পুনর্গঠিত কমিশনের নানা উদ্যোগে আস্থা ফিরেছে বিনিয়োগকারীদের
উৎপাদন-কর্মসংস্থান বৃদ্ধিতে পুঁজিবাজার থেকে যাচ্ছে ৯ হাজার ২৭১ কোটি টাকা
:: আপডেট: ২০২০-১২-২৪ ০৮:০৫:৩০
- বন্ড অনুমোদন পেয়েছে ১৮
- ১৫ আইপিও অনুমোদন
- রাইট অনুমোদন ২
- সূচক বেড়েছে ১০০০ পয়েন্টের বেশি
- আস্থা ফেরাতে কঠিন সিদ্ধান্ত
একটি দেশের অর্থনীতির ভিত্তি শক্তিশালী করার জন্য পুঁজিবাজার অন্যতম নিয়ামক শক্তি হিসেবে কাজ করে। অবদান রাখে দেশের শিল্পায়নে। উৎপাদন ও প্রবৃদ্ধি বাড়াতে সহযোগিতা করে পুঁজিবাজার। নতুন কমিশন দায়িত্ব নেওয়ার পর ব্যবসা সম্প্রসারণে পুঁজি সংগ্রহের জন্য প্রাথমিক গণপ্রস্তাবের (আইপিও) অনুমোদন পেয়েছে ১৫টি, রাইট অনুমোদন পেয়েছে ২টি এবং বন্ডের মাধ্যমে টাকা তোলার অনুমোদন পেয়েছে ১৮টি প্রতিষ্ঠান। সবগুলো প্রতিষ্ঠান মিলে পুঁজিবাজারের মাধ্যমে শিল্প খাতে যাচ্ছে ৯ হাজার ২৭১ কোটি ৫৫ লাখ টাকা। এই টাকা দেশের শিল্পায়ন এবং কর্মসংস্থানের উন্নয়নের জন্য ব্যবহার করবে কোম্পানি। সংশ্লিষ্টরা বলেন, দেশের অর্থনীতির উন্নয়নের জন্য অনেক বড় ভূমিকা রাখতে পারে দেশের পুঁজিবাজার। পুঁজিবাজার দেশের শিল্পায়নের অক্সিজেন হিসেবে কাজ করে। বিনিয়োগকারীদের অংশীদারিত্ব দেওয়ার মাধ্যমে বাজার থেকে পুঁজি সংগ্রহ করে। এর মাধ্যমে কোম্পানিগুলো ব্যবসা সম্প্রসারণ করে। ফলে উৎপাদন ক্ষমতা বৃদ্ধি পায় প্রতিষ্ঠানের। কোম্পানি বড় হলে তৈরি হয় নতুন কর্মসংস্থান। যার সামগ্রীক প্রভাব পড়ে দেশের অর্থনীতির উন্নতির।
তাদের মতে, পুনর্গঠিত কমিশন দায়িত্ব নেওয়ার পর সমানভাবে গুরুত্ব দিয়ে সব কাজকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। শিল্পায়নে মুলধন সরবারহ করার সাথে সাথে দীর্ঘদিনের আস্থার সঙ্কট দূর করে পুঁজিবাজারকে ইতিবাচক ধারায় ফিরিয়ে আনা ছিল বিএসইসির সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। আপাতত তারা এই বিষয়ে সফল। পুঁজিবাজার সংশ্লিষ্ট স্টেকহোল্ডারদের সহযোগিতায় বিএসইসি এ চ্যালেঞ্জ মোকাবিকলা করতে সক্ষম হয়েছে। ইতোমধ্যে এর প্রমাণও মিলেছে। করোনা মহামারির মধ্যেও গত আগস্টে সবচেয়ে ভালো পারফরম্যান্স করে বিশ্বসেরা খেতাব পেয়েছে দেশের পুঁজিবাজার। ওই সময়ে পুঁজিবাজারে ১৫.৮০ শতাংশ উত্থান হয়েছে।
বাজার বিশ্লেষণে দেখা গেছে, পুঁজিবাজারের ধারাবাহিক পতনে সাধারণ বিনিয়োগকারী যখন দিশেহারা, ঠিক তখনই শুরু হয় করোনা মহামারি। ২৬ মার্চ বন্ধ হয়ে যায় পুঁজিবাজার। ৬৬ দিন পর গত ৩১ মে ফের পুঁজিবাজারে লেনদেন শুরু হয়। ওই দিন লেনদেন শুরুর পর থেকে গত ৬ মাসে পর্যন্ত মাসে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে (ডিএসই) বেড়েছে সূচক ও লেনদেন। এ সময়ে ডিএসইএক্স সূচক বেড়েছে ১০০০ পয়েন্টের বেশি। ৩১ মে ডিএসই’র প্রধান সূচক ডিএসইএক্স ছিল ৪০৬০ পয়েন্টে। ১৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫১২৩.০৬ পয়েন্টে। একইভাবে গত ৬ মাসে ডিএসই’র লেনদেন বেড়েছে ৮০০-৯০০ কোটি টাকার বেশি। তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোর বাজার মূলধনও বেড়েছে অনেক।
