শিশুর প্রধান তিনটি কিডনি রোগ
সান বিডি ডেস্ক প্রকাশ: ২০২১-০৩-০৬ ১৮:৫৬:৪৭
শিশুর নেফ্রোটিক সিনড্রোম
নেফ্রোটিক সিনড্রোমে আক্রান্ত শিশুদের প্রস্রাবে অত্যধিক পরিমাণ প্রোটিন বেরিয়ে যায়। রক্তে অ্যালবুমিনের নিম্নমানের সঙ্গে সিরাম লিপিডের পরিমাণ বেশি থাকে। শিশুর পুরো শরীর ফুলে যায়।
কারণ : শিশুদের নেফ্রোটিক সিনড্রোম ও বড়দের নেফ্রোটিক সিনড্রোমের কারণগুলোর মধ্যে যথেষ্ট পার্থক্য রয়েছে। শিশুদের নেফ্রোটিক সিনড্রোমের ৯০ শতাংশ প্রাথমিক কারণে হয়, যাকে ইডিয়োপ্যাথিক নেফ্রোটিক সিনড্রোম বলে। মাত্র ১০ শতাংশ সেকেন্ডারি কারণে হয়ে থাকে। তবে শিশুদের কিডনি রোগ পুরো ভালো হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা বড়দের তুলনায় বেশি।
লক্ষণ : প্রথম দিকে দুই চোখের পাতা ফুলে যাওয়া, মুখে ফোলা ফোলা ভাব দেখা যায়। এরপর দু-তিন দিনের মধ্যে পেটে, হাতে-পায়ে পানি আসে এবং সারা গা ফুলে থাকে। ছেলেদের অণ্ডকোষে পানি জমতে পারে। কখনো প্রস্রাবের পরিমাণ কমে যায়, তবে রং স্বাভাবিক থাকে। শিশুর প্রস্রাব জ্বাল দিলে প্রোটিনের পুরুত্বের স্তর পাওয়া যায়।
চিকিৎসা : জটিলতাপূর্ণ শিশু কিডনি রোগীকে হাসপাতালে ভর্তি করে শিশু বিশেষজ্ঞ দ্বারা চিকিৎসা করাতে হবে। শিশুদের নেফ্রোটিক সিনড্রোমের চিকিৎসা শিশু চিকিৎসকের তত্ত্বাবধানে ওষুধ সঠিক ডোজ ও নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত সেবন করানো চাই। চিকিৎসার পরও ঘন ঘন ফোলা হওয়া শিশু নেফ্রোটিক সিনড্রোমের একটা বিশেষত্ব, তাতে ভয়ের কিছু নেই।
অ্যাকিউট নেফ্রাইটিস
এই রোগে বিভিন্ন কারণে কিডনির প্রদাহ হয়ে থাকে, কিডনির কার্যক্ষমতা কমে য়ায়। ৯০ থেকে ৯৫ শতাংশ ক্ষেত্রে শিশু সম্পূর্ণ ভালো হয়ে যায়। তবে সময় নষ্ট না করে সুচিকিৎসা দিতে হবে।
কারণ : প্রধানত স্কুলগামী ছেলে-মেয়েদের এই রোগ হয়ে থাকে। শিশুর শরীরে খোস-পাঁচড়া দেখা দেওয়ার কিংবা গলা ব্যথা হওয়ার ১০ থেকে ২১ দিন পর সাধারণত এই রোগ প্রকাশ পায়। সচরাচর স্টেপট্রোককাই নামের ব্যাকটেরিয়া চামড়ার খোস-পাঁচড়া কিংবা গলা ব্যথার কারণ হলে এই বিপত্তি ঘটে। তবে অন্য অনেক ব্যাকটেরিয়া, ভাইরাস বা অন্য সংক্রমণ থেকেও কিডনি প্রদাহজনিত এই রোগ হতে পারে। গরমকালে সচরাচর খোস-পাঁচড়া থেকে এবং শীতকালে সোর থ্রোট বা গলায় ব্যথা থেকে স্টেপট্রো ব্যাকটেরিয়া সংক্রমণ পরবর্তী সময়ে অ্যাকিউট নেফ্রাইটিস হয়ে থাকে।
লক্ষণ : হঠাৎ করে চোখ, মুখ, পা ফুলে যাওয়া, সঙ্গে প্রস্রাব বন্ধ হয়ে যাওয়া কিংবা পরিমাণ খুব কম হওয়া। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে প্রস্রাবের রং লাল থাকে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে চামড়ায় খোস-পাঁচড়া জাতীয় চিহ্ন থাকে। শিশুর রক্তচাপ বেশি থাকতে পারে। কখনো কখনো অ্যাকিউট নেফ্রাইটিস জটিলভাবে প্রকাশ পায়। তখন শ্বাসকষ্ট, মাথা ব্যথা, চোখে ঝাপসা দেখা, খিঁচুনি ইত্যাদি দেখা দেয়। এসব ক্ষেত্রে শিশুর জীবন রক্ষার জন্য তাত্ক্ষণিক ব্যবস্থাপত্র দিতে হবে।
