ফু-ওয়াং ফুডের শেয়ার নিয়ে মালিকদের কারসাজি!

সান বিডি ডেস্ক আপডেট: ২০২১-০৮-১০ ২১:৩০:১৭


অ-বন্টিত বা অ-দাবীকৃত বা অনিষ্পন্ন লভ্যাংশ নিয়ে বড় ধরণের কারসাজির অভিযোগ উঠেছে পুঁজিবাজারের তালিকাভুক্ত খাদ্য ও আনুসঙ্গিক খাতে ফু-ওয়াং ফুডের বিরুদ্ধে। শেয়ারহোল্ডারদের অবন্টিত শেয়ার মালিকদের নামে হস্তান্তর করা হয়েছে। বিষয়টি খতিয়ে দেখতে তদন্ত কমিটি গঠন করেছে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ এন্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)।

বিএসইসি সূত্র মতে, সম্প্রতি বিএসইসির নির্বাহী পরিচালক মো. সাইফুর রহমান স্বাক্ষরিত একটি আদেশে ফু-ওয়াং ফুডকে নিয়ে এ দুই সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। বিষয়টি ফু-ওয়াং ফুড এবং ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) ব্যবস্থাপনা পরিচালককে অবহিত করা হয়েছে।

গঠিত তদন্ত কমিটির সদস্যরা হলেন- বিএসইসির উপ-পরিচালক মো. সিরাজুল ইসলাম ও সেন্ট্রাল ডিপোজিটরি বাংলাদেশ লিমিটেডের (সিডিবিএল) সিনিয়র এক্সিকিউটিভ শাফায়েত আহমেদ সিদ্দীক সুহৃদ। আগামী ৩০ কার্যদিবসের মধ্যে গঠিত তদন্ত কমিটিকে প্রতিবেদন দাখিল করতে নির্দেশ দিয়েছে বিএসইসি।

সিকিউরিটিজ এন্ড এক্সচেঞ্জ অধ্যাদেশ, ১৯৬৯ এর ধারা ২১; বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ এন্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন আইন, ১৯৯৩ এর ধারা ১৭(ক) এবং ডিপোজিটরি আইন, ১৯৯৯ এর ধারা ১৩ অনুযায়ী এ তদন্ত কমিটি গঠন করা নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

আইন অনুযায়ী, পুঁজিবাজারের তালিকাভুক্ত কোম্পানির  শেয়ারহোল্ডারদের জন্য ঘোষিত লভ্যাংশ কোম্পানিগুলোর পৃথক সাসপেন্স বিও হিসাব রাখতে হয়। পরবর্তীতে কোন দাবীদার আসলে যাতে, তা পরিশোধ করতে পারে।

ফু-ওয়াং ফুডের ওই সময়ের কোম্পানি সচিব আব্দুল হালিম ঠাকুর বিএসইসিতে অভিযোগ করেন ২০১১ ও ২০১২ সালে ফু-ওয়াং ফুডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আরিফ আহমেদ চৌধুরীর স্ত্রী রাফিয়া আক্তার, ব্যবস্থাপনা পরিচালকের বন্ধু আকরাম ও তার স্ত্রীর নামে হস্তান্তর করা হয়েছে। এএমএফ সিকিউরিটিজ ও পিএফআই সিকিউরিটিত থেকে তাদের নামে হস্তান্তর করা হয়েছে। বিষয়টি নিয়ে আরিফ আহমেদের সাথে কথা বললে তিনি চুপ থাকার নির্দেশ দেন। পরবর্তীতে বিষয়টি প্রকাশ হলে আব্দুল হালিম ঠাকুর ও তার পরিবারের ক্ষতি হবে বলে ভয় ভীতি দেখান।

আব্দুল হালিম ঠাকুর বিএসইসিতে অভিযোগ করেন, আরিফ আহমেদ চৌধুরীর বিভিন্ন কর্মকান্ডের চাপে মানুষিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েন। পরে পদত্যাগের জন্য আবেদন করলে ২০১৯ সালে তাকে অব্যহতি দেওয়া হয়। বিনিয়োগকারী ও পুঁজিবাজারের উন্নয়নের স্বার্থে তিনি এই অভিযোগ করছেন বলে জানান বিএসইসিকে।

