১০০ পৌরসভা নিয়ে উৎকণ্ঠায় কমিশন
আপডেট: ২০১৫-১২-২৯ ১৫:০৩:২৮
আধিপত্য বিস্তার, সহিংসতা, গ্রেপ্তারের মধ্য দিয়ে গতকাল সোমবার দিবাগত রাতে পৌরসভা নির্বাচনের প্রচার শেষ হয়েছে। পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে গেছে যে, ভোটের দিন ৩০টির বেশি পৌরসভায় আওয়ামী লীগের ও বিদ্রোহী প্রার্থীর সমর্থকদের মধ্যে সহিংস ঘটনা ঘটতে পারে বলে নির্বাচন কমিশনই আশঙ্কা করছে। একই সঙ্গে কমিশন রাজশাহী ও রংপুর বিভাগের ৬৯টি পৌরসভায় জঙ্গি হামলার আশঙ্কা করছে।
পৌর নির্বাচনে শেষ মুহূর্তের প্রচারে গতকাল সোমবার দেশের বিভিন্ন এলাকায় বিক্ষিপ্ত সংঘর্ষ ও হামলার ঘটনায় প্রায় অর্ধশত ব্যক্তি আহত হয়েছেন। হুমকি পেয়েছেন বিরোধী দলের বেশ কয়েকজন মেয়র ও কাউন্সিলর প্রার্থী। দেশের বিভিন্ন স্থানে ভ্রাম্যমাণ আদালত আচরণবিধি লঙ্ঘনের অভিযোগে সাজা দিয়েছেন। এর বাইরে পুলিশের গ্রেপ্তারের সংখ্যাও গতকাল বেশি ছিল।
হামলা ও সংঘর্ষ: দেশের বিভিন্ন স্থানে বিক্ষিপ্ত সংঘর্ষে গতকাল প্রায় অর্ধশত ব্যক্তি আহত হয়েছেন। চট্টগ্রামের সাতকানিয়ায় বিএনপির মেয়র প্রার্থী রফিকুল আলম নির্বাচনের মাঠ থেকে উঠে যাওয়ার ঘোষণা দিয়ে গতকাল আবার নির্বাচনী প্রচার শুরু করে হামলার মুখে পড়েন। এতে তিনিসহ পাঁচজন আহত হন। আহত ব্যক্তিদের মধ্যে চট্টগ্রাম উত্তর জেলা বিএনপির আহ্বায়ক আসলাম চৌধুরী রয়েছেন। বিএনপির পক্ষ থেকে এ ঘটনায় আওয়ামী লীগকে দায়ী করা হয়েছে।
চন্দনাইশে এলডিপির প্রার্থী মোহাম্মদ আইয়ুবের সমর্থনে গণসংযোগের সময় উপজেলা ছাত্রলীগের যুগ্ম আহ্বায়ক মাহবুবুল আলম ও তাঁর পরিবারের ওপর হামলা চালানোর অভিযোগ পাওয়া গেছে। ওই গণসংযোগে এলডিপির চেয়ারম্যান কর্নেল (অব.) অলি আহমদ উপস্থিত ছিলেন। তবে অলি আহমদ বলেন, কে তাঁকে মেরেছে, এটা তিনি জানেন না।
রাজশাহীর নওহাটা পৌরসভায় আওয়ামী লীগের প্রার্থী আবদুল বারী খানের গণসংযোগে বোমা হামলায় সাতজন আহত হয়েছেন। স্থানীয় সাংসদ আয়েন উদ্দিন বলেছেন, পরাজয় নিশ্চিত জেনে বিএনপির প্রার্থীর লোকজন এ হামলা চালিয়েছে।
বাগেরহাট পৌরসভার বিদ্রোহী প্রার্থী মিনা হাসিবুল হাসানের প্রচারে নিয়োজিত মাইক্রোবাসে আগুন দিয়েছে দুর্বৃত্তরা। এতে গাড়ির চালক কবির শেখ আহত হয়েছেন। আওয়ামী লীগের প্রার্থী খান হাবিবুর রহমানের বিরুদ্ধে অভিযোগ তোলা হলেও তিনি তা অস্বীকার করেন। অন্যদিকে মোরেলগঞ্জে বিএনপির প্রার্থী আবদুল মজিদ হাওলাদারের বাড়িতে হামলায় তিনি ও তাঁর স্ত্রীসহ চারজন আহত হন। এই খবর সংগ্রহ করতে গেলে গাজী টিভির স্থানীয় সাংবাদিক জামাল হোসেনকে মারধর করা হয়।
