দর্জি খাদিজার ঈদ বাজারে আয় লাখ টাকা
সান বিডি ডেস্ক প্রকাশ: ২০২১-০৭-১৫ ২১:০৭:০৩
‘ছোট বেলায় মাকে দেখেই সেলাইয়ের কাজ শেখা। পরিবারের স্বচ্ছলতা বাড়াতে মা ঘরেই দর্জির কাজ করতেন। কাপড় কাটাসহ সেলাইয়ের খুটিনাটি মায়ের কাছ থেকেই শিখেছি।
পঞ্চম শ্রেণি পাস করার পর আমরাও মায়ের সঙ্গে এই কাজ করতে শুরু করি’। বলছিলেন, ‘লেডি টেইলর বিডি’ পেইজের স্বত্বাধিকারী খাদিজা আফরোজ।
ঢাকা মহিলা পলিটেকনিক্যাল ইনস্টিটিউট থেকে ইলেক্ট্রনিক্সে ডিপ্লোমা করার পর সোনার হরিণের পেছনেও ছুটেছেন খাদিজা। তবে চাকরি নামক সেই সোনার হরিণ ধরতে পারেননি, দেশের হাজার হাজার বেকারদের মতোই। এর মধ্যেই বিয়ে হয়ে যায়। তবে স্বামীর সংসারও ঠিকভাবে করা হয়ে ওঠেনি। ছয়মাসের অন্তঃসত্ত্বা খাদিজা চলে আসেন বাবার বাড়িতে। স্বামী কিংবা শ্বশুরবাড়ির কেউ তেমন খোঁজ খবর রাখেননি খাদিজা এবং তার সন্তানের।
২০১৯ সালে সাত মাসেই প্রি-ম্যাচিউর ছেলে সন্তানের জন্ম দেন খাদিজা। সামান্য বেতনে চাকরি করা বাবার পক্ষেও মেয়ে আর নাতির ভরণ-পোষণ দেওয়া সম্ভব হচ্ছিল না। সন্তানের দুধ কেনার টাকা পর্যন্তও ছিলো না তার। এই সময় তার বোনেরা তাকে সাহায্য করেছে। কিন্তু সেটা কতোদিন সম্ভব।
নিজে কিছু করার কথা অনেকদিন থেকেই চিন্তা করছিলেন তিনি। তবে কি করবেন? প্রতিযোগিতার মাঠে খাদিজার নেই কোনো সঞ্চয়, নেই কোনো প্রশিক্ষণ। তখন তার বোনের বান্ধবী তাকে অনলাইনে কিছু করার পরামর্শ দেন। খাদিজা শিশুদের খাবার আর জামাকাপড় সেলাইয়ের অভিজ্ঞতা নিয়ে কাজে নামেন।
২০২০ সালের জানুয়ারি মাসে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ‘লেডি টেইলার বিডি’ নামে খুলে ফেললেন পেইজ। অনলাইনে পেজ খোলার পর অর্ডার আসতে থাকে খাদিজার কাছে। মাত্র কয়েকদিনের মধ্যেই ১০টি অর্ডারও পান তিনি। নিজে গিয়েই তখন ক্লায়েন্টদের বাসা থেকে কাপড় নিয়ে আসতেন। এরপর সেলাই শেষে নিজেই আবার দিয়ে আসতেন।
এতে তার সময়, শ্রম এবং অর্থ সবই অনেক বেশি যেত। একদিকে নিজের বাচ্চাকে সময় দিতে পারছেন না; অন্যদিকে তেমন ইনকামও করতে পারছেন না। তবে হাল ছাড়েননি খাদিজা। এরপর মহামারির সময় যখন সবাই লকডাউনে; তখন খাদিজার জন্য খুলে যায় সাফল্যের দরজা। অর্ডার পেতে থাকে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে।
ক্রেতাদের বিশ্বস্ততার জায়গা তৈরি করতে খাদিজার নিজেকে প্রমাণ করতে হয়েছে প্রতি মুহূর্তে। বর্তমানে নিজ ফ্ল্যাটের একটি কক্ষেই ৫ জন কর্মী এবং ২ জন ডেলিভারি বয় নিয়েই তার ব্যবসা চলছে। মেয়েদের সেলোয়ার-কামিজ থেকে শুরু করে, ব্লাউজ, বাচ্চাদের জামা, লিমা, ফতুয়া, প্যান্টসহ যাবতীয় পোশাক সেলাই করেন।
