শেয়ার ট্রেডিং সফলতার কৌশল
:: প্রকাশ: ২০২০-১২-০৬ ১২:২১:৩৯
আধুনিক যুগে সব দেশেই ক্যাপিটাল মার্কেট তথা শেয়ার মার্কেট অর্থনীতির অতি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। বাংলাদেশও তার ব্যতিক্রম নয়, যদিও এখানে শেয়ার মার্কেটের আকার পৃথিবীর অন্যান্য অনেক দেশের তুলনায় বেশ ছোট। শেয়ার মার্কেট থেকে যে কোন ব্যক্তির আর্থিকভাবে লাভবান হওয়ার অমিত সম্ভাবনা সব সময়ই বিদ্যমান থাকে। শুধু দরকার সে সুযোগকে কাজে লাগানোর যোগ্যতা ও মানসিকতা অর্জন করা।
বাংলাদেশের শেয়ার মার্কেট তুলনামূলক ছোট হওয়া সত্বেও এ মার্কেটে জড়িত আছে কয়েক লক্ষ বিনিয়োগকারী। এদের একটি অংশ অনেক বেশী সক্রিয়-প্রায় প্রতিদিন ট্রেড করে, আবার অনেকে কালেভদ্রে ট্রেড করে থাকে। তবে সাধারন বিনিয়োগকারীদের মধ্যে ধারাবাহিকভাবে লাভের মুখ দেখেন তেমন সংখ্যা বোধ করি খুবই কম। সাম্প্রতিক সময়ে মার্কেটের উর্ধমূখী উথ্বান দেখে বিপুল সংখ্যক নতুন বিনিয়োগকারী বাজারে ঢুকেছে বা ঢোকার চেষ্টা করছে। আবার অনেকে ইতিপূর্বে বড় ধরনের লস খেয়ে হয়তো প্রতিজ্ঞা করেছে যে জীবনে আর কখনো শেয়ার মার্কেটমূখী হবে না। কেন শেয়ার ব্যবসায় অধিকাংশ মানুষ লস খায় এবং কি পদ্ধতি অবলম্বন করলে দীর্ঘমেয়াদে এ মার্কেট থেকে লাভ করা যায় তা বিশ্লেষণ ও পরামর্শ প্রদান করাই এ নিবন্ধের উদ্দেশ্য।
বিশ্বজুড়েই সাধারন মানুষ শেয়ার মার্কেটে বিনিয়োগ করতে আসে পর্যাপ্ত প্রস্ততি ছাড়াই। আমাদের দেশের ক্ষেত্রে তা আরো বেশী সত্য। যুদ্ধের ময়দানে ট্রেনিং আর অস্ত্র ছাড়া হাজির হলে জীবন যায়,আর ক্যাপিটাল কিংবা শেয়ার মার্কেটে সঠিক জ্ঞান ও পরিকল্পনা ছাড়া এলে নিজের পুঁজি হারাতে হয়। এ মার্কেট সবার জন্য নয়। শিক্ষিত ও বুদ্ধিমান মানুষরাই এ মার্কেটের খেলোয়াড়। তাই তাদের সাথে খেলতে হলে আপনাকেও তাদের সমকক্ষ হতে হবে। প্রশ্ন হলো কিভাবে সে যোগ্যতা অর্জন করবেন? আপনাকে প্রথমে পড়াশুনা করতে হবে, শেয়ার মার্কেট এর টার্মিনলজিগুলো সম্বন্ধে ভাল্ভাবে জানতে হবে, সেসব টার্মের একটির সাথে অপরটির কি সম্পর্ক তা বুঝতে হবে, কোম্পানীর বার্ষিক ও ত্রৈমাসিক রিপোর্ট বিশ্লেষণ করা জানতে হবে, তালিকাভূক্ত কোম্পানী কিসের ব্যবসা করে এবং বাজারে তাদের মার্কেট শেয়ার কত, ব্যবসার সর্বশেষ অবস্থা কেমন সে জাতীয় নানা তথ্য সম্পর্কে অবহিত থাকতে হবে। ট্রেড করে ইতিপূর্বে লস হয়ে থাকলে কি কারণে তা হয়েছিল এবং সে ভূলের পূনরাবৃত্তি পরিহারে কি করা যায় তা নির্মোহভাবে বিশ্লেষণ করতে হবে। শুধু তাই নয়, আপনাকে টেকনিক্যাল এনালাইসিস তথা চার্ট রিডিং জানতে হবে সঠিক প্রাইসে এন্ট্রি/এক্সিট