টুকরো স্মৃতি ও মহান স্বাধীনতা

নিজস্ব প্রতিবেদক আপডেট: ২০২১-০৩-২৫ ২০:১৬:২০


ফাহমিদ জামান

অনেক কেঁদেছিলাম! সকলের অগোচরে অঝোর ধারায় গড়িয়ে পড়েছিলো চোখের লোনাজল! পাছে কেউ দেখে ফেলে সেই ভয়ে ঘরের দরজা লাগিয়ে কম্বলের নিচে অশ্রু বিসর্জন! তবু আম্মুর চোখকে ফাঁকি দিতে পারিনি। কিভাবে যেন টের পেয়ে যান আমার ফুঁপিয়ে কান্নার শব্দ।বুকে জড়িয়ে ধরে জিজ্ঞেস করেন বাবা কাঁদছিস কেন! আমার মুখ দিয়ে কোন শব্দ বের হচ্ছিলো না।আমাদের ছয় ভাই বোনের ভিতর আম্মু আমাকে সবচেয়ে বেশী ভালোবাসেন এই অভিযোগ সকলের।আমিও সেটা টের পেতাম এখনও পাই।সেদিন আমার হাতে একটা বই ছিলো।বইটা আম্মুর হাতে দিয়ে দিই।আম্মুর বুঝতে অসুবিধা হয় না আমার কান্নার কারণ।বই পড়ছিলাম আর কাঁদছিলাম।আম্মুকে বলছিলাম দেখ,আম্মু এই ছোট্ট রাসেলকে কিভাবে হত্যা করা হয়েছে।

তখন আমি গ্রামের ব্র্যাক স্কুলের তৃতীয় শ্রেণীর ছাত্র।বাঙ্গালির মুক্তির মহান স্বাধীনতা দিবসকে কেন্দ্র করে  একটি রচনা প্রতিযোগীতার আয়োজন করা হয়েছিলো।বঙ্গবন্ধু এবং মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে লিখা সেই প্রতিযোগীতায় আমি দিনাজপুর জেলার মধ্যে দ্বিতীয় স্থান অধিকার করি।দেশের সবচেয়ে বড় মাঠ হিসেবে খ্যাত দিনাজপুর জেলার গোর এ শহীদ বড় ময়দানে স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে একটি বিশাল অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়।সেই অনুষ্ঠানে প্রতিযোগীতায় বিজয়ী প্রথম তিনজনকে নিজ হাতে লিখা অনুচ্ছেদ পড়ে শোনাতে হয়।ওই বয়সে মাইক পিস্টন হাতে নিয়ে কাঁপা কাঁপা কন্ঠে নিজ হাতে লিখা অনুচ্ছেদ পড়ে শুনিয়েছিলাম হাজারো দর্শকের সামনে।প্রতিযোগীতার দ্বিতীয় বিজয়ী হিসেবে মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক চারটি বই উপহার পেয়েছিলাম।ওই বইগুলি অধ্যয়নের মাধ্যমে আমার কাছে স্পষ্ট হয় বাঙ্গালির মহান মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস।মহান নেতা বঙ্গবন্ধুর ইতিহাস।

যে বইটি সবচেয়ে বেশী পড়েছিলাম।সেটিতে উল্লেখ করা ছিল ১৯৭৫ সালে কি নির্মমভাবে বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করা হয়েছিলো।

বঙ্গবন্ধুর কনিষ্ঠপুত্র শেখ রাসেলও সেদিন দুর্বৃত্তদের হাত থেকে রক্ষা পায় নি।মাত্র সাত বছরের শিশু শেখ রাসেলকে গুনে গুনে ১৯টি গুলি করা হয়েছিলো।প্রথম গুলিতেই তার ডান হাত উড়ে যায়।শেখ রাসেলের একটি তিন চাকার গাড়ি ছিল যেটি চালাতো সে।ওই গাড়িতে উঠলে পড়ে যাওয়ার ভয় থাকে না।আমিও আম্মুকে দেখিয়ে বলতাম এমন একটা গাড়ি আমার চাই।আমাকেও একটি সেইরকম গাড়ি দেওয়া হয়েছিলো।যেটি ছিলো মেশিনের বিয়ারিং এর তৈরী গাড়ি।

শেখ রাসেলকে হত্যার কাহিনীগুলো পড়লেই চোখে অশ্রু গড়িয়ে আসতো। ভয়াবহ ওইদিন আতঙ্কিত হয়ে শিশু রাসেল কেঁদে কেঁদে বলেছিলেন, ‘আমি মায়ের কাছে যাব’। পরবর্তী সময়ে মায়ের লাশ দেখার পর অশ্রুসিক্ত কণ্ঠে মিনতি করেছিলেন ‘আমাকে হাসু আপার (শেখ হাসিনা) কাছে পাঠিয়ে দিন’।

শেথ রাসেলকে তার মা, বাবা, দুই ভাই, ভাইয়ের স্ত্রী, চাচা সবার লাশের পাশ দিয়ে হাঁটিয়ে নিয়ে সবার শেষে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করল রাসেলকে। ওই ছোট্ট বুকটা কি তখন ব্যথায় কষ্টে বেদনায় স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল। যাদের সান্নিধ্যে স্নেহ-আদরে হেসে খেলে বড় হয়েছে তাদের নিথর দেহগুলো পড়ে থাকতে দেখে ওর মনের কী অবস্থা হয়েছিল- কী কষ্টই না ও পেয়েছিল!!’

পাকিস্তানের শোষন নিপীড়ন থেকে মুক্তি পেতে ১৯৬৬’তে বাঙালির ম্যাগনার্কাটা খ্যাত ৬ দফা দাবী উত্থাপন করেছিলেন বাঙ্গালির মুক্তির মহানায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, ১৯৭১ সালের ৭ই মার্চ রেসকোর্স ময়দানে তিনি রচনা করলেন ইতিহাসের সর্বশ্রেষ্ঠ স্বাধীনতার কবিতা। স্বাধীনতায় উন্মুখ লাখো মানুষের সামনে তিনি বজ্র কণ্ঠে বলে গেলেন কাক্সিক্ষত সেই শব্দগুলো ‘বাংলার মানুষ আজ মুক্তি চায় . . . এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’২৫ মার্চ রাতেই বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করে পশ্চিম পাকিস্তানে নিয়ে যাওয়া হয়। গ্রেফতার হওয়ার আগে ২৬মার্চের প্রথম প্রহরে তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করে যান।

১৯৭১ সালের ২৬শে মার্চ শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধ৷ ২৫শে মার্চের মধ্যরাত থেকে শুরু হওয়া হত্যাযজ্ঞের ধ্বংসস্তূপের মধ্য থেকে উঠে দাঁড়িয়ে বাংলাদেশিরা এই দিন থেকে মুক্তিযুদ্ধ ও দেশ স্বাধীন করার শপথ গ্রহণ করে৷ ঐ রাতেই তৎকালীন পূর্ব বাংলার পুলিশ, ইপিআর ও সেনাবাহিনীর সদস্যরা শুরু করে প্রতিরোধ যুদ্ধ, সঙ্গে যোগ দেয় সাধারণ মানুষ৷ ৯ মাসের যুদ্ধে ৩০ লাখ শহিদের রক্তের বিনিময়ে ১৬ই ডিসেম্বর অর্জিত হয় স্বাধীনতা৷ জন্ম হয় স্বাধীন বাংলাদেশের৷

সানবিডি/এনজে