বন্যাসহিঞ্চু বিনা ধান-১১ চাষ করে লাভবান কৃষক

নিজস্ব প্রতিবেদক প্রকাশ: ২০২১-১১-০১ ১৫:১৩:১১


বর্ষার প্রতিকূলতা কাটিয়ে উঠতে না উঠতেই চলতি বছরের আমন মৌসুম একেবারে ভিন্নভাবে ধরা দিয়েছে ময়মনসিংহ সদর উপজেলার ছাতিয়ানতলা গ্রামের কৃষকদের কাছে। ধানের ক্ষেত বন্যায় তলিয়ে গেলেও শতভাগ ফলন ঘরে তুলছেন একাধিক কৃষক।

ওই এলাকার কৃষকদের কাছে আশীর্বাদ হয়ে দেখা দিয়েছে বাংলাদেশ পরমাণু কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের (বিনা) বিজ্ঞানীদের উদ্ভাবিত বিনা ধান ১১। বন্যাসহিঞ্চু স্বল্পমেয়াদি এ ধানের চাষ করে কৃষকের মুখের হাসি হয়েছে চওড়া। সঙ্গে বাড়তি সরিষা আবাদের সুযোগ মিলেছে।

সম্প্রতি ময়মনসিংহ সদর উপজেলার ছাতিয়ানতলা গ্রামে সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, মাঠে সোনালী রঙের বিনা ধান ১১ দোল খাচ্ছে। কিছু জমিতে ইতোমধ্যে ধান কাটা শেষ হয়েছে। মাঠে পৌঁছাতেই কৃষকদের মধ্যে দেখা গেল আত্মতৃপ্তির ছোঁয়া।

ময়মনসিংহ শহর থেকে প্রায় ১৭ কিলোমিটার দূরে ছাতিয়ানতলা গ্রামের কৃষকেরা এ প্রতিবেদককে জানান, ব্রহ্মপুত্র তীরের এ চরে বন্যা-বৃষ্টিতে ধানের ফলন একেবারেই পাওয়া যায় না। সারাবছর শুধু বোরো ধানেরই ভালো আবাদ হয়। কিন্তু এবছর অনেকেই বিনা ধান ১১ আবাদ করে ভালো ফলন ঘরে তুলছেন। বোরো মৌসুম শুরুর আগে সরিষার আবাদও করতে পারবেন তারা।

বাংলাদেশ পরমাণু কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের (বিনা) বিজ্ঞানীরা জানান, এ জাতটি বন্যা সহনশীল। এ ধান ২৫ দিন পর্যন্ত পানিতে ডুবে থাকলেও কোনো ক্ষতি হয় না। আর ফলনও বেশি। আবার উৎপাদন খরচও তুলনামূলক অনেক কম। মাত্র ১০৫ থেকে ১১০ দিনের মধ্যে ফলন ঘরে তোলায় যায়। ফলে কৃষক বছরে অন্তত তিনটি ফসল করতে পারবেন এসব জমি থেকে।

কৃষকদের সঙ্গে আলাপকরে জানা যায়, একই জমি থেকে বছরে তিন ফসলের চাষের সুযোগে কৃষকরা যেন নতুন করে জেগে উঠেছেন। এখন আর তাদের বন্যায় ধান ডুবে যাওয়া নিয়ে দুশ্চিন্তা করতে হবে না। পড়তে হবে না আর্থিক ক্ষতিতে। অতীতের সব ক্ষতি যেন পুষিয়ে নেওয়ার পালা।

গত দুই বছর বিনা তাদের ধানের বীজ দিয়েছে উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, বিনার প্রশিক্ষণ পাওয়া সব কৃষকেরা নিজেই বীজ উৎপাদন শিখেছে। এই ধান চাষ চরাঞ্চলের সব কৃষকদের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে পারলে এ অঞ্চলের মানুষের অভাব থাকবে না।

বিনার বিজ্ঞানীরা জানান, শুধু ময়মনসিংহ নয়, চলতি বছরে উত্তরের জনপদ রংপুরের বিভিন্ন এলাকা, বরেন্দ্রভূমি, গোপালগঞ্জসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় কয়েক হাজার হেক্টর জমিতে জলমগ্নতাসহিষুষ্ণ, উচ্চফলনশীল ও আগাম আমন ধানের জাত বিনা ধান-১১ চাষ হয়েছে।

কৃষিবিজ্ঞানীদের মতে, দেশে প্রতি বছর অতিবৃষ্টির কারণে জলাবদ্ধতা ও বন্যায় প্রায় ২০ লাখ হেক্টর জমির ধান কোনো না কোনোভাবে আংশিক বা সম্পূর্ণ ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে থাকে। তাছাড়া জলোচ্ছ্বাস ও ঘূর্ণিঝড়ের কারণে আকস্মিক বন্যা, অতি বন্যা, জোয়ারের বন্যা, পাহাড়ি ঢলের বন্যার কারণে আবাদি জমি ক্রমাগত কমছে।

এসব বিষয় মাথায় রেখে বিনার বিজ্ঞানীরা উদ্ভাবন করেছেন জলমগ্নতাসহিষুষ্ণ ধানের জাত বিনা-১১। আমনের এ জাত ২০-২৫ দিন জলমগ্নতা সহ্য করার পরও বন্যা আক্রান্ত জমিতে হেক্টরপ্রতি পাঁচ থেকে সাড়ে পাঁচ টন এবং বন্যামুক্ত স্বাভাবিক জমিতে ছয় থেকে সাড়ে ছয় টন পর্যন্ত ফলন দিতে সক্ষম।

এ কৃষি বিজ্ঞানী বলেন, এ জাতটি আবাদে অনেক বড় সাড়া পাওয়া গেছে। কোথাও কোথাও বিঘাপ্রতি ২৭ মণ ধান উৎপাদন হয়েছে। এ ধানের সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট হলো পানির নিচে ২৫ দিন থাকলে, এমনকি পানিতে তলিয়ে পচে গেলেও শুকানোর পর ধানের গোড়া থেকে ফের ডগা বা পাতা গজায়। অর্থাৎ নতুন করে ধান রোপণ করতে হয় না।

তিনি জানান, দেশে প্রায় ৫২ লাখ হেক্টর জমিতে আমন ধান চাষ হয়েছে। এর মধ্যে বিনা-১১ জাতটি চাষ হয়েছে ছয়-সাত শতাংশ জমিতে। স্বল্প জীবনকালবিশিষ্ট এসব জাত চাষ করে কৃষক দুই ফসলি জমিকে তিন-চার ফসলি জমিতে রূপান্তর করেছেন।

ছাতিয়ানতলা গ্রামের কৃষক আব্দুল আজিজ বলেন, এবার দুই বিঘা জমিতে বিনা ধান-১১ চাষ করেছি। আমার জমির আশপাশের সবার চেয়ে আগে ধান ঘরে তুলতে পেরেছি। আমার ধান কাটা হয়ে গেছে কিন্তু পাশের জমির ধান এখনো শীষ-ই আসেনি। আমরা সবাই অবাক হয়ে গেছি, এতো ভালো জাতের ধান দেখে।

তিনি জানান, বিনার কর্মকর্তারা এ এলাকার কয়েকজন কৃষককে বিনা ধান-১১ চাষ করার পরামর্শ দেন। যারা এ ধান আবাদ করেছেন তারা সবাই লাভবান হয়েছেন। তাদের দেখে এবার অনেকেই এ ধান চাষে আগ্রহ দেখাচ্ছেন। বন্যাপ্রবণ এমন এলাকায় এ যেন সোনা পাওয়ার মতো বিষয়। এখন সরিষা রোপন করার প্রস্তুতি নিচ্ছেন তিনি। এরপর বোরো ধান চাষ করবেন।

বিনা সূত্র জানায়, মধ্য আশ্বিন মাস থেকে এই ধান কাটা হয়। ফলে এ সময় ধানের খড় থেকে গো-খাদ্যের চাহিদা মিটছে। কৃষক খড় বিক্রি করেও বাড়তি আয় করতে পারছেন। বিনা-১১ কৃষকের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে বর্তমানে সারাদেশে এক হাজারেরও বেশি মাঠ প্রদর্শনী করা হচ্ছে।

এ বিষয়ে কৃষি মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (সম্প্রসারণ) মো. হাসানুজ্জামান কল্লোল বলেন, আমাদের দেশে কৃষিতে সবচেয়ে বড় সমস্যা বন্যা ও ঝড় বৃষ্টি। এ প্রতিকূলতাকে জয় করতে বিনা ধান-১১ অগ্রণী ভূমিকা রাখছে। কৃষকদের মাঝ থেকেও ভালো সাড়া পাওয়া যাচ্ছে। যা খুবই ইতিবাচক। বন্যা সহনশীল এ ধানটির চাষ চরাঞ্চলসহ বন্যাকবলিত এলাকার কৃষকদের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে হবে।

সানবিডি/ এন/আই