মেরাজ কি সশরীরে হয়েছে?
সান বিডি ডেস্ক প্রকাশ: ২০২১-০৩-১১ ১২:০৬:০২
ইসলামী আকিদা সমূহের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ একটি আকিদা হলো রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাই সাল্লাম এর মিরাজ। যার শুরু মক্কা থেকে বায়তুল মুকাদ্দাস এবং সেখান থেকে আসমান পর্যন্ত।
আর এই সফরটি সশরীরে জাগ্রত অবস্থায় হয়েছে এর ওপর আকীদা পোষণ করা ওয়াজিব। কিন্তু অত্যন্ত দুঃখজনক হলেও সত্য কিছু কিছু মানুষ এই মহাসত্যকে বিভিন্ন যুক্তির আলোকে অস্বীকার করার অপপ্রয়াস চালাচ্ছে ।তারা সশরীরে জাগ্রত অবস্থায় মেরাজ করাকে অস্বীকার করছে এবং বলছে মিরাজ স্বপ্নের মাধ্যমে হয়েছে।
প্রিয় পাঠক! আমার এই প্রবন্ধের রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাই সাল্লাম এর মিরাজ জাগ্রত অবস্থায় হয়েছে কোরআন হাদিসের আলোকে তা তাত্ত্বিক উপস্থাপনের প্রয়াস পাব ইনশাআল্লাহ।
সূরা বানী ইস্রাইল আল্লাহ তাআলা এরশাদ করেন
১৭:১ سُبۡحٰنَ الَّذِیۡۤ اَسۡرٰی بِعَبۡدِهٖ لَیۡلًا مِّنَ الۡمَسۡجِدِ الۡحَرَامِ اِلَی الۡمَسۡجِدِ الۡاَقۡصَا الَّذِیۡ بٰرَکۡنَا حَوۡلَهٗ لِنُرِیَهٗ مِنۡ اٰیٰتِنَا ؕ اِنَّهٗ هُوَ السَّمِیۡعُ الۡبَصِیۡرُ ﴿۱﴾
পবিত্র মহান সে সত্তা, যিনি তাঁর বান্দাকে রাতে নিয়ে গিয়েছেন আল মাসজিদুল হারাম থেকে আল মাসজিদুল আকসা* পর্যন্ত, যার আশপাশে আমি বরকত দিয়েছি, যেন আমি তাকে আমার কিছু নিদর্শন দেখাতে পারি। তিনিই সর্বশ্রোতা, সর্বদ্রষ্টা।
শরহে আকাইদ এসেছে
معراج النبي صلى الله عليه وسلم عن جسده الشريف في اليقظة حق (شرح العقائد)
প্রথম দলিল:
সুবহানা শব্দটি এই কথার প্রমাণ যে মিরাজ কোন স্বপ্ন বা কাশফের মতো সাধারন ঘটনা বা বিষয় নয়। কারণ সুবহানা শব্দটি আশ্চর্য বিষয়ের জন্য ব্যবহার করা হয়।আর মিরাজ যদি স্বপ্নে হতো তাহলে আশ্চর্যের কোন বিষয় হতো না।যেহেতু সুবহানা শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছ তাই সুস্পষ্ট ভাবে বোঝা যাচ্ছে যে মিরাজ স্বশরীরে স্বপ্নের মাধ্যমে নয়।
দ্বিতীয় দলিল:
আয়াতে এসরা শব্দ ব্যবহার হয়েছে। আর এসরা শব্দটি জাগ্রত অবস্থায় সফর করাকে বলা হয়।
যেমন হযরত লুত আ: সম্পর্কে এরশাদ হয়েছে।
১৫:৬৫ فَاَسۡرِ بِاَهۡلِکَ بِقِطۡعٍ مِّنَ الَّیۡلِ وَ اتَّبِعۡ اَدۡبَارَهُمۡ وَ لَا یَلۡتَفِتۡ مِنۡکُمۡ اَحَدٌ وَّ امۡضُوۡا حَیۡثُ تُؤۡمَرُوۡنَ ﴿۶۵﴾
‘সুতরাং তুমি তোমার পরিবার নিয়ে বেরিয়ে পড় রাতের একাংশে, আর তুমি তাদের পেছনে চল, আর তোমাদের কেউ পেছনে ফিরে তাকাবে না এবং যেভাবে তোমাদের নির্দেশ করা হয়েছে সেভাবেই চলতে থাকবে’।
মুসা আলাই সাল্লাম কে আল্লাহ তায়ালা হুকুম দেন।
وَ لَقَدۡ اَوۡحَیۡنَاۤ اِلٰی مُوۡسٰۤی ۬ۙ اَنۡ اَسۡرِ بِعِبَادِیۡ فَاضۡرِبۡ لَهُمۡ طَرِیۡقًا فِی الۡبَحۡرِ یَبَسًا ۙ لَّا تَخٰفُ دَرَکًا وَّ لَا تَخۡشٰی ﴿۷۷﴾
