ঘুম ভাঙেনি, ভাঙবে কি করে!
প্রকাশ: ২০১৫-১২-২১ ১৬:১৩:০৬
ঘুমিয়ে আছে দুটি শিশু। পরনে লুঙ্গি, খালি গা। বিছানায় টাঙানো মশারির একপাশের দড়ি খুলে অর্ধেকটা ঝুলে আছে। শিশু দুটির নিষ্পাপ মুখের দিকে তাকিয়ে মনে হবে, এই বুঝি তাদের ঘুম ভেঙে গেলো। নতুন সকালের লাল সূর্যের আলো গায়ে মেখে তারা হেসে উঠবে। কিন্তু সেই ভোর আর দেখা হয়নি তাদের। তারা এখনো ঘুমিয়ে আছে, সেই একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময় থেকে। আজো তাদের ঘুম ভাঙেনি, ভাঙবে কি করে! তাদেরকে তো পাক সেনারা ঘুমন্ত অবস্থায় হত্যা করেছে।
বিছানায় রক্তের লালচে জমাট। শিশুর কোমল দেহে হানাদারের বুলেটের ক্ষত। এমন মর্মস্পর্শী চিত্রের দেখা মেলে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ স্মৃতি সংগ্রহশালায়। দেশের প্রথম মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক জাদুঘরে এমন হাজারো আলোকচিত্র, তৈলচিত্র, প্রতিকৃতি, শহীদদের ব্যবহৃত আসবাবসহ নানা নিদর্শন যে কাউকে ফিরিয়ে নিয়ে যাবে ’৭১ এর অগ্নিঝরা দিনগুলোতে।
ভাষা আন্দোলনের পটভূমি থেকে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ পর্যন্ত সকল আন্দোলন সংগ্রামে ভূমিকা ছিল রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-ছাত্র, কর্মকর্তা-কর্মচারী সকলের । তাদের সকলের ছিল সক্রিয় অংশগ্রহণ। সাথে অনেক শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারীও শহীদ হন। এই সকল বীর সৈনিকদের আত্মত্যাগ আর যুদ্ধের স্মৃতিচিহ্ন স্মরণীয় করে রাখতে ১৯৭৬ সালের ২ জানুয়ারী সাবেক উপাচার্য সৈয়দ আলী আহসানের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সভায় এই স্মৃতি সংগ্রহশালা স্থাপনের সিদ্ধান্ত হয়। একই বছরের ৬ মার্চ সাবেক শিক্ষা উপদেষ্টা আবুল ফজল সংগ্রহশালার আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন।
১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের পটভূমিতে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্ম। আর এখানেই অবস্থিত শহীদ স্মৃতি সংগ্রহশালা। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্যারিস রোডের পূর্ব দিকে এবং কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার চত্বরে স্থাপিত এই সংগ্রহশালা। ১৯৯০ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি দেশের এই প্রথম সংগ্রহশালা দর্শকদের জন্য উন্মুক্ত করে, উদ্বোধন করেন তিন শহীদ পত্নী।
তিনটি গ্যালারী নিয়ে গঠিত এই সংগ্রহশালাটি। অল্প কিছু নির্দশন নিয়ে সংগ্রহশালাটি যাত্রা শুরু করলেও সময়ের পরিক্রমায় এখন সামগ্রিক আন্দোলন সংগ্রামের মুক্তিযুদ্ধের পূর্ণাঙ্গ সংগ্রহশালায় রুপ লাভ করেছে। এই গ্যালারীগুলোতে আছে ‘৫২ সাল থেকে ‘৭১ এর মুুক্তিযুদ্ধ সময়ের সকল আলোকচিত্র, তৈলচিত্র ও বিভিন্ন দলিল-দস্তাবেজ এমনকি শহীদদের ব্যবহৃত জামা, জুতা, কোর্ট, টাই, ঘড়ি, টুপি ও কলমসহ বিরলসব জিনিস।
এখানে আছে, রাজশাহীতে নির্মিত প্রথম শহীদ মিনার, ১৪৪ ধারা ভঙ্গের প্রস্তুতির ছবি, ভাষা আন্দোলনে শহীদের ছবি, খালিপায়ে মিছিলের ছবি, ১৯৬৯ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে মিছিলের ছবি (এ মিছিলে গুলিবিদ্ধ হন তৎকালীন প্রক্টর ড. শামসুজ্জোহা), এছাড়া এই সংগ্রহশালাতেই আছে দেশের প্রখ্যাত চিত্রশিল্পীদের চিত্রকর্ম।
যাদের চিত্রকর্ম রয়েছে তাদের মধ্যে হল, আমিনুল ইসলাম, কাইয়ুম চৌধুরী, মোস্তফা মনোয়ার, রফিকুন্নবী, শামসুল আলম, হাশেম খান, রশীদ চৌধুরী ও দেবদাস চক্রবর্তী।
