প্যাকেজিং পণ্যে বন্ড সুবিধার অপব্যবহার: ৬০০ কোটি টাকার শুল্ক ফাঁকি

নিজস্ব প্রতিবেদক আপডেট: ২০২১-০৪-১৮ ১১:৪১:৩৮


বন্ডের আওতায় শুল্কমুক্ত সুবিধায় প্যাকেজিং পণ্য আমদানি করে তা খোলাবাজারে বিক্রি করে বিপুল রাজস্ব ফাঁকির মহোৎসব চলছে খুলনায়। চিংড়িশিল্পের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট আটটি প্রতিষ্ঠানের এমন অপকর্ম উদঘাটনের পর তাদের জরিমানার পাশাপাশি লাইসেন্স বাতিল করা হয়েছে। এ ঘটনায় জড়িত হিসেবে ঘুরেফিরে ‘লকপুর গ্রুপ’-এর নাম এসেছে। কর্তৃপক্ষীয় তৎপরতায় একাধিক প্রতিষ্ঠানকে জরিমানা করা হয়েছে, শুল্ক কর্মকর্তাদের চাকরিও গেছে। এর পরও বন্ড সুবিধার অপব্যবহার করে শুল্ক ফাঁকির ঘটনা থামছে না।

তদন্ত প্রতিবেদনের তথ্য মতে, গত অর্থবছরে মোট চিংড়ি রপ্তানি করা হয়েছে ২৯ হাজার ৫৫১ টন। শুধু এই চিংড়ি রপ্তানির জন্যই খুলনার আটটি প্রতিষ্ঠান শুল্কমুক্ত সুবিধার (বন্ড) আওতায় ৯২ হাজার ৪৪৫ টন প্যাকেজিং সামগ্রী আমদানি করেছে। পরে তা দেশের খোলাবাজারে বিক্রি করে দেওয়া হয়েছে। এভাবে শুল্ক ফাঁকির ঘটনা উদঘাটন করে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছে শুল্ক বিভাগ প্রায় ৬০০ কোটি টাকা দাবিনামা জারি করেছে। পাশাপাশি আটটি প্রতিষ্ঠানের বন্ড লাইসেন্স বাতিল করে ৪০ কোটি টাকা জরিমানা করা হয়েছে।

মোংলা কাস্টম হাউস শুল্ক কমিশনার হোসেন আহমেদ জানান, গত বছর বন্ডেড হাউসের নামে বিপুল পরিমাণ প্যাকেজিং পণ্য আমদানির বিষয়টি তাঁর নজরে আসে। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নামে এসব পণ্য আনা হলেও প্রকৃতপক্ষে আমদানিকারক ছিল লকপুর গ্রুপ। গত সেপ্টেম্বর মাসে কাগজপত্র প্রাথমিক যাচাইকালে চাহিদা ও আমদানির সঙ্গে ব্যবধান ও অনিয়ম ধরা পড়ে। এর পরিপ্রেক্ষিতে শুল্কমুক্ত সুবিধায় আনা পণ্য খালাস স্থগিত করে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। পরে বন্ড সুবিধা না দেওয়ায় সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা ৪২ কোটি টাকা শুল্ক পরিশোধ করে ওই পণ্য ছাড় করিয়ে নেন।

জানা যায়, এই ঘটনায় লকপুর শিল্প গ্রুপ উচ্চ আদালতে রিট করে লাইসেন্স এবং শুল্ক ফাঁকির দাবিনামা স্থগিত করায়। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড সুপ্রিম কোর্টে আপিল করলে শুল্ক বিভাগের পক্ষে রায় যায়। এরপর একাধিক তদন্ত কমিটি গঠিত হয়। তদন্ত কমিটির সুপারিশের ভিত্তিতে পরে শুল্ক বিভাগ আটটি বন্ড হাউসের লাইসেন্স বাতিল করে। পাশাপাশি শুল্ক ফাঁকির জন্য প্রায় ১০৪ কোটি টাকা দাবিনামা জারি এবং সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোকে প্রায় ৫০ কোটি টাকা জরিমানা করে।