দেয়ার জন্য যার দরকার। এতকিছু জানা ও তার সঠিকভাবে প্রয়োগ করার জন্য প্রয়োজন পর্যাপ্ত জ্ঞান, অভিজ্ঞতা ও দূরদর্শিতা – সর্বোপরি স্ঠিক সাইকোলজি বা মানসিকতা। ত্বরিত সিদ্ধান্ত নেয়া এবং তা বাস্তবায়নের সহজাত ক্ষমতা অবশ্যই থাকতে হবে। কোনপ্রকার দোদুল্যমানতা কিংবা সিদ্ধান্তহীনতার অবকাশ নেই এখানে। সবসময় মনে রাখতে হবে যে শেয়ার মার্কেট অত্যন্ত প্রতিযোগীতামূলক। তাই এ মার্কেটে সফল হতে হলে নীচে বর্ণিত ৩টি জিনিস সুচারুরুপে সম্পন্ন করা শিখতে হবে।
(১) স্ট্র্যাটেজী বা কৌশল প্রণয়নঃ অবশ্যই আপনার উপযোগী ও পরিক্ষীত একটি কৌশল থাকতে হবে। আপনি কোন ধরনের শেয়ার কিনবেন, মূল্ধনের সর্বোচ্চ কত শতাংশ কোন্ বিশেষ কোম্পানীতে খাটাবেন, কতদিন শেয়ারটা ধরে রাখবেন, টার্গেট প্রাইস কত হবে, কোন ইন্ডিকেটর দেখে শেয়ার কিনবেন বা বেচবেন সে জাতীয় নানা আবশ্যিক তথ্য মাথায় রেখে এবং বিশেষতঃ আপনার আর্থিক ও মানসিক অবস্থানের আলোকে ট্রেডিং স্ট্র্যাটেজী ঠিক করতে হবে। আর্থিক, মানসিক ও প্রায়োগিক অভিজ্ঞতার মাত্রা এক নয় বিধায় সবার স্ট্র্যাটেজী এক হবে না। নিজ অবস্থানের আলোকে ট্রায়াল এন্ড এরর এর মাধ্যমে পরীক্ষা (ব্যাকটেস্টিং) করে দেখতে হবে কোন্ স্ট্র্যাটেজী লাভজনক হচ্ছে। তারপর সেটি চূড়ান্ত করে সে মোতাবেক ট্রেডিং করতে হবে। স্ট্র্যাটেজী লিখিত আকারে থাকতে হবে এবং তা সর্বোচ্চ ২ পৃষ্ঠার হবে। স্ট্র্যাটেজী চূড়ান্ত করার পর তার ব্যতয় (ডেভিয়েশন) করা যাবে না এবং সেখানে লিপিবদ্ধ রুলস মেনেই ক্রমাগতভাবে দিনের পর দিন ট্রেড করে যেতে হবে।
(২) ঝুঁকি ব্যবস্থাপনাঃ শেয়ার মার্কেটে বিনিয়োগ অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। এখানে লাভ যেমন বেশী হয়, তেমনি পুঁজি হারাতেও সময় লাগে না। তাই কোন কারণে ভূল শেয়ারে বিনিয়োগ হয়ে গেলে পুঁজির বৃহৎ অংশ রক্ষার্থে স্টপ-লস গ্রহণ করা জরুরী। স্টপ-লস হলো দাম নীচে নামতে থাকলে আরো বেশী পতনের আগেই সামান্য লসে তা বিক্রি করে দেয়া। স্টপ-লস ছাড়া ট্রেডিং করা আর হেলমেট ছাড়া মোটরবাইক নিয়ে রাস্তায় নামা সমার্থক। তুলনামূলক উন্নত দেশগুলোর স্টক মার্কেটে শেয়ার ক্রয়কালেই ট্রেডিং প্লাটফর্মে স্টপ-লস বসানোর ব্যবস্থা থাকলেও আমাদের দেশে তা নেই। স্টপ-লস দেয়ার প্রচলনও তেমন নেই। তাই বিনিয়োগকারীকে নিজের পুঁজি রক্ষায় খেয়াল রাখতে হবে কখন তার কেনা শেয়ারটির মূল্য নির্ধারিত স্টপ-লস প্রাইসে নেমে আসছে এবং যখনই তা সেই প্রাইসকে স্পর্শ করবে তখনই শেয়ারটি বিক্রি করে দিতে হবে। স্টপ-লস গ্রহণের মাত্রা বা কত পারসেন্টে স্টপ-লস করা উচিত সেটা সুনির্দিষ্ট নয়। সেটি একেক জনের