ট্রেড হয়ে থাকে। এ নিবন্ধের আলোচনা সেসব মেয়াদী ফান্ড নিয়ে।

ঢাকা স্টক একচেঞ্জে বর্তমানে মোট ৩৭টি মিউচুয়াল ফান্ড তালিকাভূক্ত। বিগত বেশ কয়েক বছর যাবত নতুন কোন ফান্ড বাজারে আসেনি। এর প্রধান কারণ বোধ করি সাম্প্রতিক বছরগুলোতে মিউচুয়াল ফান্ড নিয়ে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে বিশেষ কোন আগ্রহ ছিল না। বেশীরভাগ ফান্ডের বাজার মূল্য তার ফেস ভ্যালুর নীচে ছিল এবং অনেকগুলোর দর ফেস ভ্যালুর অর্ধেকের কাছাকাছি নেমে গিয়েছিল। অথচ এমন এক সময় ছিল যখন ঢাকা স্টক একচেঞ্জে মিউচুয়াল ফান্ডগুলো ছিল হট কেকের মত।

মিউচুয়াল ফান্ডের আইপিওতে ২০-৩০ গুণের বেশী ওভারসাবস্ক্রিপশন হতো। গ্রামীন স্কীম ২ এর শেয়ার প্রাইস দীর্ঘদিন সেকেন্ডারী মার্কেটে ৫০ টাকার উপরে ট্রেড হয়েছিল। যার বর্তমান মূল্য ১৪ টাকার মত। অতি সম্প্রতি অবশ্য মিউচুয়াল ফান্ড নিয়ে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে সার্বিকভাবে কিছুটা আগ্রহ দেখা যাচ্ছে। ফলে বলা যায় যে এ খাতে বিনিয়োগ সম্ভাবনা আস্তে আস্তে পরিস্ফুট হচ্ছে।

প্রশ্ন হলো মিউচুয়াল ফান্ডের কেন এমন দুর্দশা? কেন এখন এত কম দাম আর বছর দশেক আগে তা কেন এত বেশি দাম ছিল? বিনিয়োগকারীদের সচেতনতা আর আবেগ এরুপ অবস্থার পিছনে কতটা দায়ী সে প্রশ্নও সংগতভাবেই চলে আসে। নক্ষত্রের পতনের মত মিউচুয়াল ফান্ডের আজকের এ অবস্থার পিছনে সম্ভবত অনেক ফ্যাক্টরই দায়ী যা রীতিমত গবেষনার দাবী রাখে। তবে আমার দৃষ্টিতে নিম্নোক্ত বাস্তবতাসমূহ উল্লেখ করার যোগ্যঃ

(১) অবাস্তব প্রত্যাশাঃ বাংলাদেশের শেয়ার মার্কেটে অধিকাংশ বিনিয়োগকারী আসেন রাতারাতি ধনী হওয়ার আশায়। তাই ডিভিডেন্ড বা ল্ভ্যাংশের চেয়ে ক্যাপিটাল এপ্রিশিয়েশন বা শেয়ারের দাম কত বাড়লো সেদিকেই তাদের যত মনোযোগ। কিন্ত প্রসপেকটাসের শর্ত অনুযায়ী মিউচুয়াল ফান্ডগুলোকে তাদের আয়ের একটি বড় অংশ ল্ভ্যাংশ হিসাবে ঘোষনা করতে হয়। ফান্ডগুলোর রাইট শেয়ার ঘোষনার সুযোগ নেই। আর আকর্ষণীয় হারে বছর বছর বোনাস-রাইট ঘোষনা ছাড়া ফান্ডের বাজারমূল্য ধরে রাখা আসলেই চ্যালেঞ্জিং। ফল যা হবার তাই হয়- ধীরে ধীরে মূল্য কমে। তাছাড়া, মিউচুয়্যাল ফান্ডের দরের উঠানামা তুলনামূলকভাবে কম হয় এবং অনেকক্ষেত্রে লিকুইডিটি (দৈনিক কমসংখ্যক ট্রেডিং) কম থাকে, যা বাংলাদেশের অধিকাংশ বিনিয়োগকারীর অপছন্দের কারণ।