এদিকে অনিয়মে জর্জরিত ফুয়াং ফুডের পর্ষদ পুনর্গঠন করেছে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন(বিএসইসি)। বর্তমান পরিচালকদের সাথে আরও পাঁচজন স্বতন্ত্র পরিচালক নিয়োগ দিয়েছে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসি।

সূত্র মতে বিনিয়োগকারীদের স্বার্থের কথা বিবেচনা করে দূর্বল কোম্পানিগুলোর পর্ষদ পুনর্গঠন করা শুরু করেছে বিএসইসি। এর আগে আরও কয়েকটি কোম্পানির পর্ষদ পুনর্গঠন করা হয়েছে। এরই ধারাবাহিকতায় ফুয়াং ফুড লিমিটেডের পরিচালনা পর্ষদ পুনর্গঠন করা হয়েছে।

নতুন যারা আসছেন: নতুন পাঁচ পরিচালক হলেন- বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফোশনালের প্রধান ফিন্যান্স কর্মকর্তা বিগ্রেডিয়ার জেনারেল ইসরাত হোসাইন, সিঙ্গার বিডির সাবেক কোম্পানি সচিব ও ইনস্টিটিউট অব চার্টার্ড সেক্রেটারিজ অব বাংলাদেশ (আইসিএসবি) একাধিকবারের সভাপতি মোহাম্মদ সানাউল্লাহ এফআইপিএম,এফসিএস, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী অধ্যাপক মোহাম্মদ সালাউদ্দিন চৌধুরী, এফসিএ, অধ্যাপক নিজামুল হক ভুইয়া এবং সরকারের সাবেক অতিরিক্ত সচিব অজিত কুমার পাল এফসিএ।

বিএসইসি সূত্র মতে, কোম্পানিটি বিএসইসির অনেক নির্দেশনা পরিপালনে ব্যর্থ হয়েছে। একই সাথে কোম্পানিতে দীর্ঘদিন ধরে নানা অনিয়ম চলছে। পুঁজিবাজার ও বিনিয়োগকারীদের স্বার্থের কথা বিবেচনা করে এই কোম্পানির পরিচালনা পর্ষদ পুনর্গঠন করা হয়েছে।

বিএসইসির ধরা পড়া চোখে অনিয়ম: বিএসইসির ২০১৯ সালের ২১ মে জারি করা নির্দেশনা বলা হয়েছে সম্মিলিতভাবে কোম্পানির উদ্যোক্তা পরিচালকদের কমপক্ষে ৩০ শতাংশ শেয়ার ধারণ করতে হবে। বর্তমানে কোম্পানিটির পরিচালকদের কাছে মাত্র মোট শেয়ারের ৯ দশমিক ৮৬ শতাংশ রয়েছে।

দ্বিতীয়ত, ২০২০ সালের ১০ ডিসেম্বর জারি করা নির্দেশনা বলা হয়েছে অতিরিক্ত আরও দুইজন স্বতন্ত্র পরিচালক নিয়োগ দিতে হবে। এই নির্দেশনাটিও পরিপালন করেনি কোম্পানির পর্ষদ।

তৃতীয়ত, কোম্পানির নানা অনিয়ম বিএসইসির নজরে আসার পর একটি তদন্ত কমিটি করা হয়। কমিটির প্রতিবেদনে দেখা যায়, আইন লঙ্গন করে কোম্পানির সাথে সম্পৃক্ত এবং পরিবারের লোকদের সাথে অনেক কাজ করেছে। যার জন্য সঠিক ডিসক্লোজার দেওয়া হয়নি।

চতুর্থত, ২০২১ সালের ২৮ এপ্রিল কোম্পানি লুবাবা তাবাস্সুম নামে একজন পরিচালক নিয়োগ দেওয় হয়েছে। এই পরিচালক ব্যবস্থাপনা পরিচালক ড. আরিফ আহমেদ চৌধুরী মেয়ে। তাকে প্রতি মাসে ১ লাখ ৫০ হাজার টাকা সম্মানি হিসেবে দেওয়া হয়।এর বাহিরে তাকে বিভিন্ন বোনাস, গাড়ি সুবিধা, মোবাইল বিল এবং ব্যবসায়িক টুরের নামে টাকা পরিশোধ করতো।

পঞ্চমত, কোম্পানিটির উৎপাদনক্ষমতা বৃদ্ধি এবং কারখানা সম্প্রসারণের জন্য গাজীপুরের মণিপুর মৌজার বোকরানে ৯৬ শতাংশ জমি ক্রয় করে। রেজিস্ট্রেশনসহ জমি কিনতে কোম্পানিটির ব্যয় হয় তিন কোটি টাকা। এখানে নানাভাবে অনিয়ম করেছে কোম্পানির পরিচালকরা।