শুল্ক ফাঁকি ও দণ্ডিত প্রতিষ্ঠানগুলো হলো আলফা অ্যাকসেসরিজ অ্যান্ড এক্সপোর্ট লিমিটেড (দুই দফায় যথাক্রমে ২৯ কোটি ৩০ লাখ ও ১২ কোটি টাকা শুল্ক ফাঁকির ঘটনায় ১০ কোটি ও ছয় কোটি টাকা অর্থদণ্ড), বাংলাদেশ পলি প্রিন্টিং ইন্টারন্যাশনাল (১৮ কোটি ৩০ লাখ টাকা শুল্ক ফাঁকি দেওয়ায় ১০ কোটি টাকা অর্থদণ্ড), ইস্টার্ন পলিমার লিমিটেড (দুই দফায় আট কোটি ৫০ লাখ টাকা ও ১০ লাখ টাকা শুল্ক ফাঁকি দেওয়ায় চার কোটি ও ১০ লাখ টাকা দণ্ড), মুন স্টার পলিমার লিমিটেড (পাঁচ কোটি ৫৩ লাখ টাকা শুল্ক ফাঁকি দেওয়ায় দুই কোটি ৫০ লাখ টাকা দণ্ড), খুলনা প্রিন্টিং অ্যান্ড প্যাকেজিং লিমিটেড (৪৭ লাখ টাকা শুল্ক ফাঁকি দেওয়ায় পাঁচ লাখ টাকা) এবং শরীফা প্রিন্টার্স অ্যান্ড প্যাকেজিং লিমিটেড (৩০ লাখ টাকা শুল্ক ফাঁকি দেওয়ায় ৫০ হাজার টাকা অর্থদণ্ড)। এই প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে শরীফা প্রিন্টার্স ছাড়া বাকি সব প্রতিষ্ঠানই লকপুর গ্রুপের। প্রতিষ্ঠানগুলো খুলনা, বাগেরহাটের লকপুর ও মোংলা ইপিজেডে অবস্থিত।

শুল্ক বিভাগের তদন্তে দেখা গেছে, আমদানি করা পণ্যগুলো চট্টগ্রাম বন্দর থেকে খালাস করা হয়েছে। মোংলা ইপিজেডে থাকা প্রতিষ্ঠানের নামে এগুলো আমদানি করা হলেও ওই প্রতিষ্ঠানগুলোর রেজিস্টারে ২৮টি বিল যথাযথভাবে নথিভুক্ত করা হয়নি।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন প্যাকেজিং ব্যবসায়ী বলেন, বন্ড সুবিধার আওতায় আমদানি পণ্যের শতভাগই রপ্তানি করার কথা। এতে ফাঁকি দেওয়া হলে আমদানি, রপ্তানি ও এলসির কাগজপত্র পরীক্ষা করলেই তা ধরা পড়ে যাবে। কাস্টমস ও ব্যাংকের কর্মকর্তারা যুক্ত না থাকলে ব্যবসায়ী বা আমদানিকারক এই শুল্ক ফাঁকি দিতে পারেন না।

আটটি প্রতিষ্ঠানের নামে এই কর ফাঁকি কাণ্ডে সংশ্লিষ্টতার দায়ে পাঁচ শুল্ক কর্মকর্তার বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে বলে দাবি করেন মোংলা কাস্টম হাউসের কমিশনার।

শুল্ক ফাঁকি ও অর্থদণ্ডের বিষয়ে জানার জন্য লকপুর গ্রুপ এবং সাউথ বাংলা ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান এস এম আমজাদ হোসেনের সঙ্গে টেলিফোনে একাধিকবার যোগাযোগ করা হলেও তিনি কথা বলতে রাজি হননি। তবে তিনি অর্থদণ্ডের কথা স্বীকার করেন। শরীফা প্রিন্টিং অ্যান্ড প্যাকেজিং লিমিটেডের এমডি মাহমুদ হাসান শুল্ক বিভাগের দাবিনামা ও অর্থদণ্ডের কথা স্বীকার করেন।