মুসলিম শাসনামলে কৃষি উন্নয়ন ও খাদ্যে স্বনির্ভরতা

সান বিডি ডেস্ক প্রকাশ: ২০২১-১২-৩০ ২০:৪৭:১৫


কৃষি উন্নয়নে মুসলিমদের ইতিহাস স্বর্ণোজ্জ্বল। যুগে যুগে মুসলিম খলিফারা দেশের আর্থসামাজিক উন্নয়নে কৃষির প্রতি যথেষ্ট মনোযোগী ছিলেন। সাহাবায়ে কেরাম চাষাবাদ করেছেন। নবীজি (সা.) কৃষিকর্মের প্রশংসা করেছেন। পবিত্র কোরআনের অনেক আয়াতে কৃষিপ্রসঙ্গ এসেছে। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘তোমরা যে বীজ বপন করো, সে সম্পর্কে ভেবে দেখেছ কি? তোমরা তাকে উৎপন্ন করো, না আমি উৎপন্নকারী?’ (সুরা ওয়াকিয়া : ৬৩-৬৪)

কৃষির জন্য পানি একটি অপরিহার্য উপাদান। পানি ছাড়া এই জমিনে কোনো কিছু উৎপন্ন করা সম্ভব নয়। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘তিনিই আকাশ থেকে পানি বর্ষণ করেছেন। অতঃপর আমি এর দ্বারা সর্বপ্রকার উদ্ভিদ উৎপন্ন করেছি। অতঃপর আমি এ থেকে সবুজ ফসল নির্গত করেছি, যা থেকে যুগ্ম বীজ উৎপন্ন করি। খেজুরের কাঁদি থেকে গুচ্ছ বের করি, যা নুয়ে থাকে এবং আঙুরের বাগান, জায়তুন ও আনার পরস্পর সাদৃশ্যযুক্ত এবং সাদৃশ্যবিহীন (উৎপন্ন করি)। বিভিন্ন গাছের ফলের প্রতি খেয়াল করো, যখন সেগুলো ফলন্ত হয় ও তার পরিপক্বতার প্রতি খেয়াল করো। নিশ্চয় এগুলোর মধ্যে নিদর্শন রয়েছে বিশ্বাসী সম্প্রদায়ের জন্য।’ (সুরা আনআম : ৯৯)

হাদিস শরিফেও জমি চাষাবাদে উদ্বুদ্ধ করা হয়েছে। ভূমি যেন পতিত অবস্থায় না থাকে, সে জন্য নবীজি (সা.) বলেন, ‘যার কোনো জমি আছে, সে যেন তা চাষাবাদ করে। অথবা অন্য ভাইকে দান করে দেয় (তবু যেন অনাবাদি না থাকে)।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস : ২৪৯৩)

সালফে সালেহিন ও খলিফাদের কৃষির প্রতি গুরুত্ব্ব : সালফে সালেহিন তথা সাহাবায়ে কেরাম ও তাবেঈন কৃষি উন্নয়নের প্রতি খুব মনোযোগী ছিলেন। উসমান (রা.)-কে একবার জিজ্ঞাসা করা হয়, আপনি বৃদ্ধ বয়সে বৃক্ষরোপণ করছেন কেন? তিনি জবাব দেন, ‘সৎ কর্মরত অবস্থায় আমার মৃত্যু হওয়া ফাসাদরত অবস্থা থেকে উত্তম। একবার আবু দারদা (রা.) আখরোটগাছ রোপণ করছিলেন। তখন তাঁকে বলা হয়, আপনি বৃদ্ধ বয়সে এটা কেন লাগাচ্ছেন? অথচ এর ফল পেতে ২০ বছর (অর্থাৎ অনেক) সময় লাগবে। তিনি জবাব দেন, আজর তথা প্রতিদান ছাড়া আমার অন্য কোনো চাহিদা নেই।’ (নুজহাতুল আনাম, পৃষ্ঠা ১৮৫)

