অতিমারিতেও বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে সর্বোচ্চ রেকর্ড: সক্ষমতার প্রতিফলন
:: প্রকাশ: ২০২১-০৭-১৩ ১৫:০১:৫৭
দেশে করোনা পরিস্থিতি এখন আগের যেকোনো সময় অপেক্ষা খারাপ। করোনা নিয়ে সবাই আতঙ্কগ্রস্থ । কোনভাবেই করোনার লাগাম টেনে ধরা যাচ্ছে না। কখনো মৃত্যুর সংখ্যা, কখনো আক্রান্তের সংখ্যা ক্রমাগত রেকর্ড ভাঙছে।। গত প্রায় দেড় বছর ধরে গণমাধ্যমগুলোতে প্রাণঘাতী করোনাভাইরাস-এর খবরই প্রাধান্য পেয়ে আসছে।
করোনার অভিঘাতে বিশ্ব অর্থনীতি যখন বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে সেই সময়ে বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ রেকর্ড ৪৬.০৮২ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছে বলে বাংলাদেশ ব্যাংক জানিয়েছে।গত বছরের তুলনায় বৈদেশিক রিজার্ভের প্রবৃদ্ধি ৩৯ দশমিক ৯৬ শতাংশ। ২০২১ অর্থবছরের জুলাই থেকে মে মাসে রিজার্ভের এ রেকর্ড গড়েছে বাংলাদেশ। সাধারণত অর্থনীতিবিদেরা বলেন, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের এই রেকর্ড নিঃসন্দেহে অর্থনীতির জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক ।কেননা অর্থনৈতিক সক্ষমতায় অন্যতম মাইলফলক হল এই বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ।
বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বলতে কোনও দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকে (বা মুদ্রাবিষয়ক কর্তৃপক্ষের কাছে) বৈদেশিক মুদ্রায় গচ্ছিত সম্পদের মজুদকে বোঝায়। এভাবে গচ্ছিত বৈদেশিক মুদ্রা প্রধানত আমদানি মূল্য এবং বৈদেশিক ঋণ ও ঋণের সুদ, ইত্যাদি পরিশোধে ব্যবহৃত হয়। পণ্য ও সেবা রপ্তানি ও বিদেশে কর্মরত শ্রমিকদের স্বদেশে পাঠানো অর্থ ( রেমিট্যান্স) থেকে বৈদেশিক মুদ্রার মজুদ গড়ে ওঠে। এর সঙ্গে যুক্ত হয় বৈদেশিক ঋণবাবদ প্রাপ্ত অর্থ এবং সরাসরি বৈদেশিক বিনিয়োগের অর্থ। সাধারণত শক্তিশালী বা অনমনীয় মুদ্রা (Hard currency) যা আন্তর্জাতিক বাজারে সহজে বিনিময়যোগ্য (যেমন ডলার, পাউণ্ড, ইউরো, ইয়েন, ইত্যাদি), সেটিতেই বৈদেশিক মুদ্রার মজুদ গড়ে তোলা হয়। কোন দেশ স্বীয় দেশেরই কোন ব্যাংকে বা কোন বিদেশে অবস্থিত ব্যাংকে বৈদেশিক মুদ্রার মজুদ সংরক্ষণ করতে পারে।
বহু বছর ধরে বেশির ভাগ দেশে স্বর্ণের মজুদকে মূল মুদ্রা মজুদ হিসেবে ব্যবহার করা হত। স্বর্ণকে আদর্শ মজুদ সম্পদ হিসেবে গণ্য করা হত, কেননা অর্থনৈতিক মহামন্দার সময়েও এর মানের কোন হেরফের হত না। কিন্তু ১৯৭১ সালে ব্রেটন-উডস ব্যবস্থার পতনের পর থেকে স্বর্ণের দাম পড়তে থাকে। এর আগে ১৯৪৪ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিউ হ্যাম্পশায়ার অঙ্গরাজ্যের ব্রেটন উডস শহরে একটি সম্মেলনে আন্তর্জাতিক বাজারে মুদ্রাসমূহকে স্বর্ণ অথবা মার্কিন ডলারের সাথে সংযুক্ত করা হয়। তখন বিশ্বের সমস্ত স্বর্ণের অর্ধেক মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অধীনে ছিল। কিন্তু ১৯৭১ সালে মার্কিন রাষ্ট্রপতি রিচার্ড নিক্সন মার্কিন ডলার থেকে স্বর্ণের সম্পদ রূপান্তরের ব্যবস্থা বন্ধ করে দেন। এর পর থেকে মার্কিন ডলারই বর্তমানের মজুদগুলিতে সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত বৈদেশিক মুদ্রা।