জন্য ভিন্ন ভিন্ন হতে পারে এবং তার মাত্রা নির্ভর করবে বিনিয়োগকারীর নিজস্ব আর্থিক অবস্থা, ঝুঁকি গ্রহণের মানসিকতা, বিনিয়োগকারীর টাইপ এবং আরো কিছু ফ্যাক্টরের উপর। তবে টোও তিঘ্ত বা কেনা দামের খুব কাছাকাছি স্টপ-লস নির্ধারণ করা হলে তা অতি সহজেই এক্সেকিউতে হয়ে যাবে। তার ফলে বিনিয়োগকারী পরবর্তীতে সম্ভাব্য লাভের সুযোগ থেকে বঞ্চিত হবেন। আবার টোও ওয়াইড বা কেনা দামের অনেক নীচে স্টপ-লস করা হলে ট্রেডপ্রতি অধিক পরিমাণ লস বহন করতে হবে। তাই সফল হতে হলে স্টপ-লস প্রাইস নির্ধারণও সঠিক হওয়া চাই। এখানেই অভিজ্ঞতার মূল্য। একজন অভিজ্ঞ বিনিয়োগকারী জানে যে কোন্ ধরনের কোম্পানীর দাম কিভাবে উঠানামা করতে পারে এবং সেভাবেই সে স্টপ-লস প্রাইস ঠিক করে। কিন্ত বেশীরভাগ ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারী স্টপ-লস করে না এবং দাম কমে গেলে তারা আশায় আশায় থাকেন যে শেয়ারটির দাম হয়তো অচিরেই পূর্বের দামে ফিরে আসবে। কিন্ত মার্কেট তো ব্যক্তির ব্যক্তিগত আশা বা অনুভূতির কোন মূল্য দেয় না। ফলে যা হবার তাই হয়- দাম আরো কমে যায় এবং একসময় দেখা যায় যে পুঁজির বড় অংশই হাওয়া হয়ে গেছে।
স্টপ-লস অতি গুরুত্বপূর্ণ। তবে তা হতে হবে সঠিক দামে এন্ট্রির সাথে। যদি বিনিয়োগকারী আবেগের বশবর্তী হয়ে দিনের সর্বোচ্চ দামে কোন শেয়ার কিনে নেয় তবে অনেক সময়ই তার দাম কমে সহসাই নির্ধারিত স্টপ-লস প্রাইস স্পর্শ করে। তাই যে কোন শেয়ার কেনার আগে অনেক ভেবেচিন্তে সিদ্ধান্ত নিতে হবে এবং দাম গ্রহনযোগ্য লেভেলে এলেই শুধু এন্ট্রি দিতে হবে। সকল ব্যবসায়ে একটি কথা প্রচলিত আছে যে কেনার সময় না জিতলে কখনো ব্যবসা হয়না। শেয়ার মার্কেটেও শেয়ার কেনার সময় জিততে হবে। এ মার্কেটের বৈশিষ্ট্যই হচ্ছে যে দাম কখনো সম্পূর্ণ সরলরৈখিকভাবে বাড়ে বা কমে না। উর্ধবমূখী মার্কেটে দাম বাড়ে, তারপর কিছুটা কমে (রিট্রেসমেন্ট), তারপর কিছু বিরতি দিয়ে আবার বাড়ে। হয়তো বাড়ার হার কমার হার থেকে বেশী হয়। তাই একটি শেয়ারের দাম বেড়ে যাচ্ছে দেখে অধৈয্য হয়ে সংগে সংগেই তা যে কোন দামে কেনার কোন মানে নেই। একটু অপেক্ষা করলে হয়তো ঐ শেয়ারটিই কিছু কম দামে পাওয়া যাবে। আর না পাওয়া গেলেও অন্য কোন শেয়ার কেনার চিন্তা করা যায়। তাই এ মার্কেটে টিকতে হলে ধৈয্য ধারণ করতে পারার অভ্যাসটা খুবই জরুরী। কিন্ত অধিকাংশ বিনিয়োগকারী ফোম (ফিয়ার অফ মিসিং আউট) নামক আবেগে তাড়িত হয়ে অতি উচ্চ মূল্যে শেয়ার কিনে শেষ পর্যন্ত লসের সন্মুখীন হন। আর লস না হলেও অধিক দামে শেয়ার কেনার কারণে সম্ভাব্য লাভ থেকে কিছুটা হলেও বঞ্চিত হন।