খাদিজা হোস্টেলে থেকে পড়ার সময়ও তার সহপাঠীদের পোশাক সেলাই করেছেন। নিজের পড়ার খরচ নিজেই জোগাড় করেছেন এভাবে। এসএসসি পরীক্ষার পর খাদিজা ২০১২ সালে তার বোনের সঙ্গে মিলে বাসার পাশে একটি দোকান দিয়েছিলেন। মাত্র ৩ হাজার টাকা দিয়ে ছোট্ট একটি দোকান নিয়ে বসেছিলেন তারা। চোখে অনেক বড় স্বপ্ন ছিল না। শুধু কিছু করতে হবে এটাই মাথায় ছিল। সেখানেও তারা অল্প দিনেই বেশ পরিচিতি লাভ করেন।
কোথাও কখনো প্রশিক্ষণ নেননি খাদিজা আফরোজ। মাকে দেখেই তার কাজের হাতেখড়ি। এরপর দেখে দেখে এবং কাজ করতে করতে শিখেছেন আরো নতুন কিছু। পরিবারের সদস্যদের পাশে পেয়েছেন সবসময়। বাবা, মা, ভাই, বোন আর দুই বছরের ছেলেকে নিয়ে ঢাকাতেই থাকছেন খাদিজা আফরোজ।
একসময় ছেলের দুধের টাকা জোগাড়ের চিন্তায় ঘুমাতে পারতেন না। এখন তার মাসিক আয় প্রায় ৫০ হাজার টাকা। ঈদ উপলক্ষে খাদিজার আয় হয়েছে লাখ টাকার উপরে। ‘নাফি বেবি ফুড’ নামেও একটি পেইজ আছে তার। সেখানে শিশুদের জন্য ঘরে তৈরি মুখোরোচক বিভিন্ন খাবার তৈরি করে বিক্রি করেন খাদিজা।
‘লেডি টেইলর বিডি’ পেইজের মাধ্যমে অনলাইনে পোশাক তৈরির বিষয়টি নতুন হওয়ার কারণে খাদিজার চলার পথ মসৃণ ছিল না। অনলাইনে তিনিই প্রথম এমন ভাবনা নিয়ে আসেন। সেখানে অনেক প্রতিবন্ধকতারও মুখোমুখি হয়েছেন তিনি। আশেপাশের মানুষের কটু কথা শুনেছেন।
সেইসঙ্গে ক্লায়েন্টদের বিভিন্ন কটুক্তিসহ জিজ্ঞাসা তাকে কষ্ট দিয়েছে। তবুও ভেঙে পড়েননি খাদিজা। ছেলেকে মানুষ করার জন্য তিনি আরও শক্ত হয়েছেন। বর্তমানে তার ইনকামে চলছে তার পরিবার, তার সন্তানের ভরণ-পোষণ। খাদিজার অনুপ্রেরণা তার সন্তান। তার সাফল্য, পথচলা সবকিছুই তার একমাত্র সন্তানের জন্য- এভাবেই বলছিলেন খাদিজা আফরোজ।
খাদিজা সবাইকে উদ্বুদ্ধ করতে চান। তিনি বলেন, ‘বসে না থেকে যে যে কাজ পারো সেটা নিয়েই কিছু কর। এমন না যে অন্যরা যা করছে তাই তোমাকে করতে হবে। প্রতিযোগিতার বাজারে ইউনিক কিছু ভাবতে হবে। কাজের ক্ষেত্রে সবসময় বিস্বস্ত আর নিষ্ঠাবান হতে হবে। কাজের মাধ্যমে নিজের সত্ত্বাকে বের করে আনতে হবে। যে যার স্বাচ্ছন্দ্যমতো কাজ করতে পারে এই সেক্টরে। ’
খাদিজা আরও বলেন, ‘নিজেকে তিনটি প্রশ্ন করুন, আপনি কি কিছু করতে চান? কি করতে পারেন? কি করতে চান? এর উত্তর পেলেই আপনি জীবনে সফল হতে পারবেন’।
সানবিডি/এন/আই