জামালপুরের সরিষাবাড়ী পৌর নির্বাচনে ৯ নম্বর ওয়ার্ডের আওয়ামী লীগ ও বিএনপি-সমর্থক দুজন কাউন্সিলর প্রার্থীর কর্মীদের মধ্যে সংঘর্ষে পাঁচজন আহত হয়। পোস্টার ছেঁড়াকে কেন্দ্র করে এ সংঘর্ষ হয়। ঘটনার পর পুলিশ বিএনপির তিন কর্মীকে গ্রেপ্তার করেছে। অন্যদিকে জামালপুর পৌর নির্বাচনে বিএনপির প্রার্থী শাহ মো. ওয়ারেছ আলীর ভাইয়ের ওপর হামলা হয়েছে। শেরপুরের নালিতাবাড়ীতে আওয়ামী লীগ ও বিদ্রোহী প্রার্থীদের সমর্থকদের মধ্যে পাল্টাপাল্টি ধাওয়ায় নয়জন আহত হয়েছে। যশোরের চৌগাছায় আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী এস এম সাইফুর রহমানের গণসংযোগ চলাকালে তাঁর সমর্থকদের ওপর হামলায় তিনজন আহত হয়েছে। কুড়িগ্রামের উলিপুরে উপজেলা আওয়ামী লীগের কার্যালয়ে কে বা কারা আগুন দিয়েছে।
হুমকির অভিযোগ: খুলনার পাইকগাছা পৌরসভার বিএনপির মেয়র প্রার্থী জি এম আবদুস সাত্তার অভিযোগ করেছেন, স্থানীয় সাংসদ পাশের একটি গ্রামে অবস্থান করে বহিরাগতদের মাধ্যমে তাঁকে শাসাচ্ছেন। বাড়ি থেকে কেউ বের হতে পারছেন না। তবে সাংসদ নূরুল হক প্রথম আলোকে বলেন, ওই প্রার্থীর ভাই ব্যাংক থেকে টাকা তুলেছেন ভোট কেনার জন্য। এ জন্য কিছু লোক তাঁর বাড়ির সামনে রাস্তা আটকে বসে আছে।
পিরোজপুরের স্বরূপকাঠি পৌরসভায় বিএনপির মেয়র প্রার্থী শফিকুল ইসলামের প্রায় অর্ধশত সমর্থকের বাড়িতে গিয়ে হুমকি এবং ১০ জনের বাড়ি ভাঙচুরের অভিযোগ উঠেছে। এ ঘটনায় স্থানীয় আওয়ামী লীগ ও যুবলীগ কর্মীদের দায়ী করেছেন শফিকুল। তবে স্থানীয় আওয়ামী লীগ এসব অভিযোগ অস্বীকার করেছে।
চুয়াডাঙ্গার আলমডাঙ্গায় বিএনপির কর্মীদের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা দিয়ে হয়রানির অভিযোগ তুলেছেন ওই দলের প্রার্থী মীর মহিউদ্দিন। বরগুনার পাথরঘাটায় বিএনপির মেয়র প্রার্থী মল্লিক মোহাম্মদ আইউবকে কাফনের কাপড় পাঠিয়ে হত্যার হুমকি দেওয়া হয়েছে। শরীয়তপুরের নড়িয়ার রিটার্নিং কর্মকর্তা উদ্বেগ প্রকাশ করে অতিরিক্ত নিরাপত্তা চেয়েছেন।
গ্রেপ্তার ও সাজা: লালমনিরহাটের আদিতমারী উপজেলার ভাইস চেয়ারম্যান ও জামায়াত নেতা ফিরোজ হায়দার ওরফে লাভলুকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। বগুড়ার ধুনটে আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থীর দুই সমর্থককে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। রাজশাহীর বাঘা উপজেলার আড়ানি পৌরসভা নির্বাচনে বিএনপির দুই ওয়ার্ড সভাপতিকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে, যাঁদের একজন বিএনপি-সমর্থক প্রার্থীর পক্ষে এবং অপরজন বিএনপির বিদ্রোহী প্রার্থীর পক্ষে কাজ করছিলেন।
মৌলভীবাজারে বিএনপির সহযোগী সংগঠনের চার নেতা-কর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়। সাতক্ষীরা জেলা যুবদলের সভাপতিসহ ২৬ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। জামালপুরের সরিষাবাড়ীতে আওয়ামী লীগের মেয়র প্রার্থীর ওপর হামলার ঘটনায় বিএনপির তিন সমর্থককে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ।
