বাংলাদেশ থেকে হারিয়ে যচ্ছে দেশীয় জাতের ধান

নিজস্ব প্রতিবেদক প্রকাশ: ২০২১-০৭-২৯ ১৫:৩২:১১


পঙ্খীরাজ, গোবিন্দভোগ, জামাইভোগ, মোগাইবালাম, রূপকথা, রাঁধুনীপাগল কিংবা পাঙ্গাস – বিচিত্র এসব নাম শুনলে এখন বোঝাই যায় না যে বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের বরেন্দ্র এলাকার এগুলো ছিলো এক সময় দেশীয়জাতের ধানের নাম।

আবার দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের বয়স্ক কৃষকেরা অনেকে শুধু মনেই করতে পারেন যে লক্ষ্মীজটা, রানী সেলুট, ঝুমুর বালাম কিংবা হিজলদিঘি ও রাজা মোড়ল অথবা এ ধরণের অনেক চমকপ্রদ নামের দেশীয়জাতের ধান ছিলো এ অঞ্চলে, যেগুলো এখন আর নেই।

বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইন্সটিটিউটের হারিয়ে যাওয়া ধান নিয়ে এক গবেষণায় দেখা গেছে যে এ ধরণের অন্তত ১০ হাজার জাতের দেশীয় ধান এখন আর পাওয়া যায় না।

গত শতাব্দীর শুরুর দিকে প্রায় ১৮ হাজার জাতের দেশীয় ধানের তথ্য পাওয়া যায়। তবে এখন দেশীয় ধানের ৮,৬০০ জাত দেশে সংরক্ষিত আছে। এগুলোর অনেকগুলো থেকেই আমরা নিত্য নতুন ভ্যারাইটির ধানের উদ্ভাবন হচ্ছে। এখন বাংলাদেশের পাহাড় থেকে সমতল অঞ্চলে আউশ, আমন ও বোরো ধানের সব মিলিয়ে প্রায় তিন হাজারের বেশি জাতের আবাদ হয়।

বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইন্সটিটিউটেরই করা ২০১১ সালের এক জরিপ থেকে জানা যায় যে বাংলাদেশে কমবেশি আট হাজার জাতের ধান আছে। তবে এসব ধানের মধ্যে সরাসরি দেশীয় জাতের ধান এখন নেই বললেই চলে।

বেসরকারি সংগঠন উবিনীগ ‘নয়াকৃষি আন্দোলন’ নামে বাংলাদেশে কৃষি-ভিত্তিক একটি কর্মসূচি চালাচ্ছে দেশীয় জাতের কৃষিপণ্যকে জনপ্রিয় করতে। তাদের মতে, এদেশে এক সময় বিভিন্ন মৌসুমে প্রায় ১৫ হাজার জাতের ধান চাষ হতো। সংস্থাটির ওয়েবসাইটে এসকল তথ্য সহ উল্লেখ রয়েছে স্থানীয় জাতের ধানের কিছু নাম।

এগুলো হলো রায়েদা, লক্ষ্মীবিলাস, হনুমানজটা, নোনাকুর্চি, পাকড়ী, ঝিংগাশাইল, লালঢেপা, যশোয়া, তিলকাবুর, চিনিসাগর, সোনামুখী, কালোমেখী, সূর্যমুখী, খেজুরঝুপি, কলসকাটি, দুলাভোগ, পোড়াবিন্নি, শিলগুড়ি, কাটারীভোগ, দাদখানি, রাধুঁনীপাগল, মহিষদল, মাটিচাক, বটেশ্বর, ফুলবাদাল, হরিলক্ষ্মী, সরিষাজুরি, মধুশাইল, ফুলমালা, বাঁশফুল, কটকতারা, সরিষাফুলি, বাইলাম, ঘিগজ, রাজাশাইল, মধুমালতী, যাত্রামুকুট, বাবইঝাঁক, জলকুমারী, গান্ধীভোগ, লেবুশাইল, ফুলমুক্তা, বেনামুড়ি, পাটজাগ, কালামানিক, হরিঙ্গাদীঘা প্রভৃতি।

বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী এই সকল নামের ধান হারিয়ে যাওয়ার কিছু কারণও রয়েছে। সেই প্রাচীন আমলের মতো বাংলাদেশে এখনো প্রধান খাদ্য ভাত এবং এদেশের কৃষকেরা বছরের একটি বড় সময়ই ব্যয় করেন ধান চাষ করতে যা আমাদের খাদ্যের চাহিদা মিটিয়ে থাকে।

তবে আগের মতো নানা জাতের ধান এখন আর চাষ করা হয় না। সংখ্যার বিচারে কয়েক হাজার জাতের ধান চাষের কথা বলা হলেও মূলত সামান্য কয়েকটি জাতের ধান ব্যাপকভাবে চাষ করা হয়। দেশের জনসংখ্যা বাড়ছে এবং এ কারণে খাদ্য চাহিদাও বাড়ছে। অন্যদিকে চাষযোগ্য জমির পরিমান আশংকাজনকে ভাবে কমার কারণে অল্প জমিতে ধানের উৎপাদন বাড়াতে হচ্ছে। অথচ দেশীয় জাতের ধানের ফলন কম। এ কারণেই নতুন নতুন জাতের উদ্ভাবন হচ্ছে। আর এ ক্ষেত্রে গুরুত্ব পাচ্ছে আবহাওয়া, প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবেলা করে অল্প সময়ে বেশি ফলন দেয় এমন জাতের ধান। যা দেশীয় বাহারী নামের ধান হারিয়ে যাওয়ার মূল কারণ।