চিকিৎসা : শিশুর জটিলতা, যেমন—শ্বাসকষ্ট, চোখে ঝাপসা দেখা, বমি, মাথা ব্যথা, খিঁচুনি ও খুব কম প্রস্রাব ইত্যাদি দেখা দিলে জরুরি ভিত্তিতে শিশু বিশেষজ্ঞের শরণাপন্ন হওয়া উচিত। প্রথম দু-এক সপ্তাহ শিশুকে বিশ্রামে রাখা এবং শিশুর খাবারে লবণ বর্জন করতে হবে। পটাসিয়ামযুক্ত খাবার বর্জনীয়, যেমন—ডাব, কলা, ফ্রুট জুস ইত্যাদি। আমিষজাতীয় খাবার যেমন—ডিম, মাছ, মাংস, দুধ সাময়িকভাবে বাদ দিতে হবে। তবে খাবারের মধ্যে আলু, ভাত, চিড়া, মুড়ি, মাখন, পাউরুটি, চিনি খেতে পারবে। প্রস্রাবের পরিমাণ স্বাভাবিকে না আসা পর্যন্ত শিশু বিশেষজ্ঞের পরামর্শ মেনে পানি বা জলীয় পদার্থ দৈনিক শিশুকে পান করাতে পারবে, বেশি নয়।
মূত্রতন্ত্রের সংক্রমণ
মূত্রতন্ত্রের সংক্রমণ বা ইউটিআইয়ে আক্রান্ত হয় উল্লেখযোগ্যসংখ্যক শিশু। এক বছর বয়স পর্যন্ত ছেলে ও মেয়ে উভয়ের ক্ষেত্রে এই ইনফেকশনে ভোগার আশঙ্কা সমান। মেয়েশিশুর ক্ষেত্রে এই ঝুঁকি বেশি।
কারণ : ৭৫ থেকে ৯০ শতাংশ সংক্রমণ ঘটে থাকে ই-কোলাই নামের ব্যাকটেরিয়ার কারণে। শিশুর রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম থাকলে, যেমন—অপুষ্টিতে ভোগা কিংবা ডায়াবেটিসে আক্রান্ত শিশু, কিডনি, মূত্রনালি, মূত্রথলি ইত্যাদি হয়ে প্রস্রাব নির্গমনের প্রবাহপথে কোনো বাধা; পাথর তৈরি হওয়া কিংবা প্রস্রাব জমে থাকার কারণে মূত্রতন্ত্রের সংক্রমণ হওয়ার সুযোগ বৃদ্ধি পায়। তখন জমে থাকা প্রস্রাব ব্যাকটেরিয়াগুলোর বংশবৃদ্ধিতে উত্কৃষ্ট মাধ্যম হিসেবে কাজ করে।
লক্ষণ : ইনফ্যান্ট অর্থাৎ এক বছর বয়স পর্যন্ত শিশুর মূত্রতন্ত্রের সংক্রমণ—শিশুর জ্বর, ওজন কমে যাওয়া, শিশুর স্বাভাবিকভাবে বেড়ে না ওঠা, বমি ভাব, বমি, ডায়রিয়া কিংবা জন্ডিস এসব লক্ষণ নিয়ে প্রকাশ পায়। অজ্ঞাত জ্বরে আক্রান্ত শিশুদের এক বিরাট অংশ ইউটিআইয়ে ভুগছে বলে দেখা গেছে। এসব কারণে কোনো শিশুর জ্বর হলে, বিশেষ করে মেয়েদের বেলায় যথাক্রমে ইউরিন কালচার ও প্রস্রাবের রুটিন পরীক্ষা করা উচিত। বড় শিশুর বেলায় মূত্রতন্ত্রের সংক্রমণ—ঘন ঘন প্রস্রাব, প্রস্রাব ধরে রাখতে না পারা, নতুন করে বিছানায় প্রস্রাবের অভ্যাস দেখা দেওয়া, পেট ব্যথা কিংবা দুর্গন্ধযুক্ত প্রস্রাব—এসব উপসর্গের সাহায্যে বোঝা যায়। কখনো বা প্রস্রাবে রক্ত যেতে পারে।
চিকিৎসা : একবার মূত্রতন্ত্রের সংক্রমণে আক্রান্ত শিশুরোগীর এক বিরাট অংশ কিছুদিন পর পর বারবার ওই ইনফেকশনে ভোগার আশঙ্কায় থাকে। বারবার মূত্রতন্ত্রের সংক্রমণে শিশু আক্রান্ত হলে এমসিইউ, আল্ট্রাসনোগ্রাফির মতো পরীক্ষার সাহায্য নিয়ে মূত্রতন্ত্রের গঠনগত কোনো একটি ত্রুটি আছে কি না কখনো কখনো তা খতিয়ে দেখার প্রয়োজন দেখা দেয়। শিশুর পায়খানায় কষা ভাব থাকলে তা দূর করতে হবে।
(অধ্যাপক ডা. প্রণব কুমার চৌধুরী, সাবেক বিভাগীয় প্রধান, শিশু স্বাস্থ্য বিভাগ, চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল)