পর্যটক ভিসা দিয়ে অভিবাসীদের ইউরোপে পাঠাচ্ছে বেলারুশ

সান বিডি ডেস্ক প্রকাশ: ২০২১-১০-২৩ ১৯:১৩:১৪


বিভিন্ন দেশের অভিবাসনপ্রত্যাশীদের ‘পর্যটন’ ভিসা দিয়ে ইউরোপে ঢুকতে সাহায্য করছে বেলারুশ। দেশটির বিরুদ্ধে ইউরোপীয় ইউনিয়নের জারি করা নিষেধাজ্ঞার পাল্টা প্রতিশোধ হিসেবে তারা এ পদক্ষেপ নিয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে।

এই পথে জার্মানিতে পৌঁছানোর চেষ্টা করছে এমন একটি দলকে অনুসরণ করে বিবিসি। মোবাইল ফোনের ক্যামেরা বাম থেকে ডানে ঘুরে যাচ্ছে, কিন্তু কেউ নড়ছে না। পথ চলায় ক্লান্ত, পরিশ্রান্ত মানুষগুলো গাছের ফাঁকে ফাঁকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে শুয়ে আছে। জামিলের মাথাটা তার হাতের ওপর রাখা, স্ত্রী রোশিন তার পাশেই গুটিসুটি মেরে শুয়ে আছে। অন্যদের দেখে মনে হচ্ছে পড়ে থাকা লাশ।

জঙ্গলের ওপর ছড়িয়ে আছে শেষ বিকালের আলো, পাইন গাছের ঘন বনকে মনে হয় প্রকৃতির তৈরি কয়েদখানা। এই মানুষগুলো ভোর চারটা থেকে এক নাগাড়ে পথ হেঁটেছে।

জামিলের চাচাতো ভাই ইদ্রিস বলছিলেন, ‘আমরা বিধ্বস্ত, পুরোপুরি বিধ্বস্ত।’ তার কণ্ঠস্বর ভাবলেশহীন- অনেকটা যন্ত্রের মতো। সিরীয় কয়েকজন বন্ধুর এই দলটি ঘন জঙ্গল আর দুর্গন্ধময় জলাভূমি পার হয়ে এখানে এসে পৌঁছেছে। পাচারকারীদের সঙ্গে প্রথম মোলাকাতটা তারা কোনওক্রমে এড়াতে পেরেছে। কিন্তু খাবার ও পানি একেবারেই শেষ।

ঠাণ্ডায় তাদের শরীর অবশ হয়ে গেছে। কিন্তু আগুন জ্বালানোর সাহস নেই। বেলারুশ থেকে সীমান্ত পার হয়ে তারা পোল্যান্ডে পৌঁছেছে। অর্থাৎ শেষ পর্যন্ত ইইউ জোটভুক্ত দেশে ঢুকতে পেরেছে। কিন্তু তারপরেও তারা নিরাপদ নয়। কারণ হাজার হাজার অভিবাসনপ্রত্যাশী, যাদের সীমান্ত পার হয়ে পোল্যান্ড, লিথুয়ানিয়া এবং লাটভিয়ায় ঢুকতে উৎসাহিত করছে বেলারুশ তাদের ঠাঁই হয়েছে বন্দি শিবিরে।পোল্যান্ডের জঙ্গলে তীব্র শীতের কামড়ে শরীরের তাপমাত্রা বিপজ্জনক মাত্রায় নেমে গিয়ে মৃত্যু হয়েছে অন্তত সাতজনের।

নতুন পথের সন্ধান

ইদ্রিস এবং তার বন্ধুরা সেপ্টেম্বরের শেষে উত্তর ইরাক ছাড়ার সময় থেকে বিবিসি ওদের যাত্রার ওপর নজর রেখেছে। তারা যেভাবে এগিয়েছে ইদ্রিস মোবাইলে তার প্রতিটা পর্যায়ের ভিডিও করে বিবিসি-র কাছে পাঠিয়েছেন। এই দলের সবাই সিরিয়ান কুর্দি। বয়স ২০-এর কোঠায়। উন্নত ভবিষ্যতের আশায় তারা ইউরোপে পাড়ি জমিয়েছে। এদের সবার বাড়ি সিরিয়ার কোবানিতে, যেখানে ২০১৪ সালের শেষ দিকে কুর্দি যোদ্ধাদের সঙ্গে আইএসের তুমুল লড়াই চলে।

বিশ্বের সব অভিবাসনপ্রত্যাশীদের মতো তাদেরও দেশ ছাড়ার পেছনে একই যুক্তি। নিজেদের দেশে রাজনৈতিক অস্থিরতা, বেকারত্ব, সেনাবাহিনীতে যোগদানে বাধ্য করা। কিন্তু তাদের ক্ষেত্রে তফাৎ ছিল একটা- সেটা হল নতুন একটি পথ ধরে তাদের যাত্রা।

ইদ্রিস বলছিলেন, বেলারুশের স্বৈরশাসক আলেক্সান্ডার লুকাশেঙ্কো যদি এই নতুন এবং কার্যত একটা নিরাপদ পথের লোভ না দেখাতেন, তাহলে তিনি হয়তো সিরিয়া ছাড়ার কথা ভাবতেন না। তার ভাষায়, ‘ইইউ-এর সঙ্গে বেলারুশের তো একটা দ্বন্দ্ব চলছে। তাই দেশটির প্রেসিডেন্ট ইইউ-এর সঙ্গে তাদের সীমান্ত খুলে দিয়েছেন।’

বেলারুশে ২০২০ সালের বিতর্কিত প্রেসিডেন্ট নির্বাচন এবং রাজনৈতিক বিরোধীদের ব্যাপক ধরপাকড়ের ঘটনায় ইইউ দেশটির ওপর একের পর এক নিষেধাজ্ঞা জারি করায় প্রেসিডেন্ট লুকাশেঙ্কো ক্ষুব্ধ হন। এ বছরের গোড়ার দিকে তিনি ঘোষণা দেন, তার দেশ থেকে ইইউ-এর সদস্য দেশগুলোতে অভিবাসীদের যাওয়া কিংবা মাদক চোরাচালান ঠেকাতে কোনও পদক্ষেপ তিনি নেবেন না।

ভূমধ্যসাগরে নৌকা নিয়ে বিপজ্জনক পথে যাওয়ার বদলে অভিবাসীদের এখন বিমানপথে যেতে হবে বেলারুশে। এরপর কয়েক ঘণ্টা গাড়িতে করে সীমান্ত পর্যন্ত- তারপর সীমান্ত পার হয়ে পায়ে হেঁটে প্রতিবেশী দেশ পোল্যান্ড, লিথুয়ানিয়া কিংবা লাটভিয়া- যে কোনও একটি ইইউ দেশে ঢুকে পড়া। জুলাই আর অগাস্ট; মাত্র দুই মাসে লিথুয়ানিয়াতে যত আশ্রয়প্রার্থী ঢুকেছে তার হার পুরো ২০২০ সালের তুলনায় ৫০ গুণ বেশি। ইদ্রিস বলছিলেন, ‘এই পথ তুরস্ক আর উত্তর আফ্রিকা দিয়ে ইউরোপে ঢোকার চেয়ে অনেক সহজ।’

তিনি ও তার বন্ধুরা উত্তর ইরাকের ইরবিল থেকে যাত্রা শুরু করেছিলেন ২৫ সেপ্টেম্বর। ইদ্রিস সেখানে কাজ করতেন। স্ত্রী আর যমজ কন্যা সন্তানকে কোবানিতে রেখে এসেছেন। তাদের প্রতিশ্রুতি দিয়ে এসেছেন ইউরোপে সফলভাবে পৌঁছাতে পারলে একদিন তাদেরও সেখানে নিয়ে যাবেন। সূত্র: বিবিসি।

সানবিডি/এনজে