আবদুর রহমান ইবনে আওফ (রা.) ধনী হওয়া সত্ত্বেও মাঠে কোদাল নিয়ে নিজ হাতে পানি সেচনের ব্যবস্থা করে দিতেন। তালহা ইবনে উবাইদুল্লাহ (রা.) সর্বপ্রথম মদিনার জমিতে গম চাষ করেন। এত বিশাল এলাকাজুড়ে চাষাবাদ করেন যে উৎপন্ন শস্য মদিনাবাসীর এক বছরের খোরাকি হয়ে যেত। ফলে সিরিয়া থেকে খাদ্যশস্য আমদানি নিষ্প্রয়োজন হয়ে পড়ে। (তারিখে দিমাশক : ২৫/১০২)

হজরত আবু হুরায়রা (রা.) চাষাবাদকে আত্মমর্যাদাময় কর্ম হিসেবে গণ্য করতেন। (আততারাতিব ইদরাকিয়্যাহ : ২/৫১)

অথচ পরিতাপের বিষয় হচ্ছে, আজকের নতুন প্রজন্ম কৃষিকে নিম্নমানের পেশা হিসেবে গণ্য করে।

কৃষি উন্নয়নে খলিফা-আমিরদের অবদান : হিজরি প্রথম শতকে ইসলামী সাম্রাজ্য অর্ধজাহানে বিস্তৃত হয়। এরপর থেকে সুদীর্ঘকাল ধরে উমাইয়া, আব্বাসিয়া, উসমানিয়া খলিফারা পৃথিবী শাসন করেছেন। এসব খেলাফতের আমির-উমরারা সর্বদা কৃষি উন্নয়নের প্রতি সুনজর দিয়েছেন। তাঁরা খাল-বিল খনন, সাঁকো ও বাঁধ নির্মাণ, মাজরা তথা পানি নিষ্কাষণ পথ পরিষ্কারকরণ, ভূগর্ভ থেকে সহজে পানি উত্তোলন মেশিন স্থাপনসহ বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। শুধু বসরা নগরীতেই নাকি এক লাখ ছোট-বড় নালা ছিল, যেগুলো দিয়ে সহজে পানি প্রবাহিত হতো। অনেক নালা খননকারীর নামে নামকরণ করা হতো। খলিফা হারুনুর রশীদের স্ত্রী কর্তৃক খননকৃত ‘নহরে জুবাইদা’ ইতিহাসে বিখ্যাত হয়ে আছে।

এসব কাজে প্রচুর পরিমাণ অর্থ ব্যয় করা হয়। কৃষক-বণিকদের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে হজরত সাদ বিন আবু ওয়াক্কাস (রা.)  ‘নহরে সাদ’ খননের প্রস্তুতি নেন। এ জন্য বিপুল পরিমাণ অর্থ সংগ্রহ করা হয়। খননকাজ কিছুদূর এগোনোর পর বিশাল এক পাহাড় বাধা হয়ে দাঁড়ায়। তখন খননকাজ বন্ধ হয়ে যায়। পরবর্তী হাজ্জাজ বিন ইউসুফ আস সাকাফি (তার যুগে) পুনরায় খননকাজ শুরু করেন। তিনি এবার তত্ত্বাবধায়কদের নির্দেশ দেন যে তোমরা দেখো খননকর্মীদের দৈনিক খাবারের মূল্য কত? যদি খাদ্যের ওজন একজন শ্রমিকের খননকৃত পাথরের ওজনের সমপরিমাণও হয়, তবু তোমরা খননকাজ বন্ধ করবে না। (সেই পরিমাণ মূল্য আমি দেব) পরবর্তী সময়ে বিশাল অর্থ ব্যয় করে নহরটি খনন করা হয়। (মুজামুল বুলদান : ৫/৩২১)

সে আমলে প্রাকৃতিক নালার পাশাপাশি প্রচুর পরিমাণে কৃত্রিম নালা ছিল। যেগুলোর মাধ্যমে কৃষকরা সহজে ক্ষেত সিঞ্চন করতে পারত। মধ্যযুগে খলিফাদের এসব কর্ম আধুনিক পানিবিশেষজ্ঞগণের বিস্ময়ান্বিত করেছে।