দায়িত্ব নেওয়ার পর নতুন কমিশন সুশাসন ফেরাতে আইন সংস্কার ও অনিয়মের বিরুদ্ধে কড়া অবস্থান নেয়। দুর্বল ও লোকসানে থাকা কোম্পানিতে স্বচ্ছতা আনতে প্রশাসক বসানো এবং ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ পরিবর্তনেরও নির্দেশনা জারি করা হয়। এছাড়া, পুঁজিবাজারে সুশাসন প্রতিষ্ঠার জন্য জিরো টলারেন্স নীতিতে ফ্রিজ করেছে অনেক কোম্পানির চেয়ারম্যান, ব্যবস্থাপনা পরিচালক, পরিচালকদের বিও হিসেবে থাকা শেয়ার। বাংলাদেশ ব্যাংকের মাধ্যমে জব্দ করা হয়েছে অনেকের ব্যাংক হিসাব। এর বাইরেও পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোর উদ্যোক্তা ও পরিচালকদের ন্যূনতম ২ শতাংশ এবং সম্মিলিতভাবে ৩০ শতাংশ শেয়ার ধারণের বাধ্যবাধকতা নিশ্চিত করা হয়।
পাশাপাশি বন্ড মার্কেটকে গতিশীল করতে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সঙ্গে বৈঠক করে কর সুবিধা বাড়ানো, রাষ্ট্রায়ত্তসহ সকল ব্যাংকের পুঁজিবাজারে বিনিয়োগের তাগিদ বৃদ্ধি করা, ব্যাংকের নগদ লভ্যাংশ সেপ্টেম্বরের আগে না দেওয়ার সিদ্ধান্ত থেকে ফেরাতে বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে আলোচনা করা, ইনভেস্টমেন্ট করপোরেশন অব বাংলাদেশকে (আইসিবি) শক্তিশালী করা, সুশাসন প্রতিষ্ঠায় করপোরেট গভর্ন্যান্স শক্তিশালী করা, জেড ক্যাটাগরি কোম্পানিগুলোর জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা, পুঁজিবাজারের জন্য ১৫ হাজার কোটি টাকার তহবিল গঠনের উদ্যোগ, ভার্চুয়াল পদ্ধতিতে বিভিন্ন ধরনের সভার করার অনুমোদন, আইপিও প্রক্রিয়া সহজ করা, ইউনিয়ন পর্যায়ে ও বিদেশে ব্রোকার হাউজের শাখা খোলার অনুমোদন, পুঁজিবাজারকে ডিজিটালাইজ করা, পুঁজিবাজারের উন্নয়নে সাংবাদিকদের সাথে যোগিযোগ বৃদ্ধিসহ আরও অনেক ইতিবাচক সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিএসইসি।
এ বিষয়ে বিএসইসি’র চেয়ারম্যান অধ্যপক শিবলী রুবাইয়াত-উল-ইসলাম বলেছেন, ‘দায়িত্ব নেওয়ার পর বিনিয়োগকারীদের আস্থা ও সুশাসন ফেরানোর ওপর জোর দেওয়া হয়। বিনিয়োগকারীর স্বার্থকে প্রাধ্যান্য দিয়ে পুঁজিবাজারের আইন-কানুন প্রণয়ন করা হচ্ছে। বিনিয়োগকারীর জমানো মূলধন কেউ যেন খেয়ে ফেলতে না পারে, সে বিষয়ে জোর দেওয়া হচ্ছে। আস্তে আস্তে আস্থা বাড়ছে। সুশাসন প্রতিষ্ঠার আশ্বাস পাওয়ায় বিনিয়োগকারীরা পুঁজিবাজারে ফিরছেন।’
এ বিষয়ে বাংলাদেশ এসোসিয়েশন অব পাবলিকলি লিষ্টেড কোম্পানিজের (বিএপিএলসি) সভাপতি আজম জে. চৌধুরী বলেন, অর্থনীতির উন্নয়নের জন্য পুঁজিবাজার অনেক বড় ভূমিকা রাখতে পারে। দেশের অর্থনীতির উন্নয়নের স্বার্থে বড় বড় প্রকল্পের টাকা পুঁজিবাজার থেকে সংগ্রহ করা প্রয়োজন।
এ বিষয়ে এএফসি ক্যাপিটালের প্রধান নির্বাহি কর্মকর্তা মাহবুব এইচ মজুমদার সানবিডিকে বলেন, নতুন কমিশন দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফেরাতে নিরলসভাবে কাজ করছেন। একদিকে বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফেরাতে কাজ করছেন। অন্যদিকে দেশের শিল্পায়ন ও কর্মস্থান বৃদ্ধিতে যাতে পুঁজিবাজার অবদান রাখতে পারে সেই দিকে নজর রাখছেন। তার মতে,কোম্পানিগুলো পুঁজিবাজার থেকে পুঁজি নিয়ে ব্যবসা সম্প্রসারণ করতে পারে। এর ফলে বাড়বে কোম্পানির উৎপাদন ক্ষমতা। যার প্রভা পড়বে দেশের কর্মস্থান বৃদ্ধিতে।