সাধারণত শক্তিশালী বা অনমনীয় মুদ্রা (Hard currency ) বা আন্তর্জাতিক বাজারে সহজে বিনিময়যোগ্য মুদ্রায় (যেমন মার্কিন ডলার, ব্রিটিশ পাউণ্ড, ইউরো, ইয়েন) ইত্যাদিতে বৈদেশিক মুদ্রার মজুদ গড়ে তোলা হয়। বৈদেশিক মুদ্রাভিত্তিক সম্পদ বলতে বৈদেশিক ব্যাংকের টাকার নোট, বন্ড, ট্রেজারি বিল ও অন্যান্য সরকারী সিকিউরিটি হতে পারে। অনেক সময় স্বর্ণের মজুদও এর আওতায় পড়ে। আয়তন নির্বিশেষে বিশ্বের প্রায় সব দেশেই উল্লেখযোগ্য পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রার মজুদ আছে। এই মজুদগুলির অর্ধেকেরও বেশি অংশ মার্কিন ডলারে রাখা হয়েছে । কারণ এটিই বিশ্ববাজারের সবচেয়ে বেশি প্রচলিত মুদ্রা। এছাড়াও ব্রিটিশ পাউন্ড স্টার্লিং, ইউরো এবং জাপানি ইয়েন বৈদেশিক মুদ্রা মজুদে ব্যবহৃত মুদ্রাগুলির মধ্যে অন্যতম।
এই মজুদটি দেশটির নিজস্ব মুদ্রার দেনা পরিশোধ ও মুদ্রানীতি প্রভাবিত করতে ব্যবহৃত হতে পারে। বৈদেশিক মুদ্রার মজুদ দেশের অর্থনীতির ঘাত প্রতিরোধ ক্ষমতা (shock resistance) ও নমনীয়তা (flexibility) বৃদ্ধি করে। দেশীয় মুদ্রামানের দ্রুত অবমূল্যায়ন (devaluation) ঘটলে বৈদেশিক মুদ্রার মজুদ ব্যবহার করে বাজারের ভারসাম্য রক্ষা করা হয়।
তাত্ত্বিকরা মনে করেন এমন মুদ্রাতেই বৈদেশিক মুদ্রা মজুদ করা উচিত যা দেশীয় মুদ্রার সাথে সরাসরি সংযুক্ত নয়, যাতে ঘাত প্রতিরোধ সহজ হয়। কিন্তু বর্তমান যুগে এটি করা কঠিন, কেননা বিশ্বের সব মুদ্রা এখন একে অপরের সাথে অনেক বেশি সংযুক্ত।
বর্তমান বিশ্বের সর্ববৃহৎ বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ আছে চীনের কাছে। এর পরিমাণ প্রায় ৩ লাখ ৩৬ হাজার কোটি ডলার। দ্বিতীয় স্থানে জাপান (রিজাভ ১ লাখ ৩৮ হাজার ৭৫০ কোটি ডলার) এবং ১ লাখ ৭ হাজার ৪৮৪ কোটি ডলার নিয়ে সুইজারল্যান্ড তৃতীয় স্থানে। চতুর্থ এবং পঞ্চম স্থানে রয়েছে যথাক্রমে ভারত (রিজার্ভ ৬১ হাজার ৫০০ কোটি ডলার) এবং রাশিয়া (রিজাভ ৫৯ হাজার ২৪০ কোটি ডলার)। যুক্তরাষ্ট্রও ২১ তম স্থানে রয়েছে । বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে দক্ষিণ এশিয়ায় ভারতের পর রয়েছে বাংলাদেশ। তবে বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান ৪৪তম, পাকিস্তান ৬২ তম, আফগানিস্তান ৭৮তম, শ্রীলংকা ১০৩তম , ভুটান ১৩৩তম এবং মালদ্বীপ ১৪৭তম।
আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী কোন দেশের কাছে অন্তত ৩ মাসের আমদানি ব্যয় মিটানোর জন্য বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ থাকলে দেশ নিরাপদ বলে ধরে নেওয়া হয়। বর্তমান বাংলাদেশে যে পরিমাণ রিজার্ভ রয়েছে তা দিয়ে ১২ মাসের আমদানি ব্যয় পরিশোধ করা সম্ভব। এছাড়া দেশের যেকোনো ধরনের আর্থিক সংকটে অর্থনীতির গতি ধরে রাখতে এ রিজাভ কাজে আসবে ।