সিরাজগঞ্জের রায়গঞ্জে আচরণবিধি লঙ্ঘন করায় ১১ মোটরসাইকেল চালককে জরিমানা করেছেন ভ্রাম্যমাণ আদালত। উল্লাপাড়ায় ভ্রাম্যমাণ আদালত আচরণবিধি লঙ্ঘন করায় জাকির হোসেন নামে একজন কাউন্সিলর প্রার্থীসহ ১৮ জনকে জরিমানা করেছেন। কুমিল্লার হোমনায় দুই কাউন্সিলর প্রার্থীকে জরিমানা করেছেন ভ্রাম্যমাণ আদালত।
সতর্ক করা: নির্বাচন কমিশন গতকাল সিরাজগঞ্জ-৩ আসনের আমজাদ হোসেনকে সতর্ক করেছে। সিরাজগঞ্জের রায়গঞ্জ পৌরসভার আওয়ামী লীগ প্রার্থীর প্রার্থিতা কেন বাতিল হবে না মর্মে কমিশন ছয় ঘণ্টার মধ্যে কারণ দর্শাতে বলেছে। এ ছাড়া গতকাল ময়মনসিংহের ফুলপুর ও সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে প্রত্যাহার করেছে।
শক্তিশালী বিদ্রোহী, শঙ্কায় ইসি: আগামীকাল বুধবার দেশের ২৩৪টি পৌরসভায় ভোট গ্রহণ অনুষ্ঠিত হবে। মাঠপর্যায়ের হিসাব অনুযায়ী ৫০টির বেশি পৌরসভায় আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী রয়েছেন। এর মধ্যে ৩০টির বেশি পৌরসভায় বিদ্রোহী প্রার্থীর অবস্থান দল মনোনীত প্রার্থীর চেয়ে অনেক বেশি শক্তিশালী। এসব পৌরসভার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো বরগুনা সদর, নড়াইলের কালিয়া, শরীয়তপুরের নড়িয়া, মেহেরপুরের গাংনী, ময়মনসিংহের ত্রিশাল ও ঈশ্বরগঞ্জ, যশোরের চৌগাছা ও কেশবপুর, নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁ, নরসিংদী, রাজশাহীর চারঘাট ও পুঠিয়া, মাদারীপুরের কালকিনি, কুষ্টিয়ার খোকসা ও সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুর।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে নির্বাচন কমিশনার মো. শাহনেওয়াজ প্রথম আলোকে বলেন, ঝুঁকিপূর্ণ পৌরসভাগুলোতে বিশেষ নিরাপত্তার ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
রাজশাহী-রংপুরে জঙ্গি আতঙ্ক: ৩০ ডিসেম্বরে রংপুর বিভাগের ২০টি এবং রাজশাহী বিভাগে ৪৯টি পৌরসভায় ভোট গ্রহণ করা হবে। সাম্প্রতিক জঙ্গি তৎপরতার কথা উল্লেখ করে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলেছে, নির্বাচনকে কেন্দ্র করে রাজশাহী ও রংপুর বিভাগে জঙ্গি হামলা হতে পারে। এ জন্য বিভিন্ন সমাবেশ, পথসভা ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের ওপর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থাকে বিশেষ দৃষ্টি রাখতে হবে। মন্ত্রণালয়ের গোয়েন্দা প্রতিবেদনে ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের ওপর হামলা হতে পারে বলেও আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছে।
নির্বাচন কমিশনার মো. শাহনেওয়াজ গতকাল সাংবাদিকদের বলেন, ‘ভোটারদের আশ্বস্ত করতে চাই, আমরা পর্যাপ্ত আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য মোতায়েন করেছি। আপনারা নির্বিঘ্নে নিজেদের পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দিতে পারবেন, কোনো সমস্যা হবে না।’
সানবিডি/ঢাকা/এসএস