দ্বিতীয় গ্যালারীতে আছে, সেক্টর কমান্ডারদের ছবি, ৭ জন বীরশ্রেষ্ঠর ছবি ও জাতীয় চার নেতার ছবি, স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রের প্রতিলিপি, বাংলার গণহত্যার ছবি, ২৫ মার্চ রাতের অতর্কিত হামলার ছবি, এবং বাধাইকৃত মুক্তিযুদ্ধের বিখ্যাত পোস্টার ‘আমরা সবাই বাঙালী’ । আবার এই গ্যালারীতেই আছে শহীদ অধ্যাপক মনিমুল হকের ব্যবহৃত পোশাক, স্য্টু, ছাতা, লাঠি ও ব্যাগ। মাদার তেরেসার তৈলচিত্র, পাকবাহিনীর ব্যবহৃত কাঠের লাঠি, পাদুকা।
এখানে আছে শিল্পী রফিকুন্নবীর ‘একাত্তর ফেরা’, হাশেম খানের ‘বাংলাদেশ ডিসেম্বর’, মাহমুদুল হকের ‘৭১ দুর্ভিক্ষ’, এবং সাংবাদিক সিরাজুদ্দিনের ডায়েরী ও পান্ডুলিপি।
তৃতীয় গ্যালারীতে আছে, পাকবাহিনীর আত্মসমর্পণের দলিলচিত্র, এছাড়া শহীদ বুদ্ধিজীবী, শহীদ সাংবাদিকদের ছবি এবং বঙ্গবন্ধু সর্ম্পকিত একটি র্বোড। এছাড়া রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের গণকবর থেকে সংগৃহিত নাম না জানা শহীদদের মাথার খুলি, হাড়গোড় ও ব্যক্তিগত ব্যবহারের জিনিসপত্র, শিল্পী আমিনুল ইসলামের শ্বেতপত্র-৭১।
বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত ফলিত গণিত বিভাগের প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী আক্তারুজ্জামান জাপান বলেন, আমি প্রথমদিকে ক্যাম্পাসে এসে ক্লাস শুরু হওয়ার পূর্বে বন্ধুদের সঙ্গে এই সংগ্রহশালাতে ঘুরতে যাই। কেননা দেশের আর কোনো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে শহীদ স্মৃতি সংগ্রহশালা নেই। তাই আমরা যারা শিক্ষার্থী আছি, তাদের জন্য গর্বের আর আমিও গর্ববোধ করি।
এছাড়া নতুন প্রজন্মের কাছে এই সংগ্রহশালাটি মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস জানার জন্য সহায়ক হবে। ২য় বর্ষের আরেক শিক্ষার্থী সমাজবিজ্ঞান বিভাগের লিপিকা বিশ্বাস বলেন, মুক্তিযুদ্ধের কথা পাঠ্য বইয়ে পড়েছি, কিন্তু দেখার সুযোগ হয়নি। তবে এই বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুবাদে দেখার সুযোগ হয়েছে । বুঝতে পেরেছি মুক্তিযুদ্ধে কতটা অবদান ছিলো শহীদদের। আমি মনে করি, প্রত্যেক শিক্ষার্থীর পাশাপাশি সকল শিক্ষিত তরুণদের এই সংগ্রহশালা দেখা উচিত। তাহলে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস সম্পর্কে জানতে পারবে।
শহীদ স্মৃতি সংগ্রহশালার বর্তমান কিউরেটর ড. মো. সফিকুল ইসলাম বলেন, প্রতিদিন এখানে ৭০-৭৫ জন দর্শনার্থী আসেন, তবে ২১শে ফেব্রুয়ারি, ২৬ মার্চ ও ১৬ ডিসেম্বরের বিজয় দিবসে তিন হাজার থেকে পাঁচ হাজার দর্শনার্থী ঘুরতে আসেন। সংগ্রহশালাটি প্রতিদিন সকাল আটটা থেকে দুপুর দুইটা পর্যন্ত খোলা থাকে, তবে বিশেষ দিবসগুলোতে সকাল সাতটা থেকে বিকাল পাঁচটা পর্যন্ত খোলা থাকে। তিনি আরও বলেন, বিভিন্ন দেশ থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ে আগত বিদেশীরা এখানে ঘুরতে আসেন।
এছাড়া ভারত, চীন, জাপান, কানাডা, ডেনমার্ক, সুইডেন, যুক্তরাষ্ট্র ও র্জামানি থেকে দেশে আগত দর্শনার্থীরা এই সংগ্রহশালা দেখতে আসেন। এখানে একটি সমৃদ্ধ পাঠাগার আছে, যেখানে প্রায় সাড়ে তিন হাজারেরও বেশি পুস্তক ও দলিল দস্তাবেজ আছে। নতুন কোন মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক বই রচনা হলে, আমরা কিনে সংগ্রহ করার চেষ্টা করি।
এছাড়া সংগ্রহশালার মূল ভবনের সাথেই আছে একটি মুক্তমঞ্চ , যেখানে প্রশাসন অনুমতি দিলে বিভিন্ন সংগঠন ব্যবহার করতে পারেন।
তিনি বলেন, এখানে ভাষা আন্দোলন থেকে মুক্তিযুদ্ধ পর্যন্ত সকল আন্দোলন সংগ্রামের নির্দশন আছে । যার মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস সম্পর্কে বর্তমান ও আগামী প্রজন্ম জানতে পারবে, সাথে সাথে দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হবে।
সানবিডি/ঢাকা/ হৃদয়/এসএস