বৈশ্বিক মহামারীর মধ্যেও বাংলাদেশে রেকর্ড পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা আসার অন্যতম কারণ রেমিটেন্স।২০২১ সালের মে মাসে ২ দশমিক ১৭ বিলিয়ন ডলার রেমিটেন্স এসেছে।১ জুলাই ২০২০ থেকে ৩১ মে ২০২১ পর্যন্ত মোট ২২ দশমিক ৮৩ বিলিয়ন ডলার দেশে এসেছে । প্রবাসীরা তাদের পাঠানো রেমিট্যান্সে ২ শতাংশ হারে সরকার কর্তৃক প্রণোদনা পাচ্ছেন। এছাড়াও বিভিন্ন ব্যাংক এবং মোবাইল ব্যাংকিং সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান প্রণোদনার সঙ্গে বাড়তি এক শতাংশ দেওয়ার অফার দিচ্ছে। এতে করে বৈধ চ্যানেলে রেমিট্যান্স পাঠাতে উৎসাহী হচ্ছেন বিদেশে কর্মরত প্রবাসী বাংলাদেশিরা। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এখন বৈধ পথে রেমিট্যান্স আসছে, রপ্তানিও বেড়েছে। এছাড়াও আমদানি ব্যয়ের চাপ কম, দাতা সংস্থা বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ ও জাইকার বৈদেশিক ঋণ সহায়তা এবং বিশ্ব সংস্থার অনুদানের কারণে রিজার্ভ বেড়েছে।
সম্প্রতি বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ৪৬ বিলিয়ন ডলার অতিক্রম করেছে। রিজার্ভের এই রেকর্ড পরিমাণ বৃদ্ধি আমাদের জন্য অনেক আনন্দের বিষয়। রিজার্ভ বেশি থাকলে বড় বড় বিনিয়োগকারী, বিশেষ করে বিদেশি বিনিয়োগকারীরা স্বস্তি পায়, উৎসাহিত হয় এবং বিনিয়োগ করতে আগ্রহী হয়। আমদানি করতে গেলে বা বৈদেশিক কেনাকাটায় মুদ্রার অভাব হবে না—এই ভাবনা তৈরি হয় ।
আমাদের আস্থার বিষয় যে বাংলাদেশে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ক্রমাগত বৃদ্ধি পাচ্ছে। এটা অনেক দিন ৩৩ বিলিয়ন ডলারের কাছাকাছি ছিল। এখন আরো বৃদ্ধি পাওয়ায় আমাদের অর্থনীতির সক্ষমতাটা বেড়ে গেল। তবে একই সঙ্গে দেশের রিজার্ভ বৃদ্ধির লাভ-ক্ষতিটাও দেখা উচিত। রিজার্ভ বাড়া যেমন গর্বের বিষয়, তেমনি কার্যকর ব্যবহার না হলে এর ঝুঁকিও আছে। এর বড় ঝুঁকি হচ্ছে মূল্যস্ফীতি, অর্থপাচার এবং ডলারের দাম পড়ে যাওয়া। তাই ঝুঁকি মোকাবেলায় দরকার যথাযথ রিজার্ভ ব্যবস্থাপনা।
বৈদেশিক মুদ্রার কার্যকর ব্যবহারের পাশাপাশি এর প্রবাহ অব্যাহত রাখায় মনোযোগ দিতে হবে। সাম্প্রতি জাপান ঘোষণা দিয়েছে যে, চীন থেকে কম্পানি সরিয়ে বাংলাদেশে এলে ভর্তুকি দেবে। সরকারের আন্তরিকতার সঙ্গে এসব বিনিয়োগকারীকে আহ্বান জানানো উচিত। বিদেশি বিনিয়োগের ভালো গন্তব্য হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করতে পারলে আমাদের রিজার্ভে টান পড়বে না। এ ক্ষেত্রে করপোরেট ট্যাক্স কমানো এবং ব্যবসা সহজীকরণের বিষয়গুলোতে আরো মনোযোগ দিতে হবে।
রেকর্ড পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ অবশ্যই বাংলাদেশের জন্য আর্শিবাদ। এর কার্যকর ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। মনে রাখতে হবে রিজার্ভের এই সুদিন ভবিষ্যতে নাও থাকতে পারে। সময় থাকতে সুযোগগুলো সঠিকভাবে চিহ্নিত করে তা ব্যবহার করতে পারলে বাংলাদেশকে একটা শক্তিশালী কাঙ্খিত উচ্চতায় নেয়া সম্ভব। এর জন্য জরুরি দরকার দুর্নীতিরোধ, অর্থনৈতিক সুশাসন, আইনের শাসন এবং সামাজিক ন্যায় প্রতিষ্ঠা করা । অর্থনৈতিক সক্ষমতার এই ভিত অধিকতর দৃঢ করার জন্য একটি আস্থাশীল নেতৃত্ব একান্ত কাম্য । এজন্য বঙ্গবন্ধু কন্যা দেশরত্ন শেখ হাসিনাকে শক্তিশালী করতে হবে এবং বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন সরকারকে চলমান রাখতে হবে। তাহলেই আত্মমর্যাদাশীল শক্তিশালী বাংলাদেশ আমাদের কাঙ্খিত লক্ষ্যে পৌঁছবে।
লেখক: মোঃ আইনুল ইসলাম
অধ্যাপক
অর্থনীতি বিভাগ
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়
সানবিডি/ এন/আই