(২) ফান্ড পরিচালনায় আনপ্রফেশনালিজমঃ মিউচুয়াল ফান্ডের মূল কনসেপ্টই হচ্ছে যে যেহেতু সাধারন বিনিয়োগকারীদের পক্ষে মার্কেট রিসার্চ করে উপযুক্ত কোম্পানী যাচাই বাছাই করা সম্ভবপর নয় সেহেতু এ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানীর প্রফেশনাল ম্যানেজাররা বিনিয়োগকারীদের পক্ষে তা করবে যার ফলশ্রুতিতে আখেরে বিনিয়োগকারীরাই লাভবান হবে। কিন্ত বাংলাদেশের অধিকাংশ ফান্ডের শেয়ার পোর্টফলিও দেখলেই বুঝা যাবে যে তারা আনাড়ী বিনিয়োগকারীর মতই ভাল মন্দ নির্বিশেষে নানা কোম্পানীর শেয়ার অতি উচ্চ দামে ক্রয় করে রেখেছে। তাহলে তাঁদের রিসার্চ আর অভিজ্ঞতার প্রমাণ কোথায়? তদুপরি তাঁদের ওয়েবসাইটে অধিকাংশ ক্ষেত্রে রিসেন্ট তথ্য তো থাকেই না, বরং অনেকক্ষেত্রে ২-৩ বছর আগের তথ্যেরও আপডেট নেই। বার্ষিক রিপোর্টেও বিস্তারিত তথ্য নেই। সব মিলিয়ে বলা যায় যে দেশের এ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানীগুলোতে প্রফেশনালিজম নেই বললেই চলে। কোন কোন ফান্ডের অর্থে অনৈতিকভাবে দূর্নীতির মাধ্যমে বিশেষ সময়ে বিশেষ কোম্পানীর শেয়ার অতি উচ্চ দরে কেনার অভিযোগও আছে।

(৩) নিম্নমূখী মার্কেট ট্রেন্ডঃ সামগ্রিকভাবে শেয়ার বাজারের ট্রেন্ড বেশ কয়েক বছর যাবৎ ক্রমাগত নিম্নগামী। এর সুযোগ নিয়ে অধিকাংশ তালিকাভূক্ত কোম্পানী পূর্বের তুলনায় কম হারে ল্ভ্যাংশ ঘোষনা করছে যার ফলে মিউচুয়াল ফান্ডগুলোর আয় কমে যাচ্ছে। মিউচুয়াল ফান্ডের পোর্টফলিওতে সাধারনত অনেক কোম্পানীর শেয়ার অন্তর্ভূক্ত থাকে বিধায় একে বৃহত্তর বাজারের মিরর বা প্রতিচ্ছবিও (Market Mirror) বলা হয়ে থাকে। তাই মার্কেট ট্রেন্ড নিম্নগামী হলে মিউচুয়াল ফান্ডের দামে তা সরাসরি নেগেটিভ প্রভাব ফেলে। তদসত্বেও বলা যায় যে বাংলাদেশের শেয়ার মার্কেটে সার্বিক মূল্যসূচকের তুলনায় মিউচুয়াল ফান্ডের দাম বেশী পড়েছে। উদাহরণস্বরুপ, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ডিএসইএস ইন্ডেক্সের পিই রেশিও যেখানে ১৪ দশমিক ২৫ ছিল সেখানে মিউচুয়াল ফান্ড সেক্টরের পিই রেশিও ছিল মাত্র ৭ দশমিক ৩২। তবে জুলাই ২০২০ এর পর থেকে মার্কেট ট্রেন্ড কিছুটা ঘুরে দাঁড়ানোর কারণে মিউচুয়্যাল ফান্ডের দামও আস্তে আস্তে বাড়ছে।