কৃষকদের সম্মান প্রদান : খলিফারা কৃষকদের আর্থিক সচ্ছলতার জন্য অনুদান দিতেন। কৃষি উৎপাদন করতে গিয়ে যেন অর্থ সংকটে না পড়তে হয় এ জন্য কর মওকুফ করে দিতেন। অনেক স্থানে শস্য ঘরে তোলার পর কর আদায় করা হতো। হজরত ওমর (রা.) বলতেন, তোমরা কৃষকদের ব্যাপারে আল্লাহকে ভয় করো। (অর্থাৎ তাদের প্রতি জুলুম করো না।) হজরত আলী (রা.) কর্মচারীদের প্রতি নির্দেশনা প্রেরণ করেন যে তোমরা এক দিরহাম করের জন্য কৃষককে প্রহার কোরো না। খলিফা জিয়াদ বিন আবিহ কর্মচারীদের বলেন, তোমরা কৃষকদের সঙ্গে ভালো ব্যবহার করবে। কেননা তারা যত দিন মোটাতাজা থাকবে তোমরাও তত দিন মোটাতাজা থাকতে পারবে। (অর্থাৎ সুখে থাকবে।) (তাসহিলুন নজর, পৃষ্ঠা ১৫৯)

অনেক খলিফা যুদ্ধকালীন মুসলিম সেনাপতি সৈন্যদের কঠোরভাবে নিষেধ করতেন যেন তারা কোনো ফসলি জমিন নষ্ট না করে। ক্ষেতখামারে অগ্নিসংযোগ না করে। একজন কৃষক যে ধর্মেরই হোক না কেন, তাকে যেন আক্রমণ না করা হয়।

পূর্বসূরিদের কৃষিকর্মে এত মনোযোগিতার ফলে আমরা দেখতে পাই যে তাদের দৈনন্দিন খাবারের জোগান নিজেরাই উৎপদান করতেন। মুসলিম বিশ্বের খাদ্যচাহিদা নিজেদের ভূমিতেই যথেষ্ট ছিল। জনৈক ইতিহাসবিদ বলেন, ‘তদানীন্তন মুসলিম বিশ্ব বাহির থেকে খাদ্যসামগ্রী আমদানি করেছিল—এই তথ্য আমি কোথাও খুঁজে পাইনি।’ (আহমদ আমিন, জহলুল ইসলাম : ২/২৪৬)

এ ছাড়া তৎকালীন মুসলিম পণ্ডিতবর্গ চাষাবাদ নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ বই লিপিবদ্ধ করেছেন। মানুষের আগ্রহের কারণে এটি একটি স্বাতন্ত্র্য বিদ্যায় পরিণত হয়, যা ‘ইলমুজ জিরাআহ’ (কৃষিবিদ্যা) নামে পরিচিতি লাভ করে। মাটির প্রকারভেদ, শস্যবীজ উৎপাদন পদ্ধতি, ভূগর্ভস্থ থেকে পানি উৎসারণ পদ্ধতি, বিভিন্ন শস্য, শাক-সবজি ও ভেষজ ফলের পরিচয়সহ চাষাবাদের নিয়মকানুন নিয়ে প্রচুর গ্রন্থ রচিত হয়। উমাইয়া-আব্বাসি যুগের গ্রন্থভাণ্ডার এর সাক্ষী। সুতরাং এই দাবি অতিরঞ্জন নয় যে আজকের পশ্চিমারা আধুনিক কৃষিবিদ্যাকে মধ্যযুগের মুসলিম পণ্ডিতদের লিখিত বই থেকেই ধার করে নব আকৃতিতে প্রকাশ করেছে।

সুতরাং চাষাবাদকে উপেক্ষা করার কোনো সুযোগ নেই। বিশেষত মুসলিম বিশ্বের স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনে এটি অত্যন্ত জরুরি বিষয়।

লেখক : উচ্চশিক্ষার্থী, আরবি সাহিত্য, মদিনা বিশ্ববিদ্যালয়, সৌদি আরব

সানবিডি/এনজে