সরকারের কৃষি তথ্য সার্ভিসের ওয়েব থেকে পাওয়া তথ্য বলছে, এখন বাংলাদেশে হাইব্রিড এবং উফশীসহ আরও অনেক ধরণের আধুনিক জাতের ধান চাষ হচ্ছে।

ধানের জাত উদ্ভাবনের ক্ষেত্রে কয়েকটি বিষয়কে বিশেষভাবে গুরুত্ব দেয়া হয়,

সেগুলো হলো:
১. ফলন বাড়াতে হবে – আগের জাতের চেয়ে ফলন বেশি হতে হবে
২. সময় কম লাগতে হবে অর্থাৎ কম সময়ে বেশি ফলন পেতে হবে
৩. স্ট্রেস অর্থাৎ খরা, বন্যা, লবনাক্ততা, উষ্ণতা, তাপ সহ্য করা ছাড়াও রোগবালাই এবং পোকামাকড় মোকাবেলা করে যেগুলো ভালো ফলন দেবে
৪. কোয়ালিটি হতে হবে – প্রিমিয়াম কোয়ালিটি

তবে নাটোর, যশোর, রাজশাহীসহ কিছু এলাকায় অনেকেই ব্যক্তি উদ্যোগে দেশীয় জাতের ধান সংরক্ষণ করছেন দীর্ঘদিন এই ধান চাষ প্রক্রিয়া অব্যাহত রেখে এবং বীজ অন্যদেরও দিচ্ছেন এগুলো প্রসারের জন্য।

দেশে ধান চাষে গণমাধ্যম ও বিভিন্ন কৃষি সাইডে উঠে আসা তথ্য বলছে, আউশ, আমন ও বোরের কয়েকটি জাত বিশেষ কিছু কারণে কৃষকদের মধ্যে বেশি জনপ্রিয়। যেমন আমন সিজনে ব্রি ধান ৮৭, যেটি রোপা আমন হিসেবে পরিচিত। এর ব্যাপক জনপ্রিয়তা দেখা যাচ্ছে এখন। এই ধান থেকে পাওয়া যায় সাদা রংয়ের লম্বা ও চিকন আকৃতির চাল। তথ্য বলছে, এটিই এখন বাংলাদেশে সবচেয়ে উচ্চ ফলনশীল জাত এবং রোপণের পর গড়ে ১২৭ দিনের মতো সময় লাগে ধান কাটার পর্যায়ে যেতে।

এছাড়া খরা সহিষ্ণু রোপা আমন (ব্রি ৭১), যার চাল হয় লম্বা ও মোটা সাদা রংয়ের; উচ্চ ফলনশীল রোপ আমন (ব্রি ৭৫), যার চাল হয় মাঝারি মোটা ও সাদা রংয়ের এবং অলবণাক্ত জোয়ার ভাটা সহিষ্ণু রোপা আমন (ব্রি ৭৬) জাতের ধানও বেশ জনপ্রিয়।

আবার বোরো মৌসুমে এক সময় কৃষকদের মধ্যে জনপ্রিয় ছিলো উচ্চ ফলনশীল বোরো (ব্রি ২৮ ও ব্রি ২৯), যার চাল মাঝারি চিকন ও সাদা। কিন্তু এখন জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে ব্রি ৯৬ হিসেবে পরিচিত উচ্চ ফলনশীল বোরো, যার চাল মাঝারি ধরণের খাটো ও সোনালী রংয়ের।

আর আউশ জাতের ধানের মধ্যে উচ্চ ফলনশীল আউশ (ব্রি ৪৮) বেশি আবাদ হচ্ছে, যার চাল মাঝারি মোটা আর ভাত হয় ঝরঝরে।

বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইন্সটিটিউটের জরিপ বলছে, তাদের উদ্ভিদ প্রজনন বিভাগের সবচেয়ে বড় অর্জনই হচ্ছে প্রতিকূল ও অপ্রতিকূল পরিবেশ উপযোগী উচ্চ ফলনশীল আধুনিক ধানের জাত উদ্ভাবন। প্রতিষ্ঠানটির দেওয়া তথ্য জানিয়েছে, তারা এ পর্যন্ত ১০২টি (৯৫ টি ইনব্রিড ও ৭টি হাইব্রিড) উচ্চ ফলনশীল আধুনিক ধানের জাত উদ্ভাবন করেছে।

এ দেশের ভৌগলিক পরিবেশভেদে এতো বৈচিত্রময় ধান হতো যে এর সবগুলোর হদিস পাওয়াও এখন কঠিন। এর মধ্যে একটি চিলমারীর গাঞ্জিয়া ধান। তবে এটিকে আবার স্থানীয়দের মধ্যে ফিরিয়ে এনেছে কৃষি নিয়ে গবেষণা ও কাজ করা সংগঠন গুলো। স্থানীয় জাতের এ ধানটি তাড়াতাড়ি ঘরে আসে।

এখনও বরিশাল অঞ্চলে কয়েক ধরণের আমন ধানের আবাদ হয়, যেগুলোকে দেশীয় জাত হিসেবে বিবেচনা করা হয়। কিন্তু হাতে গোনা কয়েকটি অঞ্চলে স্বল্প মাত্রায় চাষ হচ্ছে দেশীয় নামের বিলুপ্তপ্রায় ধান।

সানবিডি/এন/ আই