(৪) গুনগতমান মূল্যায়নে বিনিয়োগকারীদের ব্যর্থতাঃ দেশের মিউচুয়াল ফান্ডগুলোর সার্বিক দুর্বলতা থাকা সত্বেও এটা অস্বীকার করার উপায় নেই যে সব ফান্ডের পরিস্থিতি বা পরিচালনার মান একই রকম নয়। ডিএসইতে তালিকাভূক্ত ৩৭টি ফান্ডের পরিচালনায় জড়িত আছে মোট ৮টি এ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানী। তাদের পারস্পরিক দক্ষতা, অভিজ্ঞতা, কর্মতৎপরতায় ও পারফর্মেন্সে ব্যাপক পার্থক্য লক্ষ্যনীয়। কিছু ফান্ডের রিজার্ভের পরিমাণ অনুল্লেখ্য, বছর বছর ইপিএস এর পরিমাণ উঠানামা করে, অনেকবার ইপিএস Re-Stated করা হয়েছে, প্রদত্ত ল্ভ্যাংশ হারও খুবই কম এবং ক্রমশঃ তা নিম্নগামী, পোর্টফলিওতে প্রয়োজনীয় সব তথ্য নেই, ইত্যাদি। আবার কিছু ফান্ডের রয়েছে প্রত্যাশিত রিজার্ভ, ভাল ইপিইউ, ধারাবাহিকভাবে গ্রহণযোগ্য ডিভিডেন্ড প্রদান, পোর্টফলিওতে মৌল্ভিত্তি শেয়ার আধিক্য এবং ক্যাপিটাল এলোকেশনে ইকুইটি এবং ফিক্সড ইনকা্ম ইনুস্ট্রমেন্টের মধ্যে সুষম বন্টন। কিন্ত বিনিয়োগকারীরা তা কতটা মূল্যায়ন করছে? যদি ভাল কাজের সঠিক মূল্যায়ন না হয় তবে সেসব ফান্ড পরিচালনার সাথে সম্পৃক্ত ম্যানেজমেন্ট নিরুৎসাহিত হয় এবং আরো ভাল করার প্রচেষ্টায় ভাটা পড়ে। আসলে এ খাতের উন্নয়নে প্রয়োজন নিয়মিত ভিত্তিতে বস্তুনিষ্ঠ বিশ্লেষণ, সার্বক্ষণিক গঠণমূলক সমালোচনা এবং প্রতিযোগীতার পরিবেশ তৈরী করা যাতে করে ফান্ড পরিচালনাকারীরা তাঁদের দূর্বলতা সম্পর্কে জানতে পারেন আর তা নিরসনে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে তাঁরা সক্রিয় হন। বর্তমানে সেরুপ পরিবেশ ও অবস্থা বিদ্যমান নেই।

বিনিয়োগকারীরা যা দেখবেনঃ বিদ্যমান বাস্তবতার মধ্যেও মিউচুয়াল ফান্ডের শেয়ারে বিনিয়োগ করে লাভবান হওয়ার ভাল সুযোগ রয়েছে। তবে সাধারন বিনিয়োগকারীগনকে নিম্নোক্ত বিষয়গুলো বিবেচনা করতে হবেঃ

(ক) ট্র্যাক রেকর্ডঃ ফান্ড পরিচালনার সাথে জড়িত বোর্ডের চেয়ারম্যান, সিএফও এবং অন্যান্য উর্ধতন কর্মকর্তাদের ব্যক্তিগত যোগ্যতা, সততা, অভিজ্ঞতা এবং সর্বোপরি তাঁদের অতীত ট্র্যাক রেকর্ড কেমন তা জেনে বিনিয়োগ করতে হবে। বিগত সময়ে তাঁরা যদি ভাল পারফর্ম করে থাকে তবে ভবিষ্যতেও করবে। তাই যে কোন ফান্ডে বিনিয়োগের পূর্বে ভালভাবে জেনে সন্তোষজনক মনে হলেই শুধু তা কিনুন।

(খ) পোর্টফলিও পজিশনঃ এক একটি এ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানী তাঁদের মত করে পোর্টফলিও সাজায়। কেউ হয়তো মৌল্ভিত্তিসম্পন্ন ভাল কোম্পানীর শেয়ার বেশী রাখে, আবার কেউ সব ধরনের শেয়ার রাখে, কেউ যেসব শেয়ারের দাম বেশী উঠানামা করে সেসব রাখে, কেউ শেয়ার, বন্ড ও এফডিআর বিনিয়োগে ব্যালেন্স করে, কেউ শুধুমাত্র সিলেক্টিভ কিছু শেয়ারে বিনিয়োগ করে। ফান্ডের পোর্টফলিওতে কোন কোন শেয়ার আছে, সেসব শেয়ারের ক্রয়মূল্য ও বর্তমান বাজারমূল্য কেমন, এফডিআর বা বন্ড আছে কিনা ও থাকলে তার অনুপাত কিরুপ সেসব বিষয়ে বিশ্লেষণ করে তারপর বিনিয়োগ করা বাঞ্চনীয়। তাছাড়া ফান্ড সম্পর্কিত প্রয়োজনীয় তথ্যাদি নিয়মিতভাবে ফান্ডের ওয়েবসাইটে আপলোড হচ্ছে কিনা সেটাও দেখতে হবে।