বিএসইসি সূত্র মতে, ১৫টি কোম্পানির মধ্যে সব চেয়ে বেশি পুঁজি সংগ্র করছে রবি আজিয়াটা। কোম্পানিটি পুঁজিবাজার থেকে ৫২৩ কোটি ৭৯ লাখ ৩৩ হাজার ৩৪০ টাকা উত্তোলন করবে।
দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে এনার্জিপেক পাওয়ার জেনারেশন লিমিটেড এবং লুব্রিফ (বাংলাদেশ) লিমিটেড। কোম্পানি দুটি পুঁজিবাজার থেকে আইপিওর মাধ্যমে ১৫০ কোটি টাকা করে উত্তোলন করবে।
আইপিওর মাধ্যমে অর্থ উত্তলনের দিক থেকে তৃতীয় অবস্থানে রয়েছে মীর আক্তার হোসাইন লিমিটেড। কোম্পানিটি পুঁজিবাজার থেকে ১২৫ কোটি টাকা উত্তোলন করবে।
চতুর্থ অবস্থানে রয়েছে দেশের চতুর্থ প্রজন্মের ব্রাংক এনআরবিসি কমার্শিয়ার ব্যাংক লিমিটেড। কোম্পানিটি পুঁজিবাজার থেকে ১২০ কোটি টাকা উত্তোলন করার জন্য অনুমোদন পেয়েছে।
পঞ্চম অবস্থানে রয়েছে দেশের ইলেক্ট্রকিন পণ্য উৎপাদনে জায়ান্ট কোম্পানি ওয়াল্টন হাইটেক ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড।কোম্পানিটি পুঁজিবাজার থেকে ১০০ কোটি টাকা উত্তোলন করার জন্য অনুমোদন পেয়েছে।
এছাড়াও ইন্ডেক্স এগ্রো ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড ৫০ কোটি টাকা,এসোসিয়েট অক্সিজেন ১৫ কোটি টাকা,এএফসি হেলথ্ ১৭ কোটি টাকা,ডমিনেজ স্টিল বিল্ডিং সিস্টেম ৩০ কোটি টাকা,ক্রিস্টাল ইন্সুরেন্স ১৬ কোটি টাকা এবং তৌফিকা ফুডস এন্ড এগ্রো ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড ৩০ কোটি টাকা, সোঁনালী লাইফ ইন্সুরেন্স ১৯ কোটি টাকা, দেশ জেনারেল ইন্সুরেন্স ১৬ কোটি টাকা পুঁজিবাজার থেকে উত্তোলন করার অনুমোদন পেয়েছে।
রাইট অনুমোদন: পুঁজিবাজারের তালিকাভুক্ত দুটি কোম্পানিকে অগ্রাধিকামূলক শেয়ারের (রাইট) মাধ্যমে ৭৭ কোটি ৭৬ লাখ ৫০ হাজার ৭৭৫ টাকা তুলার অনুমোদন দিয়েছে কমিশন। এর মধ্যে প্রগতি লাইফ ইন্স্যুরেন্সের ২৩ কোটি ২ লাখ ৭৩ হাজার ২৬৫ টাকা সংগ্রহ করেছে। অন্য দিকে ন্যাশনাল পলিমার ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের রাইট শেয়ার ইস্যুর ৫৪ কোটি ৭৩ লাখ ৭৭ হাজার ৫১০ টাকা মূলধন সংগ্রহ করবে। এই টাকা দিয়ে ন্যাশনাল পলিমার ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডেরউৎপাদন ক্ষমতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে জমি ক্রয় ও উন্নয়ন, মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানী, কার্যকরী মূলধন সংগ্রহ এবং ব্যাংক ঋন পরিশােধ এর লক্ষ্যে রাইটস শেয়ার ইস্যুর সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে।
বন্ড: পুঁজিবাজারের তালিকাভুক্ত ও তালিকাভুক্ত নয় এমন ১৮টি কোম্পানি বন্ড ইস্যু করেছে। এর মাধ্যমে কোম্পানিগুলো ৭ হাজার ৮১৭ কোটি টাকা তুলেছে। এই বন্ডে বিনিয়োগ করেছে সরকারি আর্থিক প্রতিষ্ঠান, মিউচুয়াল ফান্ড, ইসুরেন্স কোম্পানি, তালিকাভুক্ত ব্যাংক, সমবায় ব্যাংক, আঞ্চলিক রুরাল ব্যাংক, সংগঠন, ট্রাষ্ট, স্বায়ত্তশাসিত কর্পোরেশনসহ অন্যান্য যোগ্য বিনিয়োগকারীদেরকে প্রাইভেট প্লেসমেন্টের মাধ্যমে ইস্যু করা হবে।