আর আমি অবশ্যই মূসার কাছে ওহী প্রেরণ করেছিলাম যে, ‘আমার বান্দাদেরকে নিয়ে রাতের বেলায় রওয়ানা হও। অতঃপর সজোরে আঘাত করে তাদের জন্য শুকনো রাস্তা বানাও। পেছন থেকে ধরে ফেলার আশংকা করো না এবং ভয়ও করো না’।
মূসা আলাইহিস সালামকে আল্লাহর নির্দেশ দেন
৪৪:২৩ فَاَسۡرِ بِعِبَادِیۡ لَیۡلًا اِنَّکُمۡ مُّتَّبَعُوۡنَ ﴿ۙ۲۳﴾
(আল্লাহ বললেন) ‘তাহলে আমার বান্দাদের নিয়ে রাতে বেরিয়ে পড়; নিশ্চয় তোমাদের পশ্চাদ্ধাবন করা হবে’।
উল্লেখিত আয়াতসমূহে এসরা শব্দটি দেহ ও আত্মা সমষ্টিকে বলা হয়েছে।
কাজী আইয়াজ বলেছেন যে لانہ لایقال فی النوم اسریٰ (شفاص 191) এসরা স্বপ্নে বা ঘুমানো অবস্থায় সফর করাকে এসরা বলা হয় না। হয় দেহ আত্মার মাধ্যমে সফর করাকে।
তৃতীয় দলিল:
আয়াতে আবদু শব্দ বলা হয়েছে আর আব্দু বলা হয় রুহের সমষ্টিকে। যেমন তাফসীরে ইবনে কাসীরে বলা হয়েছে(عبد) فان العبد عبارۃ عن مجموع الروح و الجسد(تفسیر ابن کثیر )
আদদু বলা হয় রুহ দেহের সমষ্টিকে।
যে আত্মার সাথে দেহ নেই তাকে আব্দুল বলা হয় না। এ থেকে স্পষ্ট হয়ে বুঝা যায় মিরাজ স্বপ্নের মাধ্যমে নয় বরং স্বশরীরে হয়েছে।
এই তিনটি দলিল সুরা বনি ইসরাইল থেকে সাব্যস্ত হয়েছে।
চতুর্থ দলিল:
চতুর্থ নম্বর দলিলটি ও কুরআন থেকে সাব্যস্ত হয়েছে যেমন সূরা নাজমে বলা হয়েছে
ما ذا غ البصر و ما طغی
অর্থাৎ যা কিছু দেখেছেন স্বচক্ষে দেখেছেন। স্বপ্নে বা কাশফের মাধ্যমে দেখেন নাই। আর বাছর শব্দটি শারীরিক বৃষ্টির জন্য আসে। স্বপ্নে দেখার জন্য বলা হয় না।এর থেকে স্পষ্ট প্রমাণ হয় যে মিরাজ স্বশরীরে জাগ্রত অবস্থায় হয়েছে।
পঞ্চম দলিল:
উল্লেখিত আয়াতের তাফসীর হযরত ইবনে আব্বাস রা: এইভাবে করেছেন
”حدثنا الحميدي حدثنا سفيان حدثنا عمرو عن عكرمة عن ابن عباس رضي الله عنهما وما جعلنا الرؤيا التي أريناك إلا فتنة للناس قال هي رؤيا عين أريها رسول الله صلى الله عليه وسلم ليلة أسري به إلى بيت المقدس قال والشجرة الملعونة في القرآن قال هي شجرة الزقوم“ (صحيح البخاری كتاب مناقب الأنصار باب المعراج روایت نمبر 3888)
হযরত ইবনে আব্বাস থেকে বর্ণিত وما جعلنا الرؤيا التي أريناك إلا فتنة للناس
এখানে রুয়াত দ্বারা উদ্দেশ্য চোখে দেখা যা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে মিরাজের রাত্রিতে দেখানো হয়েছে।
ষষ্ঠ দলিল:
বুখারী শরীফে এসরা অধ্যায়ে হযরত জাবের রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু থেকে বর্ণিত হাদীস দ্বারা প্রমাণ হয় যে মিরাজ স্বশরীরে হয়েছে।
سمعت رَسُولَ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم يَقُولُ “ لَمَّا كَذَّبَنِي قُرَيْشٌ قُمْتُ فِي الْحِجْرِ، فَجَلاَ اللَّهُ لِي بَيْتَ الْمَقْدِسِ، فَطَفِقْتُ أُخْبِرُهُمْ عَنْ آيَاتِهِ وَأَنَا أَنْظُرُ إِلَيْهِ ”.