(৩) আবেগ নিয়ন্ত্রণঃ শেয়ার মার্কেটে সফল হতে না পারার প্রধানতম কারণ হলো নিজের আবেগজনিত (ইমোশনস)সমস্যা। নিজের আবেগকে নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম না হলে এ মার্কেটে কখনো সফল হওয়া যায় না। শেয়ার কেনা বা বেচার সময় আবেগ কাজ করলে ভূল হবে বেশী। বেশীরভাগ মানুষের বিশেষ কোন কোম্পানীর প্রতি বিশেষ পছন্দ বা অপছন্দ থাকে। হয়তো পূর্বে সেই কোম্পানীর কোন ডিল থেকে লাভ বা লোকসানের কারণে সেরুপ পছন্দ বা অপছন্দ তৈরী হতে পারে। কিন্ত সেটা হলে চলবে না, সম্পূর্ণ নির্মোহভাবে ট্রেড করতে হবে। কোন বিশেষ শেয়ারকে ভালবেসে তার সম্বন্ধে অতি উচ্চ ধারণা পোষণ করার কারণে দেখা যায় যে দাম অনেক বাড়ার পরও বিনিয়োগকারী ভাবে্ন যে শেয়ারটির দাম আরো বাড়বে এবং তিনি তা বিক্রি করা থেকে বিরত থাকেন।
ফিয়ার, গ্রিড, হোপ – এই ৩টি আবেগ শেয়ার মার্কেটে সফল হওয়ার পথে প্রধান বাঁধা। ফেয়ার এর প্রভাবে অনেকে অতি সামান্য লাভেই শেয়ার ছেড়ে দেয় ও সম্ভাব্য লাভের সুযোগ থেকে নিজেকে বঞ্চিত করেন। আর গ্রিড এর প্রভাবে লাভ যথাসময়ে ঘরে না তোলার কারণে শেষ পর্যন্ত আম-ছালা দুটোই হারাতে হয়। আর হোপ হচ্ছে সবচেয়ে মারাত্বক ব্যাধি। কোন শেয়ারে এন্ট্রি দেয়ার পরে দেখা গেল যে শেয়ারটির দাম আস্তে আস্তে কমে যাচ্ছে। সে পরিস্থিতিতে অনভিজ্ঞ বিনিয়োগকারী স্টপ-লস নিয়ে বিক্রি করে দেয়ার পরিবর্তে আশায় আশায় থাকেন যে শীঘ্রই তার দাম পূর্বের অবস্থায় বা তার কেনা দামে ফিরে আসবে। বাস্তবতা হলো যে দাম পতনের নেপথ্যে হয়তো বড় ধরনের কারণ রয়েছে যেটা বিনিয়োগকারী অবহিত নন। ফলে শেয়ারটির দাম হয়তো আদৌ বাউন্স-ব্যাক করে না এবং আশা (হোপ) শেষ পর্যন্ত নিরাশায় পরিণত হয়। আসলে শেয়ার মার্কেট হচ্ছে নিষ্ঠূর যুদ্ধক্ষেত্রের মত যেখানে ভাবাবেগের কোন মূল্য নেই। ব্যক্তিবিশেষ তার সব মূল্ধন হারিয়ে নিঃস্ব হলেও মার্কেট তার নিজস্ব গতিতেই চলবে। আবার কেউ মার্কেট থেকে প্রচুর টাকা আয় করলেও মার্কেট সেদিকে ভ্রূক্ষেপ করে না। সে কারণেই ব্যক্তিগত ভাবাবেগ ভূলে নির্ধারিত স্ট্র্যাটেজী অনুসরণ করে ট্রেড এন্ট্রি/এক্সিট করার কোন বিকল্প নেই।
প্রত্যাশা করি সকল সাধারন বিনিয়োগকারী উপরের পরামর্শগুলো মেনে শেয়ার ব্যবসা করবেন এবং তার মাধ্যমে সফল হবেন। সাধারন বিনিয়োগকারীরা সফল হলেই শুধুমাত্র আমাদের দেশের স্টক মার্কেট এর প্রতি জনগনের আস্থা বৃদ্ধি পাবে এবং সামগ্রিক ক্যাপিটাল মার্কেটের উন্নয়ন ঘটবে। সেটি দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের স্বার্থেই প্রয়োজন।
শফিকুল ইসলাম
অতিরিক্ত সচিব (অবঃ)
Email: msislam201386@gmail.com