লভ্যাংশের ইতিহাস: ডিএসইর সূত্র মতে, পুঁজিবাজারে তালিভুক্তির পর থেকে কোম্পানিটি বোনাস লভ্যাংশই বেশি দিয়েছে। সর্বশেষ আর্থিক প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে শেয়ারহোল্ডারদের ১ দশমিক ৬৫ শতাংশ নগদ লভ্যাংশ দিয়েছিলো। এর আগে ২০১৯ অর্থ বছরের জন্য ২ শতাংশ নগদ লভ্যাংশ দিয়েছে।

২০১৬, ২০১৭ ও ২০১৮ সালে ১০ শতাংশ করে বোসান, ২০১৫ সালে ১৫ শতাঋশ বোনাস, ২০১৪ সালে ১০ শতাংশ বোনাস, ২০১৩ সালে ১২ শতাংশ বোনাস, ২০১২ ও ২০১১ সালে ২০ শতাংশ করে বোনাস এবং ২০১০ সালে ১০ শতাংশ বোনাস লভ্যাংশ দিয়েছিলো।

ফু ওয়াং ফুড ২০০০ সালে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হয়েছে। বর্তমানে কোম্পানিটি বি ক্যাটাগড়িতে লেনদেন হচ্ছে। কোম্পানিটির অনুমোধিত মুলধন ১৫০ কোটি টাকা এবং পরিশোধিত মূলধন ১১০ কোটি ৮৩ লক্ষ ৯০ হাজার টাকা। মোট শেয়ারের ৯ দশমিক ৮৬ শতাংশ রয়েছে উদ্যোক্তা পরিচালকদের কাছে। বাকী শেয়ারের মধ্যে ১৮ দশমিক ৫ শতাংশ প্রতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারী, ০.৩৮ শতাংশ বিদেশি বিনিয়োগকারী এবং ৭১ দশমিক ৭১ শতাংশ রয়েছে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের কাছে।

অন্যদিকে চলতি বছরের আগস্টের মধ্যে অ-দাবীকৃত বা অ-বন্টিত কিংবা অনিষ্পত্তিকৃত নগদ লভ্যাংশ কিংবা বিনিয়োগকারীকে ফেরত দেয়া হয়নি এমন অর্থ কিংবা এ ধরনের অন্যান্য অর্থ পুঞ্জীভূত সুদসহ পুঁজিবাজার স্থিতিশীলতা তহবিলে জমা দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছে বিএসইসি। এর আগে এ অর্থ জমা দেওয়ার সময়সীমা নির্ধারণ করা হয়েছিল গত ৩০ জুলাই পর্যন্ত। তবে তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোর সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব পাবলিকলি লিস্টেড কোম্পানিজের (বিএপিএলসি) আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ওই অর্থ জমা দেওয়ার জন্য আরো এক মাস সময় বাড়িয়ে দেয় বিএসইসি।

ইতোমধ্যে অনেক তালিকাভুক্ত কোম্পানি অ-দাবীকৃত কিংবা অ-বন্টিত নগদ লভ্যাংশের বিষয়ে তাদের শেয়ারহোল্ডারদের কাছে চিঠি পাঠিয়েছে। এক্ষেত্রে শেয়ারহোল্ডারদের নগদ লভ্যাংশ গ্রহণ করার জন্য উপযুক্ত প্রমাণসহ কোম্পানির সঙ্গে যোগাযোগ করার জন্য বলা হয়েছে। নির্ধারিত সময়ের মধ্যে যোগাযোগ করা না হলে এ বছরের ২৯ আগস্টের মধ্যে ওই অর্থ পুঁজিবাজার স্থিতিশীলতা তহবিলে স্থানান্তর করা হবে। তবে তহবিলে স্থানান্তর করা হলেও উপযুক্ত প্রমাণ সাপেক্ষে যেকোনো সময় এই অর্থ দাবি করতে পারবেন শেয়ারহোল্ডারা।

পুঁজিবাজারের সব খবর পেতে জয়েন করুন 

Sunbd Newsক্যাপিটাল নিউজক্যাপিটাল ভিউজস্টক নিউজশেয়ারবাজারের খবরা-খবর