(গ) কষ্ট প্রাইস ও মার্কেট প্রাইসের পার্থক্যঃ ইউনিটপ্রতি NAV এর Cost Price NAV এর Market Price এর নীচে থাকতে হবে। সেটা থাকলেই বুঝা যায় যে ফান্ডটি লাভে আছে। এ দু’টো তথ্যই সাপ্তাহিক ভিত্তিতে ফান্ডের পক্ষ থেকে সরবরাহ করা হয় এবং তা ডিএসই ওয়েবসাইটে সংশ্লিষ্ট ফান্ডের News অংশে আপলোড করা হয়।

(ঘ) রিজার্ভঃ ফান্ডের পেইড আপ ক্যাপিটাল এর তুলনায় রিজার্ভের পরিমাণ সন্তোষজনক আছে কিনা তা দেখতে হবে। রিজার্ভের পরিমাণ যত বেশী হয় ততই ভাল। কারণ সেক্ষেত্রে আগামীতে ফান্ডের আয় কমে গেলেও রিজার্ভের অর্থ দিয়ে ল্ভ্যাংশের হার ঠিক রাখা সম্ভব হতে পারে। পেইড আপ ক্যাপিটাল এবং রিজার্ভে সংরক্ষিত অর্থের তথ্য ডিএসই ওয়েবসাইটে সংশ্লিষ্ট ফান্ডের পেইজে ক্লিক করলেই পাওয়া যাবে।

(ঙ) সন্তোষজনক ইপিইউঃ আর্ণিংস পার ইউনিট (ইপিইউ) সন্তোষজনক কিনা তা দেখতে হবে। বিগত ৫ বছরের ইপিইউ যা ডিএসই ওয়েবসাইটে দেয়া থাকে তার পরিমাণ কিরুপ এবং তা ধারাবাহিকভাবে বাড়ছে কিনা সেটা দেখা উচিত। ইপিইউ এর অত্যধিক উঠানামা (fluctuation) নিশ্চয়ই ভাল খবর নয়। বর্তমানে দেশের অনেক ফান্ডের ইপিইউ প্রায় শুণ্যের কাছাকাছি এবং অনেক ফান্ডের তা নেগেটিভ। কারণ ফান্ডগুলো যে কোম্পানীতে বিনিয়োগ করেছিল তারা আশানুরুপ ল্ভ্যাংশ না দেয়ার ফলে সেরুপ অবস্থা হয়েছে। সেরুপ ফান্ডের কাছ থেকে গ্রহণযোগ্য বা সন্তোষজনক ল্ভ্যাংশ আশা করা যায় না এবং তা বিবেচনা করেই কত দামে কেনা যৌক্তিক তা নির্ধারণ করতে হবে। উল্লেখ্য ২০১৯-২০২০ অর্থবছরে মাত্র কয়েকটি মিউচুয়াল ফান্ড ল্ভ্যাংশ ঘোষনা করতে পেরেছে এবং অধিকাংশ ফান্ডই লভ্যাংশ দিতে ব্যর্থ হয়েছে।

(চ) ট্রেন্ডঃ বাজারে ওভারঅল ট্রেন্ড যেমন থাকে তেমনি সেক্টরাল ট্রেন্ডও থাকে। দেখা যায় এক এক সময় এক বা একাধিক সেক্টরের প্রতি বিনিয়োগকারীদের বিশেষ আগ্রহ থাকে। তাই ট্রেন্ডের সাথেই থাকা এবং সে অনুসারে পোর্টফলিও সাজানো দরকার।

শফিকুল ইসলাম
Email: [email protected]