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে বলতে শুনেছেন, যখন (মিরাজের ব্যাপারে) কুরাইশরা আমাকে অস্বীকার করল, তখন আমি কা’বা শরীফের হিজর অংশের দাঁড়ালাম। আল্লাহ তাআলা তখন আমার সম্মুখে বায়তুল মুকাদ্দাসকে প্রকাশ করে দিলেন, যার ফলে আমি দেখে দেখে বায়তুল মুকাদ্দাসের নিদর্শনগুলো তাদের কাছে বর্ণনা করছিলাম।
এই হাদীস থেকে বোঝা যায় মক্কার কাফেররা স্শরীরে মিরাজকে অস্বীকার করেছিল অন্যথায় স্বপ্নকে অস্বীকার করার মত কেউ ছিলনা। কারণ স্বপ্নে অনেক সময় সাধারণ মানুষ নিজেকে উড়তে এবং আকাশে যেতে দেখে এটি অবাক করার কিছুই নয় এতে কেউ আশ্চর্য হয়না কাফেররা আশ্চর্য তখনই হয়েছিল যখন রসূল সাল্লাল্লাহু সাল্লাম বলেছিলেন যে আমি সশরীরে জাগ্রত অবস্থায় ভ্রমণ করেছি। কাফেরদের এই অস্বীকার করায় প্রমাণ যে মিরাজ স্বশরীরের জাগ্রত অবস্থায় হওয়ার দাবি করেছেন।
সপ্তম দলিল:
এ হাদীস প্রসঙ্গে বায়হাকী শরীফ এর বরাত দিয়ে বলা হয়েছে।
কাফেররা আবু বকর রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহুর কাছে ওই রাত্রে সফরের কথা উল্লেখ করল তখন তিনি তার সত্যায়ন করলেন।বললেন যে তিনি সত্য বলেছেন।তখন কাফেররা আশ্চর্য হয়ে বলল যে একরাতে শামমে বাইতুল মুকাদ্দাস, আসমান জান্নাত, জাহান্নাম ভ্রমণ করেছে বলে বলছে তারপরেও কি তুমি সত্যায়ন করছো।তখন তিনি বললেন আমি এর চেয়েও আরো অসম্ভব কথা কেউ বিশ্বাস করি সত্যায়ন করি।
চিন্তা করার বিষয় স্বপ্নে ভ্রমন করার বিষয়ে আশ্চর্য হওয়ার কারণ নেই।আশ্চর্য তো তখনই হয়েছিল যখন বলা হয়েছিল সশরীরে জাগ্রত অবস্থায় এই ভ্রমণটি হয়েছে।
অষ্টম দলিল:
এই হাদিস প্রসঙ্গে মুসনাদ আবু ইয়ালী ফাতহুল-বারীতে বলেছেন। উম্মে হানী বলেছেন যে যখন কাফেররা বাইতুল মুকাদ্দাস সম্পর্কে প্রশ্ন করে করেছিল। আর তিনি তা দেখে দেখে তার উত্তর দিচ্ছিলেন। কাফেররা প্রশ্ন করল আমাদের একটিি কাফেলা সাম থেকেে ফিরছে তাদের সাথে তোমার কোথায় দেখা হয়েছে।তারাা কোথায় আছে। তখন তিনি তাদের নির্দিষ্ট স্থানের কথা বললেন এবং তাদের একটি উট হারিয়ে গিয়েছে একথা বললেন আর ওই কাফেলায় কতজন ছিলেন তাদের সংখ্যা বলে দিলেন।
অর্থাৎ এই কথা দ্বারা স্পষ্ট হয় যে কাফেরদের সশরীরে জাগ্রত অবস্থায় সফর সম্পর্কে অভিযোগ সন্দেহ ছিল। স্বপ্নে সফর করার ব্যাপারেে নয়। কারণ স্বপ্নে ভ্রমন করাকে কেউ কখনো আপত্তির দৃষ্টিতে দেখে না।
নবম দলিল:
রাসূল সাল্লাল্লাহু সাল্লাম কে আসমানের ভ্রমণের পূর্বে বায়তুল মুকাদ্দাস পর্যন্ত ভ্রমণ করানো হয়েছে। অর্থাৎ কিছু জমিনে সফর করানো হয়েছে আর বাকিটুকু আসমানে। কারণ আসমানের সফর যদি খানায়ে কাবা থেকে শুরু করা হতো তাহলে কাফেররা একেবারেই বা সরাসরি অস্বীকার করে দিত। এটিকে সত্য বলে সাব্যস্ত করা যেতো না। যখন বাইতুল মুকাদ্দাসের অবস্থা আর তাদের কাফেলার অবস্থান বলে দিল। তখন তারা তা অস্বীকার করতে পারল না। তাকে সঠিক মানতে হলো। এর জন্য এই সফর করানো হয়েছে যাতে করে দ্বিতীয় সফর যা আসমানে হয়েছে তারও যেন সত্যায়ন করে।আর যদি এই ভ্রমণ স্বপ্নে হতো তাহলে তার সত্যায়নের প্রয়োজন ছিল না।
দশম দলিল:
তাফসীরে ইবনে কাসির আবু সুফিয়ান রা: এর ঘটনা বর্ণিত হয়েছে আবু সুফিয়ান বলেন আমাদেরকে রুমের বাদশা তার দরবারে তলব করে।তখনো আবু সুফিয়ান মুসলমান হন নি।আবু সুফিয়ান বলেন আমি কায়সারে রুমের সাথে কথা বলতে বলতে এক পর্যায়ে বলি যদিও মোহাম্মদ ইতিপূর্বে মিথ্যা বলেননি কিন্তু এখন এমন এক কথা বলেছে জা কে সত্য সাব্যস্ত করা যায় না। সে বলে যে এক রাতে খানায়ে কা’বা থেকে বাইতুল মুকাদ্দাস পর্যন্ত সফর করে এবং ফিরে যায়।কাইসারে রুমের দরবারে একজন পাদ্রী বসে ছিল। পাদ্রী তৎক্ষণাৎ বলে সে রাত্রের কথা আমি জানি।কাইসারে রুম বলে, বল সে রাতের কথা তখন পাদ্রী বলে আমি প্রতিদিন মসজিদে বাইতুল মুকাদ্দাসের দরজা বন্ধ করে দিয়ে শুতাম।কিন্তু ওই রাত্রে সমস্ত দরজা বন্ধ করি কিন্তু একটি দরজা বন্ধ করতে পারছিলামনা অনেক চেষ্টা করার পরেও অপারক হয়ে গেলাম তারপর আমার সহকর্মীদেরকে ডাকলাম তারাও চেষ্টা করল তারাও দরজা বন্ধ করতে সফল হলো না পরিশেষে আমরা মিস্ত্রি ডাকলাম সেও চেষ্টা করল কিন্তু অপারগ হয়ে গেল পরিশেষে আমরা বুঝতে পারলাম যে মসজিদের ছাদ নিচে নেমে দরজার চাপ দিয়েছে যার কারণে দরজা লাগানো যাচ্ছে না তখন আমরা অপারগ হয়ে দরজা খোলা রেখেই ফিরে যায় পরদিন সকালে যখন আমরা মসজিদে যায় তখন মসজিদের সামনে একটি পাথর দেখি এবং সেখানে কোন আরোহণের পশুর চিহ্ন দেখতে পায় তখন আমি আমার সাথে কে বললাম রাত্রে দরজা বন্ধ করতে না পারার কারণ এটাই যে আজ রাতে আল্লাহর কোন নবী এই মসজিদে এসেছেন এবং নামাজ পড়েছেন এই ঘটনা দ্বারা স্পষ্ট হয় যে রাসূল সাল্লাহু সাল্লাম সশরীরে মেরাজ করেছ।
মুফতী মাহমুদ হাসান।
সিনিয়র শিক্ষক: দারুল হক্ব ইসলামিয়া মাদ্রাসা মির্জাপুর টাঙ্গাইল।